স্মরণ-ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ by তামান্না ইসলাম অলি

একজন মানুষ একই সঙ্গে ছাত্র ও শিক্ষক। আমৃত্যু শিখেছেন এবং শিখিয়েছেন। ভাষার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। বইপাগল তো ছিলেনই, জানতেন ২২টিরও বেশি ভাষা। পাঠশালার পণ্ডিতমশাইরা ডাকতেন 'সিরাজউদ্দৌলা'। বাড়ির সবাই আদর করে ডাকতেন 'সদানন্দ'।


আর নিজেই নিজের নাম রেখেছিলেন 'জ্ঞানানন্দ সংগ্রামী'। তিনি আর কেউ নন, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। নিজের রাখা নামটাই সার্থক হলো তাঁর। আজ ১৩ জুলাই এই মহামনীষীর মৃত্যুদিন। ১৯৬৯ সালের এই দিনে তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের অবসান ঘটে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই চবি্বশ পরগনার পেয়ারা গ্রামে জন্ম নেন। বাবা মফিজ উদ্দিন এবং মা হরুন্নেছা খাতুন। বাবা ছিলেন ইংরেজ আমলের সরকারি জরিপ বিভাগের কর্মকর্তা। মায়ের ছিল পড়াশোনার প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক।
তাঁর পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় বাড়িতেই। এরপর হাওড়ার একটি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। ইংরেজি স্কুলে থাকতেই তিনি শিখেছিলেন আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও উড়িয়া ভাষা। ১৯১০ সালে কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে বিএ পাস করেন। অনার্সসহ বিএ পাস করা তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি মুসলমান। এরপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯২৬ সালে উচ্চশিক্ষা নিতে যান ইউরোপে। ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ ক্ষেত্রেও তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান। এরপর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত এবং বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত এখানেই বিভিন্ন বিভাগে কাজ করে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু অবসর কাটানোর মানুষ তিনি নন। তাই আবারও বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন।
ভাষা আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলে গিয়েছিলেন। পুলিশের হামলায় আহতও হয়েছিলেন। স্বদেশি আন্দোলনেও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। এ সময় থেকেই তিনি বিদেশি কোট-প্যান্ট পরা ছেড়ে দেন। শুরু করেন দেশি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা।
শিশুদের ভালোবাসতেন খুব। তাই তাদের জন্য বের করেছিলেন 'আঙ্গুর' নামের একটি পত্রিকা। সেখানে শিশুদের জন্য মজার মজার লেখা থাকত, যা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন লোকসাহিত্যিক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন। শিক্ষার্থীদের ব্যাকরণ বুঝতে যাতে কষ্ট না হয়, তাই তাদের জন্য প্রথম সহজবোধ্য 'বাংলা ব্যাকরণ' লেখেন। এ বই পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুশি হয়ে তাঁকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। বইটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর শান্তিনিকেতনের অধ্যাপকদের দেন। এ বইটিই পরে সেখানকার পাঠ্যসূচিতে যোগ করা হয়। আমাদের আঞ্চলিক ভাষার ওপরও দখল ছিল তাঁর। তাই ১৯৬৫ সালে লেখেন 'বাংলা ভাষার আঞ্চলিক ভাষার অভিধান'। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বাংলা ভাষা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী। এর নামটাও তাঁরই দেওয়া। তাঁর নামেই ঢাকা হলের নাম বদলে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল। তাই আজ তাঁর মৃত্যুদিনে আমরা তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
তামান্না ইসলাম অলি

No comments

Powered by Blogger.