জিডি করার পর খুনঃ পুলিশের প্রতি আস্থা কমতে বাধ্য

মড়ার উপর খাঁড়ার আঘাতের মতো কিংবা অধিক শোকে পাথরের মতো অবস্থা এখন জনজীবনের। উত্তপ্ত কড়াই থেকে মানুষ এখন পতিত হয়েছে গনগনে চুল্লির ভেতরে। সন্ত্রাসীর হিংস্র খঞ্জর কিংবা বুলেট থেকে বাঁচার জন্য, প্রাণরক্ষার দায়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিরাপত্তা চেয়ে থানায় গিয়ে জিডি করে আসার পরই খুন হচ্ছে হতভাগ্যরা।

পুলিশ তাদের জন্য ন্যূনতম ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি। বরং জিডি করার ফলে আগুনে পড়েছে ঘৃত। ঘাতকরা হয়ে পড়েছে আরও ক্রুদ্ধ, আরও বেপরোয়া। হত্যাকাণ্ডের সময়ও এসেছে এগিয়ে। ফলে সমাজজীবনে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। পুলিশের প্রতি আস্থা তো এমনিতেই আমাদের মতো দেশগুলোতে কম, এখন সেই আস্থার পারদ একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। দুর্বিষহ জনমনের আকুল-ব্যাকুল প্রশ্ন—তাহলে কোথায়, কার কাছে গেলে পাওয়া যাবে উদ্ধার? উদ্ধারের কোনো তরী আপাতত দৃশ্যমান নয়। হতাশার অন্ধকারে মাথা কুটে মরছে অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। আর বিচারের বাণী কাঁদছে নীরবে-নিভৃতে। এমনিতেই আমাদের দেশের মানুষ পুলিশের ছায়া মাড়াতেও ভয় পায়। এখন নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করার পর, কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটায় মানুষ যেন সত্যি সত্যি লা-জবাব হয়ে গেছে। প্রশ্নবিদ্ধ আজ পুলিশ বাহিনী।
গত ক’দিনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আরেকটু খোলাসা হবে। খোদ রাজধানীর জনজীবনই যে রক্তাক্ত ও ছিন্নভিন্ন তাও বোঝা যাবে। একজন নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনার হাজী আহমদ হোসেন (ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৭০নং ওয়ার্ডের)। সন্ত্রাসীরা তাকে একের পর এক হুমকি দিয়ে আসছিল হত্যার। একপর্যায়ে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে তিনি থানায় জিডি করেন। এই জিডি করার ক’দিনের মাথায়ই ঘাতকদের বুলেটে নির্মমভাবে খুন হন তিনি। গুলশানের ব্যবসায়ী সাদেকুর রহমান ও তার স্ত্রী রোমেনা নার্গিস এলাকার বখাটে সন্ত্রাসী রুবেল ও মিথুন চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছিলেন। পুলিশ তাদের রক্ষার কোনো সামান্য উদ্যোগও নেয়নি। উল্টো সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে বাধ্য হয়ে থানা থেকে জিডি প্রত্যাহার করেন তিনি। এর ক’দিন পরই এই দুই সন্ত্রাসী তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের হত্যার পর এখন পর্যন্ত পুলিশ এই দুই নরঘাতককে গ্রেফতার করতে পারেনি। মিরপুরের ভাসানটেকের ব্যবসায়ী ওয়ালিউল্লাহও থানায় জিডি করার পর ঘাতকদের হাতে নিহত হন। পুরান ঢাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণের বিষয়টাও একই রকম। পুলিশ তার জিডিকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। বরং এর ফলে সন্ত্রাসীরাই যেন বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। মাত্র সাত দিনের মাথায় ঘাতকদের বুলেট কেড়ে নিল প্রেমকৃষ্ণের প্রাণ। অবশ্য কোনো ঝামেলাই বোধ করি হতো না, যদি সন্ত্রাসীদের দাবি মোতাবেক প্রেমকৃষ্ণ ২০ লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে দিত। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ালো—পুলিশ তো কোনো কাজেই লাগছে না। জিডি করার পর কোনো ব্যবস্থা নেয়ারও গরজ বোধ করে না তারা। বিপন্নকে রক্ষার জন্য কোনো মানবিক অনুভূতিও তাদের মধ্যে কাজ করে না। জিডি করেও যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের কথা বাদ দিলাম, অন্যান্য অপরাধের কোনো সুরাহা কি পুলিশ করতে পেরেছে? সেখানেও তো ব্যর্থতার পাহাড়। অবশ্য ভিআইপি কেউ জিডি করলে পুলিশ একটু নড়েচড়ে বসে। সাধারণ মানুষ তো ভিআইপি না, তাদের জানমাল রক্ষা করলেই কী আর না করলেই কী—বেতনের বাড়া-কমা কিংবা পদোন্নতির সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক নেই। সে কারণে ওই সব জিডি আইনের নিচে পড়ে থাকে মাসের পর মাস। তদবির করলেই হয়তো কখনও নড়ে—এই যা।
জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কুমির যেমন খাঁজকাটা দাঁতের মধ্যে শিকারকে বিদ্ধ করিয়ে অতল জলে অদৃশ্য হইয়া যায়, তেমনি করিয়া হতভাগ্যকে চাপিয়া ধরিয়া অতল স্পর্শ থানার মধ্যে অন্তর্হিত হওয়াই পুলিশ কর্মচারীর স্বাভাবিক ধর্ম।’ আবার এ কথাও বলেছেন, ‘পুলিশ একবার যে চারায় অল্পমাত্রও দাঁত বসাইয়াছে, সে চারায় কোনোকালে ফুলও ফোটে না, ফলও ধরে না। উহার লালায় বিষ আছে।’ ঔপনিবেশিক আমলের উপলব্ধিজাত এসব বাক্য যদি এখনও সত্য হয়ে থাকে, তাহলে দুঃখের অন্ত থাকবে না। তাহলে বৃথাই লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা। পুলিশকে বুঝতে হবে, যদিও ঔপনিবেশিক প্রভুদের স্থানে এখন সরকারি দল নাম লিখিয়েছে, তবুও সরকারি দলগুলো তো এদেশের, এ মাটিরই সন্তান। যেমনটি তারা নিজেরাও। যে স্বাধীন দেশে আজ মাথা উঁচু করে (!) তারা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে, সেই দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি তাদের কিছু কর্তব্য আছে। সেই কর্তব্য রাষ্ট্র কর্তৃক অর্পিত। এই অর্পিত দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার দায় তাকে নিতেই হবে। দায় যখন নিতেই হবে, সে জন্য জনজীবনের নিরাপত্তা বিধান করা, সমাজ থেকে সন্ত্রাস দূর করে জনমনে পুলিশের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার কাজটি হতে পারে প্রথম ও প্রধান কাজ। এই দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা বড় ধরনের খেসারতের ক্ষেত্রই শুধু তৈরি করবে।

No comments

Powered by Blogger.