আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৮৪)-সবাই ঢাকা যেতে উন্মুখ by আলী যাকের

ভাবতে অবাক লাগে যে যখন এই কাজগুলো করেছিলাম, তখন আদৌ মনে করিনি যে এর কোনো সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য আছে। তখন মনে ছিল এক অদম্য মুক্তির স্পৃহা, যার ফলে যে কাজই হাতে এসেছে, ঝাঁপিয়ে পড়েছি। ওই সব কাজের কোনো তথ্যপ্রমাণ যে রাখতে হয় বা রাখতে হবে তা কখনোই ভেবে দেখা হয়নি।


যখন এ ধরনের কাজ করা হয়, তখন মানুষ নিতান্ত প্রাণের টানেই তা করে। কখনো ভেবেও দেখে না যে এই কাজের বিনিময়ে কোনো দিন কোনো স্বীকৃতি পাওয়া যেতে পারে। তাই যুদ্ধ শেষে আমি আমার লেখা সব কাগজপত্র এবং অডিও টেপ কর্তৃপক্ষের হাতে নির্দ্বিধায় তুলে দিয়েছিলাম। এখন অনেকেই বলে যে আজ ওগুলো থাকলে অনেক কাজে আসত। আর কিছু না হোক, নিদেনপক্ষে আর্কাইভে ওগুলো জমা থাকত হয়তো। হয়তো ভুল করেছি; কিন্তু তা নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। যুদ্ধ শেষের পাওনা চাওয়ার মতো মনোবৃত্তি তখন বেশির ভাগ বাংলাদেশির ছিল না। অথচ এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আমাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে কী পেলেন? জবাবে আমি বলি, আমার মা যখন আক্রান্ত হয়, তখন সেই দুষ্কৃতীর কাছ থেকে মাকে উদ্ধার করা আমি আমার কর্তব্য বলেই মনে করি। বাংলাদেশ আমার কাছে মায়ের মতো। ওই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমি আমার মাকে ফিরে পেয়েছি। অতএব, আমার কর্তব্যের বিনিময়ে কিছু চাওয়ার কথা আমার কখনো মনে আসেনি।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তারা দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিল, পাকিস্তানিদের বিতাড়ন করতে চেয়েছিল। অথচ তারা কেউই যুদ্ধ শেষের পাওনা চায়নি। কিন্তু আমাদের এই হতভাগা দেশে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা যুদ্ধ শেষের পাওনার লোভে হানাহানি শুরু করেছে সেই সত্তরের দশকের মাঝ থেকেই এবং এখনো তাদের লোভের অন্ত নেই। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে তারা। কী করে, কোন উপায়ে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করা যায়।
ওই সময় ডা. নৃপেন সেন, ইলা মিত্রের অনুজ, কলকাতার পিজি হাসপাতালের বড় ডাক্তার ছিলেন। আগেই বলেছি যে বাংলাদেশের শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই নৃপেনদার আনুকূল্যে পিজিতে নানা রকম রোগ-জরায় সুচিকিৎসা পেয়েছেন। সময় পেলেই আমি নৃপেনদার মনোহর পুকুর রোডের বাড়িতে যেতাম। তিনি প্রখ্যাত ডাক্তার হলেও বন্ধুবান্ধবের জন্য সময়ের ঘাটতি ছিল না তাঁর। অসাধারণ বিশ্লেষণী শক্তি ছিল যেকোনো রাজনৈতিক বিষয়ে। আজ ভাবতে অবাক লাগে যে হঠাৎ করেই নৃপেনদা আমাকে একবার আনমনে বলেছিলেন, 'যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে যখন ফিরে যাবে, ভেবো না সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তোমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। অতএব, তোমাদের আরো অনেক সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।'
দেখতে দেখতে নভেম্বর মাস চলে এলো। কলকাতায় কখনোই ঢাকার মতো শীত পড়ত না সেই সময়। তা ছাড়া আমাদের কাজের পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে শীত কি গ্রীষ্ম, সে কথা ভাবারও সময় পেতাম না। তখন একের পর এক বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে যুদ্ধের সব চমকপ্রদ খবর এসে পৌঁছত প্রতিদিন। প্রতিটি সেক্টরেই দুরন্ত গতিতে আমাদের দামাল মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে চলছিল। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ ফল ফলছিল আমাদের গেরিলা বাহিনীর অদম্য তৎপরতায়। ঢাকায় তখন ক্র্যাক প্লাটুনের ক্রমাগত আক্রমণে পাকিস্তানিরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় চোরাগোপ্তা হামলায় অনেক পাকিস্তানি সেনা মারা পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে অপারেশন, সেটা ঘটেছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের (বর্তমানে রূপসী বাংলা) মেইল টয়লেটে। এখানে এক্সপ্লোসিভ স্থাপন করে গোটা জায়গাটি উড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রচণ্ড শব্দে সারা শহর কেঁপে ওঠে সেই রাতে।
ইতিমধ্যে ২৩ অক্টোবর একটি যুদ্ধ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত থাকার সময় ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ কপালে সরাসরি গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে সেনা হাসপাতালে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর হায়দারকে। এর কিছুদিন পর ১৪ নভেম্বর ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর তাহেরের একটি পা অ্যান্টিপার্সোনেল মাইনে উড়ে যায়।
এ ধরনের খবরাখবর যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে আসতে থাকে। মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়, আবার পরমুহূর্তেই বিরাট একটা জয়ের খবরে উজ্জীবিত হই। নভেম্বর মাসেই আমরা বুঝতে পারছিলাম যে যেই গতিতে আমরা এগোচ্ছি, যুদ্ধজয় কেবল অবশ্যম্ভাবীই নয়, বোধ হয় বেশি দূরেও নয়। ওই সময় প্রতিটি সকাল এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ধরা পড়ত আমাদের কাছে। আমরা সকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ শুরু করার আগেই কেন্দ্রের কাছাকাছি একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটির খুলিতে চা খেতাম আর যুদ্ধের নানা দিক নিয়ে কথাবার্তা হতো। এই সময় একদিন দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়েছি শামসি রেস্তোরাঁ থেকে। দেখা হলো মামুনুর রশীদের সঙ্গে। মামুন তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটার পর একটা নাটক কিংবা নকশা লিখে চলেছে। কথা প্রসঙ্গে ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, বিজয় তো সন্নিকটে, দেশে ফিরে গিয়ে কী করব? কোনো কিছু না ভেবেই বললাম, স্টেজে নাটক করব। মামুন বলল, তারও সেই রকম ইচ্ছা। ইতিমধ্যে আমাকে একাধিকবার ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন সাব-সেক্টরে ঘুরে আসতে হয়েছে যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য। সব রণক্ষেত্রেই দেখেছি, আমাদের অকুতোভয় যোদ্ধারা যেন এক নতুন উদ্দীপনায় ভর করে একের পর এক সফল অপারেশন চালিয়ে ডেরায় ফিরছে, প্রতি সকাল কি সন্ধ্যায়। ওদের কথাবার্তায় মনে হয় ওদের আত্মপ্রত্যয় বহুগুণ বেড়ে গেছে। সবাই ঢাকা যেতে উন্মুখ।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.