উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার

২০১২ সালের একটা বড় সময়জুড়ে আলোচনায় ছিল উত্তর কোরিয়ার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষার বিষয়টি। এ নিয়ে তার প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়া আর জাপান ছাড়াও তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
কমিউনিস্ট দেশটি তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ক্রমশই বাড়িয়ে যাওয়ায় কেবল আঞ্চলিক মিত্র নয়, যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডও হুমকির মুখে বলে মনে করা হয়। এ অবস্থায় বছর শেষে পাক্কা ১০ হাজার কিলোমিটার পাল্লার রকেট পরীক্ষার কথা শোনা যাওয়ায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে উত্তর কোরিয়া।
উত্তর কোরিয়া গত ১২ ডিসেম্বর সর্বশেষ রকেট উনহা-৩ উৎক্ষেপণ করে। এই প্রথম তারা তিন স্তরবিশিষ্ট রকেটের সফল উৎক্ষেপণ করতে পেরেছে। তবে একটি স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানোই এই উৎক্ষেপণের লক্ষ্য বলে দাবি করেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রও নিশ্চিত করেছে যে উত্তর কোরীয় রকেটটি মহাশূন্যে একটি ‘বস্তু’ স্থাপন করেছে।
উত্তর কোরিয়ার এই সফলতা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য উদ্বেগের কারণ। সাম্প্রতিকতম পরীক্ষা থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তারা ১০ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র অথবা উৎক্ষেপক তৈরি করতে পেরেছে। নিক্ষিপ্ত রকেটের পরিত্যক্ত অংশ বিশ্লেষণ করে দক্ষিণ কোরীয় বিশেষজ্ঞরা এটি ধারণা করছেন।
এটি এখনো নিশ্চিত নয় যে উত্তর কোরীয়রা ওই দূরপাল্লার রকেটে যুদ্ধাস্ত্র সংযুক্ত করার প্রযুক্তি অর্জন করেছে কি না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে পরমাণু যুদ্ধাস্ত্র যুক্ত করার সক্ষমতা অর্জন করতে দেশটির আরও কয়েক বছর লাগবে। তাঁদের মতে, রকেটটি অসম্পূর্ণ এবং এমনকি এর ঝালাইগুলো হাতে করা।
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের এই সক্ষমতা এক দিনে অর্জিত হয়নি। দেশটি স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা শুরু করে কয়েক যুগ আগে। গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে। আশি এবং নব্বইয়ের দশকে চালায় মধ্যপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা। একই সঙ্গে চলছিল দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
অনেক বিজ্ঞানীর মতে, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র মূলত রাশিয়ার স্কাড ধরনের। এই স্কাড ক্ষেপণাস্ত্রগুলো স্বল্পপাল্লার সরাসরি যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য স্নায়ু যুদ্ধের সময় উদ্ভাবন করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এদের পাল্লা ১৮০ থেকে ৫৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
উত্তর কোরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা অর্জনের পেছনে কয়েকটি দেশের অবদান আছে। রাশিয়া (সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি) ১৯৬৯ সালে দেশটিকে কিছু প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র দেয়। তবে ধারণা করা হয়, তারা স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রথম পায় মিসরের কাছ থেকে ১৯৭৬ সালে। বলা হয়, মিসর এই ক্ষেপণাস্ত্র এবং তার নকশা দুই-ই দিয়েছিল উত্তর কোরিয়াকে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার সমর্থনের প্রতিদানে তা দিয়েছিল মিসর।
