বিসিকের ৫৫ বছর পূর্তি by আবু তাহের খান

১৯৫০-এর দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চাৎপদ অর্থনীতির দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের একটি ছিল বৈষম্য এবং অপরটি ছিল কৃষির ওপর অতিনির্ভরতা। বৈষম্যের বিষয়টি মোকাবিলার উদ্যোগ রাজনীতিকরাই গ্রহণ করেছিলেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় আসে আমাদের ১৯৭১-এর স্বাধীনতা।


অন্যদিকে কৃষির ওপর অতিনির্ভরতার দুর্বলতাকে কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিমালায় শিল্পোন্নয়নকে অগ্রাধিকার দানের বিষয়টিও তখন শেষ পর্যন্ত বৈষম্যের নিগড়েই আটকা পড়ে। দেখা যায় শিল্পোন্নয়নকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাদানের বিষয়টিও ক্রমান্বয়ে পক্ষপাতমূলকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হচ্ছে অধিক হারে। এমনি প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালে তৎকালীন সরকারের শ্রম, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক আইন পরিষদ পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (ইপসিক) বিল উত্থাপন করেন, যা ঐ বছরেরই ১৪ মার্চ পাস হয় এবং একই বছরের ৩০ মে থেকে তা কার্যকর হয়। সে হিসাবে ইপসিক-এর উত্তরসূরি প্রতিষ্ঠান হিসাবে এ বছর বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) ৫৫ বছর পূর্ণ হলো।
দীর্ঘ ৫৫ বছরের পথপরিক্রমায় বিসিকের দায়িত্ব ও কর্মকা-ের পরিধি সবসময় যেমন একই রূপ ছিল না, তেমনি এসব দায়িত্ব ও কর্মকা- সম্পাদন করতে গিয়ে তার দক্ষতা ও সাফল্যের মাত্রাও সব পর্যায়ে একইভাবে প্রতিভাত হয়নি। তবে অপরিহার্য মৌলিক প্রাত্যহিক সেবার সাথে সম্পর্কিত কোন প্রতিষ্ঠান না হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী পরও যে এটি তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে টিকে আছে, সেটি নিঃসন্দেহে তার ব্যাপক কর্মদক্ষতারই পরিচয় বহন করে।
শুরুতে বিসিকের কাজ ছিল বস্তুত এ দেশে শিল্পায়নের একটি প্রাথমিক ভিত্তি গড়ে তোলা। আর তা করতে গিয়ে সে সময়ে বিসিক যে কাজগুলোতে হাত দেয় তার মধ্যে অন্যতম ছিল নিজস্ব তহবিল থেকে এবং ব্যাংকের সঙ্গে কনসোর্টিয়াম গঠনের মাধ্যমে শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ঋণদান, উদ্যোক্তাদের শিল্পপণ্যের নকশা সরবরাহ করা, শিল্পনগরী স্থাপন করে সেখানে উদ্যোক্তাদের প্লট বরাদ্দদান, লবণ উৎপাদনে চাষিদের প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান ইত্যাদি, যেগুলো এখনও নানা আদলে অব্যাহত আছে। পরবর্তীতে এসবের সঙ্গে যুক্ত হওয়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কর্মকা-ের মধ্যে রয়েছে শিল্প কাঁচামাল আমদানি ও স্বতন্ত্র ঋণ কর্মসূচী গ্রহণ, ব্যাপক পরিসরে উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ট্রেডভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান, শিল্প সহায়তার অংশ হিসাবে দেশব্যাপী মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন, আঞ্চলিক প্রয়োজন ও সম্ভাবনাভিত্তিক কর্মসূচী গ্রহণ ইত্যাদি।
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৮০-র দশকের আগস্ট পর্যন্ত সদর দফতরের বাইরে বিসিকের মাঠ পর্যায়ের কর্মকা- ছিল মূলত শিল্পনগরীকেন্দ্রিক এবং এ শিল্পনগরীর সংখ্যাও ছিল মাত্র ২০টি, আর এগুলোর অবস্থান ছিল শুধু বৃহত্তর জেলাগুলোতে। ১৯৮০-র দশকের গোড়াতে এসে এ ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় এবং দেশের ৬৪টি জেলার প্রতিটিতে বিসিকের একটি করে ‘শিল্প সহায়ক কেন্দ্র’ স্থাপিত হয় এবং দেশব্যাপী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের একটি সম্প্রসারিত ভিত্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এ জেলা কার্যালয়গুলোই হয়ে দাঁড়ায় আগ্রহী শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রধান ভরসাস্থল।
বিসিকের শিল্পনগরী কর্মসূচী ১৯৬০-এর দশক থেকেই বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। জুন ২০১১ পর্যন্ত সারাদেশে স্থাপিত বিসিকের ৭৪টি শিল্পনগরীতে ইতোমধ্যে ৪,৪১৮টি শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে এবং সেসব কারখানা থেকে বছরে প্রায় ২৯,০২৮ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, যার মধ্য থেকে রফতানি হচ্ছে প্রায় ১৬,৬৬০ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী। আর এ কারখানাগুলো সরকারকে বছরে প্রায় ১,৪৮৩ কোটি টাকার রাজস্ব পরিশোধ করে থাকে।
