চট্টগ্রাম চেম্বার ভবনে তাণ্ডব এমপি লতিফ লাঞ্ছিত

চট্টগ্রাম চেম্বার ভবনে গতকাল বৃহস্পতিবার তাণ্ডব চালিয়েছে নগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা। এ সময় তাদের হাতে আওয়ামী লীগের আরেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ ও চেম্বার সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

হামলার সময় চিটাগাং চেম্বারের অন্তত ১০টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। লোকজনকে করা হয়েছে মারধর। হামলাকারীরা পুলিশি বাধাকে উপেক্ষা করে প্রায় দুই ঘণ্টা সেখানে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। এ অবস্থায় ব্যবসায়িক সব ব্যাংক, দোকানপাট, মার্কেট ও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সংসদ সদস্য লতিফ ও মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম এই ঘটনার জন্য এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে দায়ী করেছেন। ঘটনার পরপরই তারা সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিচার চেয়েছেন। বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল এনসিটি পরিচালনার টেন্ডার নিয়ে মুখ খোলায় তাদের ওপর পরিকল্পিতভাবে এই হামলা করা হয়েছে। এতদিন বন্দর নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর একক সিদ্ধান্তে  কেউই কোন কথা বলতে পারেননি। কিন্তু আজ যখন তারা সাবেক মেয়রের বন্দর রাজনীতি সবার কাছে তুলে ধরেছেন, তখনই তারা হামলার শিকার হচ্ছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল এনসিটির টেন্ডার নিয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরোধ এখন তুঙ্গে। নিজ দলের সংসদ সদস্য লতিফ ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। বলেছেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য বন্দর নিয়ে রাজনীতি করছেন। তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করে সর্বশেষ এগিয়ে এসেছেন চেম্বার সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম।
তিনি চলতি মাসের গত ২২শে সেপ্টেম্বর বিভিন্ন সংবাদপত্র অফিসে এক বিবৃতি পাঠিয়েছেন। এতে তিনি মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বন্দরের স্থিতিশীলতা নিয়ে আর রাজনীতি না করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তার প্রতিটি পদক্ষেপের পেছনে ব্যক্তিস্বার্থ কাজ করার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চট্টগ্রাম পোর্টের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের টেন্ডারের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে গতকাল চেম্বার ভবনের সামনে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ আহবান করা হয়। পুলিশ পাহারায় টেন্ডারের পক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্য এম এ লতিফ ও চেম্বার সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম সকাল ১০টা থেকে তাদের লোকজন নিয়ে সমাবেশ শুরু করেন। একপর্যায়ে সমাবেশ চলাকালে বেলা ১১টায় সেখানে হানা দেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা। তারা এ সময় ‘ধর ধর’ বলে চিৎকার করলে মুহূর্তে সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। শুরু হয় চেয়ার ছোড়াছুড়ি। মহিউদ্দিন চৌধুরীর লোকজন ও সংসদ সদস্য লতিফ এবং চেম্বার সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের অনুসারীরা বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় একে অপরের ওপর হামলা চালাতে এগিয়ে যান। উভয় সমর্থকদের হাতে লাঠিসোটা দেখা যায়।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা দল বেঁধে সংসদ সদস্য লতিফ ও চেম্বার সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমকে ধাওয়া দেন। তখন তারা দু’জন চেম্বার ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েন। পরে মহিউদ্দিন চৌধুরীর লোকজন এনসিটির টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিলের দাবিতে পাল্টা সমাবেশ শুরু করেন। সমাবেশে সংসদ সদস্য লতিফকে ১৪ দলের সব কর্মসূচি থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। বলা হয়, তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।
লতিফ-মুরাদ সমর্থকরা সংঘবদ্ধ হয়ে এবার তাদের দিকে এগিয়ে গেলে শুরু হয় হাতাহাতি। ইট-পাটকেল নিক্ষেপ।