উত্তর কোরিয়া থেমে থাকেনি। এরপর তারা নিজেরাই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির প্রকল্প নেয়। ১৯৮৪ সালে নিজেরাই স্কাড তৈরি করতে সমর্থ হয় তারা। উত্তর কোরিয়ার তৈরি স্কাডগুলোর মধ্যে হোসং-৫ ও হোসং-৬ স্বল্পপাল্লার। মাঝারি পাল্লার নোদং। আর স্বল্প এবং দূরপাল্লার গবেষণায় সাফল্যের ধারাবাহিকতায় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তাইপোদং। দেশটি ২০০৬ সালে পরীক্ষামূলকভাবে তাইপোদং-২ উৎক্ষেপণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো কয়েক হাজার মাইল দূরত্বে আঘাত করতে সক্ষম। একই ধরনের তিনটি পরীক্ষা চালানো হয় ২০০৯ এবং ২০১২ সালের শুরুর দিকে। তবে তিনটিই ব্যর্থ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১২ ডিসেম্বরের তিন স্তরবিশিষ্ট রকেট উৎক্ষেপণের পরীক্ষা চালানো হয়। এবার সাফল্য পেয়েছে তারা।
হোসং-৫ ও হোসং-৬ এগুলো স্কাড বি এবং সি শ্রেণীর। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের মতে এগুলো প্রচলিত বিস্ফোরক ছাড়াও জীবাণু অস্ত্র, রাসায়নিক অস্ত্র ও পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম।
উত্তর কোরিয়ার স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য একটি হচ্ছে কেএন-০২। এর পাল্লা ১২০ কিলোমিটার যা সীমান্তে মোতায়েন করা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত হানতে সক্ষম।
উত্তর কোরিয়া গত শতাব্দীর আশির দশকে তৈরি করে নোদং নামের মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। ধারণা করা হয়, এর মাধ্যমে জাপানে আক্রমণের সক্ষমতা অর্জিত হয়। তবে এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো তথ্য জানা যায়নি। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের দাবি, নোদংয়ের কিছু সমস্যা আছে। তবে এটি বড় ধরনের ধ্বংস সাধনে সক্ষম।
উত্তর কোরিয়ার মুসুদান ক্ষেপণাস্ত্র পরিচিত নোদং-বি বা তাইপোদং-এক্স নামে। এটি একটি মাঝারি পাল্লার আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র। এর সম্ভাব্য লক্ষ্য জাপানের ওকিনাওয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন অন্যান্য মার্কিন ঘাঁটি। তবে এর পাল্লা নিয়ে মতভেদ আছে। ইসরায়েলের মতে, দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার আর যুক্তরাষ্ট্রের মতে, তিন হাজার ২০০ কিলোমিটার। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি কখনোই পরীক্ষা করা হয়নি। তাই এই মতভেদ।
তাইপোদং-১ ও ২ (উনহা মহাকাশ উৎক্ষেপকও এর অন্তর্ভুক্ত)
উত্তর কোরিয়ার কয়েক স্তরের ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে প্রথম। এর পাল্লা দুই হাজার ২০০ কিলোমিটার বলে মনে করেন মার্কিন বিশেষজ্ঞরা। তবে এটি নোদংয়ের চেয়ে কম নিখুঁত মনে করেন তাঁরা। ধারণা করা হয়, সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালে এর মাধ্যমে পৃথিবীর কক্ষপথে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র বহরের পরবর্তী সংযোজন তাইপোদং-২ যা পায়েকতুসান-২ নামেও পরিচিত। এই তিন স্তরবিশিষ্ট দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা পাঁচ হাজার থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে বলে ধারণা করা হয়। তবে মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মতে এর পাল্লা ছয় হাজার কিলোমিটার।
উত্তর কোরিয়ার কাছে এক হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র আছে বলে ধারণা করা হয়।
নতুন রকেট পরীক্ষাকে শান্তিপূর্ণ মহাকাশ কর্মসূচির অংশ দাবি করেছে উত্তর কোরিয়া। তবে এই কথায় কেউই নির্ভার হতে পারছে না। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, এই রকেটটিকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে পরিণত করতে বেশি বেগ পেতে হবে না। কারণ, দুটোতেই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
উনহা-৩ কে যদি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে পরিণত করা হয় তাহলে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। দেশটি অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অংশে আঘাত করার সক্ষমতা অর্জন করবে।

উত্তর কোরীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা
১. নোদং: ১০০০ কিলোমিটার
২. তাইপোদং-১: ২২০০ কিলোমিটার
৩. মুসুদান: ৪০০০ কিলোমিটার
৪. তাইপোদং-২: ৬০০০ কিলোমিটার
 জাহিদ আব্দুল্লাহ্, বিবিসি থেকে

No comments

Powered by Blogger.