পশ্চিমবঙ্গে মমতা, বাংলাদেশে খালেদা কি একই ভুল পথের যাত্রী? by আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

বাংলায় একটা কথা আছে ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী’ এটা রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের বেলাতেও সত্য। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী হঠাৎ ফুলুকে রাজ্যের নির্বাচনে বামফ্রন্টকে ধরাশায়ী করতে পারায় এতোটাই মোটা মাথা হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি নিজেকে রাতারাতি দিল্লীশ্বরী ভাবতে শুরু করেছিলেন।


দিল্লীর অবাঙালী বুরোক্র্যাসি সহজেই তাকে তিস্তার পানি ও টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদির ব্যাপারে প্রতিবেশী বাংলাদেশের স্বার্থ ও অধিকার নিয়ে টালবাহানা করার কাজে ব্যবহার করতে পেরেছেন এবং এখন আবার ভারতের রাষ্ট্রপতির পদে প্রার্থী নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি কংগ্রেসেরই পাতা ফাঁদে পা দিয়ে একেবারে সাইজ হয়ে যাচ্ছেন।
মমতা ব্যানার্জীর দম্ভ এবং ইগোতে বাতাস সিঞ্চন করছিল আমেরিকা। বর্তমান বিশ্বের একক সুপার পাওয়ার আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন তার সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের সময় মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন একেবারে কলকাতায়। উদ্দেশ্য, ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাত পাওয়া। এই সাক্ষাতের ব্যাপারেও মমতা ব্যানার্জী তার শিষ্টাচার ও সুশিক্ষার অভাবের প্রমাণ দিয়েছেন। দম্ভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমি হিলারির সঙ্গে দেখা করতে চাইনি। হিলারিই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।’
হিলারি-মমতা এই সাক্ষাতকার সম্পর্কে আমাদের বাংলাদেশী এক কূটনীতিকের (সাবেক) একটি লেখা পড়েছি ঢাকার একটি দৈনিকে। তার মতে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই এশিয়া সফরের সময় ভারতের একটি কম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও মমতা ব্যানার্জী যে গুরুত্ব পেয়েছেন একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও শেখ হাসিনা সেই গুরুত্ব পাননি। ইঙ্গিতে যে কথাটি তিনি বলার চেষ্টা করেছেন তাহলো রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে হাসিনার চাইতে মমতা বেশি কৌশলী ও সফল।
এই সাবেক কূটনীতিক স্বল্পশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত নন। তার বিদ্যাবুদ্ধি ‘ভয়ঙ্করী’ হওয়ার কথা নয়। তথাপি তিনি একটা ভয়ঙ্কর ভুল করেছেন। হিলারি ঢাকায় এসেছিলেন তার বন্ধু ড. ইউনূস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে শুরু করে আমেরিকার অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন কোন বিষয়ে হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে নতি স্বীকার করাতে। তিনি তা সর্বোতভাবে পারেননি। একটি মার্কিন সাহায্যনির্ভর ছোট দেশের কম প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তথাপি একটি সুপার পাওয়ারের চাপের মুখে তিনি যতটা সম্ভব নিজের এবং দেশের মর্যাদা রক্ষা করেছেন।
অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জী ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি ছোট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তিনি রাজনীতিতে কট্টর ডানপন্থী এবং চরিত্রে সুবিধাবাদী। (তিনি কখনও কংগ্রেস, কখনও বিজেপির দিকে চলেন) ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতের একটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন বাম তথা কমিউনিস্ট সরকারকে তিনি নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটিয়েছেন, এমন কি দিল্লীতে পাগড়িধারী মনমোহন সরকারের দুর্বলতার সুযোগে সেই সরকারের ওপরও প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা কি হোয়াইট হাউস ও পেন্টাগনের কাছে কম কথা? এই মমতাকে দিল্লীতে ক্ষমতায় বসাতে পারলে আমেরিকাকে আর পায় কে? মনমোহন সরকার তাদের হাতের মুঠোর ভেতরে অর্ধেক ঢুকে আর ঢুকতে চায় না। মমতাকে কোনভাবে দিল্লীতে ক্ষমতায় বসাতে পারলে ভারত ষোলো আনা থাকবে ওয়াশিংটনের হাতের মুঠোয়।
সন্দেহ নেই, হিলারির মমতা-দর্শনের নেপথ্যে এটাও একটা বড় কারণ। তিনি প্রোটোকল না ভাঙলেও তার সাধারণ নিয়ম উপেক্ষা করে মমতা ব্যানার্জীর কাছে গিয়ে যে উপস্থিত হলেন, সম্ভবত তার একটা কারণ, ভারতের মানুষের কাছে মমতার গুরুত্ব বাড়ানো। তাদের বোঝানো, মমতাকে আমেরিকা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নেত্রী মনে করে না, সম্ভাব্য ভারত নেত্রী মনে করে। মমতাকেও সম্ভবত হিলারি যাচাই করে গেলেন যে, তাদের মদদ পেলে দিল্লীশ্বরী হতে মমতা কতটা সহজে সক্ষম হবেন? কলকাতায় ক্ষমতা দখলেও মমতা মার্কিন মদদ পেয়েছেন। দিল্লীর ক্ষমতা দখলেও মার্কিন মদদ লাভের প্রচ্ছন্ন আশ্বাস মমতা এই সাক্ষাতকারে পেয়ে থাকলে বিস্ময়ের কিছু নেই।
সুতরাং হাসিনা ও মমতার সঙ্গে হিলারি ক্লিনটনের সাক্ষাতকার মোটেও তুলনীয় নয়। বাংলাদেশে তিনি এসেছিলেন মার্কিন আধিপত্যের স্বার্থ উদ্ধারে এবং বন্ধুর ব্যাংক পুনর্দখলের ক্যাম্পেই যে সহায়তা দিতে চাপ সৃষ্টির কাজে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তিনি গিয়েছিলেন, ভারতের রাজনীতিতে একজন অনুগত মাদামের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পেছনে শক্তি যোগানো যায় কিনা সম্ভবত তা যাচাই করতে।
আগেই বলেছি ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী।’ পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জী তার সঙ্গে হিলারির এই ছুটে এসে সাক্ষাতের ব্যাপারটিকে কাজে লাগাতে পারেননি। রাজ্য নির্বাচনে বিশাল বিজয় তার মাথা এতটাই ভারি করে ফেলেছে যে, তিনি প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা, টিপাইমুখ বাঁধ, এমনকি ফারাক্কার পানির হিস্যার প্রশ্নেও পায়ে পা ঠেকিয়ে ঝগড়া বাধিয়েছেন এবং দিল্লীর সঙ্গে খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশী বিনিয়োগ পেনশন বিল, রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী নির্বাচন ইত্যাদি ব্যাপারে যে খেলা খেলতে চেয়েছেন, নিজের সেই খেলার ফাঁদে নিজেই পড়েছেন।
মমতা ও তৃণমূলের ঘোর সমর্থক বলে কলকাতার যে দৈনিক স্টেটসম্যান কাগজটি পরিচিত, তার সম্পাদক মানস ঘোষ স্বনামে লিখিত এক নিবন্ধে মমতার তীব্র সমালোচনা করেছেন। ‘... মমতা আজ আত্মঘাতী পথে’ শীর্ষক এক নিবন্ধে (১৭ জুন রবিবার, ২০১২) মানস ঘোষ লিখেছেন, ‘মমতা যেভাবে কংগ্রেসের আনা তিস্তা চুক্তি, খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশী বিনিয়োগ, পেনশন বিলের বিরোধিতা করছেন, তাতে সোনিয়া-মনমোহনরা ও দেশের কর্পোরেট কর্তারা রীতিমতো ক্ষুব্ধ। মমতা তাদের কাছে চক্ষুশূল। কৌশলে তাকে প্যাঁচে ফেলে কীভাবে ইউপিএ জোট থেকে বাদ দেয়া যায় সেই হিসাবই তারা এতদিন কষে এসেছেন। সেই উদ্দেশ্যে তারা তার জন্য নানা রকম ফাঁদ পেতে রেখেছেন। মমতা তার রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতায় সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন।’