চেম্বার ভবনের ভেতরে মহিউদ্দিনের লোকজন ঢুকতে গেলে মূল ফটক দ্রুত বন্ধ করে দেয় পুলিশ। বাধা পেয়ে ঢুকতে না পেরে বাইরে থেকে ইট ছুড়তে থাকে অনেকে। বিকাল ৪টা পর্যন্ত পুলিশ পাহারায় সংসদ সদস্য লতিফ ও মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম চেম্বার ভবনের ভেতরে অবস্থান করেন। অনাকাঙিক্ষত ঘটনা এড়াতে আগ্রাবাদ এলাকায় প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম বলেন, ‘দলবল নিয়ে সাবেক মেয়র যেভাবে আমাদের ওপর হামলা চালালেন, তা পুরো চট্টগ্রামবাসী আজ দেখেছে। নিজের দলের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছেলেদের তিনি আমাদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছেন।’
অন্যদিকে সংসদ সদস্য লতিফ দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী শেষ পর্যন্ত নিজের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে হামলা চালালেন। কিন্তু আমরা বন্দর নিয়ে কিছুতেই আর রাজনীতি হতে দেবো না। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ ঘটনা খুলে বলবো। তিনি এখন দেশের বাইরে আছেন। প্রয়োজনে এরই মধ্যে বিষয়টি জানাবো।’
তিনি বলেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরীর ভাড়াটে লোকজন আগে থেকেই এ পরিকল্পনা করেছিল। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। আর পুলিশ সেখানে নীরব দর্শক থেকে তাদের একপ্রকার সহায়তা করেছে। হামলাকারীরা মুহূর্তে এত লাঠিসোটা, পাথর জড়ো করলো কোথা থেকে?’
তিনি বলেন, ‘সাবেক মেয়রের রাজনৈতিক আদর্শ পরিষ্কার হয়ে গেছে। তিনি মাস্তান বাহিনী দিয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর কিভাবে হামলা করেছেন তা সবাই দেখেছেন। এর আগে লোকজন দিয়ে মামলা করেছেন। সব অভিযোগের জবাব দেবো আদালতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘টেন্ডারে তিনি সুবিধা আদায় করতে পারেননি বলে এখন আন্দোলন করছেন। তিনি সাইফ পাওয়ার টেকের বিরুদ্ধে। তার অর্থ উনি অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে। তার ব্যক্তিগত রাজনীতি ধরা পড়ে গেছে। আর তাই আমাদের ঘায়েল করতে চেম্বার ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিয়েছেন।’
১৪ দলের সংবাদ সম্মেলন: এদিকে সংসদ সদস্য এমএ লতিফ ও চেম্বার সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের সমর্থকদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ১৪ দল। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে নগরীর প্রেস ক্লাবে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে নিজেদের অবস্থানের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন মহাজোটের নেতারা। জানান, ১৪ দলের পূর্বঘোষিত সমাবেশ  ঠেকাতে সংসদ সদস্য এমএ লতিফ টাকা-পয়সা দিয়ে লোকজন ভাড়া করেছিলেন। আর তারাই আমাদের দুর্নাম রটাতে বিশৃঙ্খলামূলক এ কাণ্ড করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন নগর জাসদের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বাবুল। তিনি বলেন, ‘আমাদের কোন নেতা-কর্মী চেম্বার ভবন ভাঙচুর করেনি। তারা হামলাও চালায়নি। পরিকল্পনা ছিল শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবো। বন্দরের টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিল করার বিষয়ে নিজেদের যুক্তি জনসম্মুখে তুলে ধরবো।’
তিনি বলেন, ‘চেম্বার সভাপতি সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দুঃখজনক। আমরা আশা করবো এরই মধ্যে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেবেন। আর যদি না নেন তাহলে আন্দোলন চলবে।’
লিখিত বক্তব্যে সংসদ সদস্য লতিফের সমালোচনা করেন মহাজোট নেতারা। এতে বলা হয়,  এমএ লতিফ এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। এর কিছুদিন পর সিমেন্ট ক্রসিংয়ে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তার গায়ে হাত তোলেন। তার কর্মকাণ্ডে দলের সবাই বিব্রত।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইনামুল হক দানু বলেন, ‘তিনি আমাদের সংসদ সদস্য হতে পারেন। কিন্তু তার প্রাথমিক সদস্যপদও নেই। তাকে আবারও দলের সব ধরনের কর্মকাণ্ডে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছি। এও বলছি আওয়ামী লীগের ভেতরে থেকে তার অবস্থান দলের কাছে পরিষ্কার নয়।’

No comments

Powered by Blogger.