বিসিকের সহায়তায় লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশ ইতোমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। লবণের ১৪.৫০ লাখ মেট্রিক টন বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে দেশে প্রতিবছরই প্রায় সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। অন্যদিকে আয়োডিন ঘাটতিজনিত রোগব্যাধি মোকাবিলায় ইউনিসেফের সহায়তায় বিসিক দেশের ২৬৭টি লবণ মিলের সব ক’টিতে ইতোমধ্যে আয়োডিন সংমিশ্রণ প্ল্যান্ট (এসআইসি) স্থাপনে সক্ষম হয়েছে এবং এর ফলশ্রুতিতে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে আয়োডিন ঘাটতির পরিমাণ ১৯৯৩ সালের ৬৮.৯০ শতাংশ থেকে ২০০৬ সালে ৩৩.৮০ শতাংশে মেনে এসেছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিসিক কর্তৃক পূর্বে শুরু করা কর্মকা-ের সঙ্গে আর যে সব নতুন কর্মসূচী যুক্ত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও দক্ষতা উন্নয়কবিষয়ক প্রশিক্ষণদান, সাব-কন্ট্রাক্টিং পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্পের মধ্যে অগ্র ও পশ্চাৎ সংযোগ স্থাপন, প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থ শিল্পে বিনিয়োগের ব্যবস্থাকরণ, আধা-নিবিড় প্রক্রিয়ায় চিংড়ি চাষ, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌচাষ ইত্যাদি। এসব কর্মকা- এখন বিসিক ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিসিকের মূল সাফল্য এই যে, শুরুটা সে-ই করে দেখিয়েছে।
শিল্পোদ্যোক্তা বা কারুশিল্পী হিসাবে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারেও বিসিক উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং জেনে খুশি হবার মতো ঘটনা এই যে, সারাদেশে বিসিক এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ লাখ নারী শিল্পোদ্যোক্তা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তদুপরি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মরত কারিগর, কারুশিল্পী ও শ্রমিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও হচ্ছে নারী, যা এ প্রতিষ্ঠানের নারীর ক্ষমতায়নসংশ্লিষ্ট কর্মসূচীরই ফলশ্রুতি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ১৯৭৪ সাল থেকেই বিসিক অত্যন্ত দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে একাধিক বিশেষ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে আসছে। বিসিকের এসব কর্মসূচীর মাধ্যমে সেখানকার আদিবাসী ও অন্যান্য জনগোষ্ঠী এতটাই উপকৃত হয়েছেন এবং হচ্ছেন যে, সেখানে মাঝে মাঝেই যখন ছোটখাটো জাতিগত অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখনও তাদের আচরণে বিসিকের কর্মকা-ের প্রতি এক ধরনের নৈকট্য ও সহানুভূতি চোখে পড়ে। দহগ্রাম-আঙ্গুরপোতার ন্যায় প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিটমহলের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যেও বিসিক কাজ করে যাচ্ছে।
একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ৫৫ বছর পূর্ণ হওয়া নিঃসন্দেহে একটি অনেক বড় জাতীয় ঘটনা এবং অবশ্যই তা গৌরবেরও। তবে সে গৌরবকে অধিকতর অর্থবহ করে তুলতে হলে প্রায় এর ৫৪ বছরের অভিজ্ঞতার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একে আরও বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ ও প্রয়োজন দুই-ই রয়েছে। আর সীমিত ভূমি ও বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে কৃষি ও সেবাখাত নির্ভরতার গ-ি থেকে বের করে এনে একটি শক্তিশালী শিল্পভিত্তিদানের লক্ষ্যে সে সুযোগ ও প্রয়োজনকে পরিপূরণের কোনই বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক ও বিসিকের কর্মীবাহিনী যদি বিষয়টিকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করে একে একটি আধুনিক, দক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানদ-ে গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে পারেন, তাহলেই কেবল এর ৫৫ বছর পূর্তির এ ঘটনাটি তাৎপর্যময় ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক : পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)।
atkhan56@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.