এটা তো গেল পশ্চিমবঙ্গের কথা। বাংলাদেশের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, এদেশেও মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে অনেকটা তুলনীয় একজন রাজনৈতিক নেত্রী আছেন। তিনি খালেদা জিয়া। মমতা ব্যানার্জীর মতো তিনিও ২০০১ সালে হঠাৎ এক ফুলুকে (মমতার মতো স্বোপার্জিত জনপ্রিয়তায় নয়) এক বিশাল নির্বাচন-বিজয়ের অধিকারী হয়েছিলেন। সেই বিজয় তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। নিজের রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতায় সেই বিজয়ের ফসল তিনি ধরে রাখতে পারেননি। তিনিও দেশের কর্পোরেট কর্তা, অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাসি এবং একটি বিদেশী গোয়েন্দা চক্রের খপ্পরে পড়ে তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন এবং তাদের পাতা ফাঁদে বার বার পা দিচ্ছেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনী পরাজয় থেকে তিনি কোন শিক্ষা নেননি। সেই পুরনো রাজনৈতিক সেøøাগান এবং জামায়াত ও ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদেরসহ নিন্দিত রাজনৈতিক সহচরদের নিয়ে রাজনীতির মাঠ আবার গরম করার চেষ্টা করছেন। আশা করছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সরকারকে তাদের দাবি মানতে তিনি বাধ্য করতে পারবেন এবং আগামী নির্বাচনে সহজ বিজয় অর্জন করে বিদেশে পলাতক (চিকিৎসার নামে) পুত্রদের দেশে ফিরিয়ে এনে ক্ষমতায় বসাতে পারবেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি এবং ভারতের প্রণব মুখার্জীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাদের সাক্ষাতকার এবং বিশেষ করে ভারতের সমর্থন সম্পর্কে প্রণব মুখার্জীর আশ্বাস দান খালেদা জিয়াকে আরও উৎসাহিত করেছে। কিন্তু তিনি এবং তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা এ কথা অনুধাবনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন যে, জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে বিএনপি খাপ খাওয়াতে পারছে না। দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতাগুলো বিএনপিকে নির্বাচন-বিজয় এনে দেবে না। বিজয় এনে দেবে গণজীবনের আশা-আকাক্সক্ষার সম্পূরক কর্মসূচী। সেই কর্মসূচী তারা গ্রহণ করতে পারেনি। এমন কি পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন না দেয়ার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডা জনমনে অনুকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। তাদের সাম্প্রতিক সব আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কারণ একটাই। সঠিক কর্মসূচী গ্রহণ না করা এবং তাতে স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থনের অভাব।
পুরনো ভারত-বিদ্বেষী প্রচার, দেশ বিক্রির সেøাগান দ্বারা কোন কাজ হবে না। বিদ্যুত, পানি, গ্যাস, যানজট, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য অতীতে এসব সমস্যা সমাধানে বিএনপি কোন সাফল্য দেখায়নি, ভবিষ্যতে কিভাবে দেখাবে তার বাস্তব কর্মসূচী জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। নইলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোট পাবে না, ত্রিশটি আসনও পাবে না এসব বাগাড়ম্বর করে কোন লাভ হবে না। বাগাড়ম্বর দ্বারা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় গিয়ে মমতা এখন বিপাকে। তার পায়ের তলা থেকে দ্রুত মাটি সরে যাচ্ছে। দেশ শাসনে বিএনপির যা অতীত রেকর্ড, তাতে কেবল বাগাড়ম্বর দ্বারা তারা আগামী নির্বাচনে জয়ী হবেন, সে আশা না করাই ভাল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিএনপির মিত্র সৌদি আরব ও পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর এখন যা অবস্থা, তাতে তাদের মদদই বা বিএনপিকে কতটা শক্তি যোগাবে।
লন্ডন, ১১ জুলাই বুধবার ॥ ২০১২

No comments

Powered by Blogger.