ফাইল হয়নি তাই... এতিমের টাকা সৌদিতে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মীদের পেটে! by আহ্‌সান কবীর

ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার বড় রাজপাড়া গ্রামের আজিজুর রহমানের ছেলে শহীদুর রহমান। সৌদি আরবের আল খোবার এলাকায় আল রাসেদ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ২০০৭ সালের ১৮ আগস্ট ডিউটি শেষে রুমে ফেরার পর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।

কোম্পানির আন্তরিক প্রচেষ্টায় অন্যদের চেয়ে কম সময়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে মরদেহ দেশে ফেরত পাঠায় রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। কর্মক্ষেত্রে শহীদুরের সুনাম থাকার সুবাদে চাকরিসূত্রে পাওনা এবং তার অসহায় পরিবারকে সহায়তা স্বরূপ আল রাসেদ কোম্পানি সাতাইশ হাজার নয়শত পাঁচ রিয়ালের একটি চেক বাংলাদেশ দূতাবাসকে দেয়। কোম্পানি থেকে শহীদুরের আত্মীয়-স্বজনকে বলা হয়, তারা যাতে দূতাবাসে যোগাযোগ করে ওই চেকের টাকা গ্রহণ করেন।
শহীদুরের সৌদি প্রবাসী ভাগ্নে ইস্রাফিল ওই টাকা গ্রহণ করার জন্যে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎকালীন প্রথম সেক্রেটারি মিজানুর রহমানের কাছে গেলে উনি বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন। কয়েকদিন পর ইস্রাফিল কোম্পানি থেকে দেয়া চেকের ফটোকপি এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ দূতাবাসে গেলে তাকে জানানো হয়, কোম্পানির চাপে আমরা দ্রুত লাশ দেশে ফেরত পাঠানোর কারণে এ সংক্রান্ত ফাইল তৈরি করতে পারিনি। তাই টাকা দেয়া যাচ্ছে না।

এরপর ৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময়কালে অনেক দেন-দরবার করা হয়েছে। শহীদুরের এতিম ২ সন্তান আর বিধবা স্ত্রী তাদের ‘হক্ক’-এর ওই টাকা আর পাননি।

এদিকে, সামান্য কিছু টাকার অভাবে দেশে শহীদুরের বিধবা স্ত্রী আর এতিম সন্তানেরা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ কোম্পানির দেয়া  টাকাটা পেলে তারা একটা কিছু করে চলতে পারতো।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মামুন। সৌদির দো-আদমী এলাকার শেখ মাতবাগ কোম্পানিতে কাজ করতেন। ২০১০ সালের শেষের দিকে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সৌদি পুলিশ দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়ি ও তার চালক সৌদি নাগরিককে আটক করে। মামুনের আকামায় (পরিচয়পত্রে) সামান্য জটিলতা থাকায় অনেক ঝামেলার পর তার লাশ দেশে পাটানো সম্ভব হয়। অপরদিকে, দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়িচালক সৌদি নাগরিককে আসামি করে দো-আদমী থানায় একটি মামলা হয়।

রিয়াদের ধীরা মহকুমা আদালতে সেই মামলার বিচার হয়। এতে অভিযুক্ত সৌদি নাগরিককে এক লাখ রিয়াল জরিমানা করে রায় দেন বিচারক। জরিমানার টাকার জন্য মামুনের নিকট আত্মীয়রা ঐ সৌদি নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি আদালতে জরিমানার টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি। আপনারা আপনাদের দূতাবাসের মাধ্যমে সেই টাকা নিয়ে নিন।

সেই টাকা আদায়ের জন্য মামুনের পরিবারের পক্ষ থেকে দূতাবাসে বারবার যোগাযোগ করা হলেও দ‍ূতাবাস বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করাতে থাকে। বাংলানিউজকে এ অভিযোগ করেন ওই মামলার বাদী ও মামুনের আত্মীয় মোবারক হোসেন।

সেলেফোনে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রবাসে আমাদের অভিভাবক হচ্ছে দূতাবাস। আমরা মামুনের বিষয়টিকে নিয়ে বহুবার দূতাবাসে গিয়েছি। কিন্তু দূতাবাস এর সমাধান দিচ্ছে না।

শহীদুর, মামুন ছাড়াও এমন অসংখ্য প্রবাসী আছেন যারা বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। প্রবাসে নিহত বা মারা যাওয়া সেই সমস্ত প্রবাসীর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা তো দূরের কথা, নিহতের মরদেহও ফেরত পাঠাতে দূতাবাসের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়না আন্তরিক কোনো উদ্যোগ। আর সৌদি কর্তৃপক্ষ বা দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা জরিমানা বা ক্ষতিপূরণের অর্থও তারা হস্তান্তর করছেন না। বিষয়টি একই সঙ্গে অপ্রত্যাশিত আর অবিশ্বাস্যও বটে।

সৌদিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের বিরুদ্ধে এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মৃত্যু এবং এর ক্ষতিপূরণ বিষয়ক অনেক মামলা ঝুলে আছে। দূতাবাসের আন্তরিক চেষ্টার অভাব এবং জনবল স্বল্পতাই এই মামলা জটের প্রধান কারণ বলে বাংলানিউজকে জানায় একটি বিশ্বস্ত সূত্র।

সবশেষ হত মঙ্গলবারও ইস্রাফিল নামে শহীদুরের আত্মীয় সৌদি দূতাবাসে যোগাযোগ করেছেন পাওনা টাকার জন্য।

জবাবে দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে, ফাইল নাই!

একই কথা গত ৫ বছর ধরে বলা হচ্ছে। কিন্তু দূতাবাসের কর্মকর্তারা অসহায় পরিবারটির ‘হক’ আদায়ে কোনো চেষ্টাই করছেন না। কে বা কারা এই জটিলতার জন্য দায়ী তাও খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা তাদের নেই। তাহলে কী কারণে তারা সেখানে দেশের দূতাবাসে কাজ করছেন সে প্রশ্ন এখন সবার মুখে।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি নাজমুল নামে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা এ সংক্রান্ত দরখাস্ত গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, কেসটা ইউসুফ সাহেবের হাতে ছিলো। উনি এখন ছুটিতে। ১ সপ্তাহ পর আসেন।

এক সপ্তাহ পর যোগাযোগ করলে ইউসুফ সাহেব বলেন, আইন ছাড়া আমাদের কিছুই করার নাই।

জবাবে ইসরাফিল বলেন, আপনারা আমাদেরকে ঐ সময় যা দিয়েছেন সেই কাগজগুলোতো এখনো দিলাম। কিন্তু এর জবাবে সন্তোষজনক কিছুই বলেননি ইউসুফ সাহেব।

এ ব্যাপারে দূতাবাস সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মূল কথা হচ্ছে দূতাবাসের কুচক্রীরা টাকা উঠিয়ে ফাইল গায়েব করে দিয়েছে।

এদিকে, ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা ইউনিয়নের বড় রাজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শহীদুরের স্ত্রী নাসিমার (৪২) সঙ্গে যোগাযোগ করলে বাংলানিউজের কাছে তিনি চরম হতাশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ দূতাবাস ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান কর্তৃপক্ষের বিষয়ে। স্বামীর নামের এতগুলো টাকা তাদের নামে থাকলেও তা হাতে না পেয়ে দুই সন্তান নাহিদ (২১) ও সামিয়াকে (২৪) নিয়ে তিনি এখন অকূল পাথারে ভাসছেন।

এ ব্যাপারে তিনি জানান, সৌদিতে তার স্বামীর সঙ্গে একই কোম্পানিতে চাকরি করা বন্ধু তাহের আলী এ সম্বন্ধে কিছু জানতে পারেন। তিনি দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে কিছু করে থাকতে পারেন। কারণ, স্বামীর মৃত্যুর পর বন্ধু তাহের প্রথমদিকে যোগাযোগ রাকলেও পরে তাদেরকে এড়িয়ে যেতে থাকেন। জানা গেছে, তাহের এখনও সৌদিতে আছেন।

কথা বলে জানা যায়, সৌদিতে সাবেক বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত ইকরামুল্লা শহীদুরের পরিবারকে টাকাটা দেবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু অজানা কারণে পরে দূতাবাস সেই অবস্থান থেকে সরে যায়। এ কারণে শহীদূরের মত হতভাগা প্রবাসীরা বিদেশের মাটিতে মরে গিয়েও হয়তো অশান্তিতে থাকেন— নিজ পরিবারের দুর্দশায়।

দূতাবাসের এক শ্রেণীর লোকের অদক্ষতা, অযোগ্যতা আর নীতিহীন মানসিকতার কারণে বিদেশে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা এভাবে বঞ্চিত হতেই থাকেন। আর তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করার মত দায়িত্ববান কাউকে পাওয়া যায় না দেশে-বিদেশে। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় অপরাধীরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বদলি বা বিদেশ থেকে দেশে আসার বদৌলতে তারা মুক্ত হন যাবতীয় ‘ঝামেলা’ থেকে। 

এ ব্যাপারে শহীদুরের পরিবার থেকে ঢাকায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর কায়সারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, ডেট ওভার হয়ে যাওয়ায় টাকা ফেরৎ গেছে।

No comments

Powered by Blogger.