শেকড়ের ডাক-জ্ঞানীরা আমাদের ধন্দে ফেলছেন কেন by ফরহাদ মাহমুদ

সময় থাকতে জ্ঞানার্জন করতে পারিনি। সে জন্য অসময়ে বা অবেলায় এসে মর্মপীড়ায় ভুগছি। সম্ভবত সেই পিপাসা থেকে আমার মতো আরো অনেকেই মধ্যরাতে টিভি চ্যানেলগুলো খুলে বসে থাকি। টক শো দেখি। মাঝেমধ্যে বক্তাদের পাণ্ডিত্য দেখে মুগ্ধ হই।


কত কঠিন কথা যে তাঁরা কত সহজ করে অবলীলায় বলে যেতে পারেন- ভাবতেও অবাক লাগে! কেবল কোনো একটি বিষয়ে নয়, অনেক বিষয়েই তাঁদের রয়েছে অফুরন্ত জ্ঞান। বর্তমানে সেই টক শোগুলোর প্রধান বিষয় হচ্ছে পদ্মা সেতু। সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়নসংক্রান্ত চুক্তিটি বাতিল করে দিয়েছে। আর তা নিয়ে আমাদের বিদগ্ধ ও জ্ঞানীসমাজ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একেবারেই বিপরীত মেরুতে তাদের অবস্থান। জ্ঞানীসমাজের একাংশ বলছে, যেকোনো উপায়েই হোক বিশ্বব্যাংককে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ তাদের ঋণের সুদের হার অনেক কম। তা ছাড়া তারা তো কেবল পদ্মা সেতু নয়, আরো অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উন্নয়নের গতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আরেক অংশ বলছে, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের বিদায় নেওয়াটা আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ এই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির মতো কয়েকটি আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের এ ঋণকে কিছু উন্নত দেশ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তারা অষ্টধাতুর তাবিজটা বিনা মূল্যে দিলেও তাবিজের ভেতরে থাকা এলেমের হাদিয়া হিসেবে যা নেয়, তা সুদের তুলনায় অনেক বেশি। অসম চুক্তিতে তেল-গ্যাস-কয়লাসহ আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে দিতে হয়। দেশ ও মানুষের স্বার্থবিরোধী অনৈতিক হুকুম তামিল করতে হয়। অনেক সময় সামরিক উপস্থিতিও মেনে নিতে হয়। বিশ্বব্যাংকের পক্ষের পণ্ডিতরা বলছেন, নিজের অর্থে পদ্মা সেতু করার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। অন্য অংশ বলছে, বাংলাদেশের একটি নয়, পাঁচটি পদ্মা সেতু করার সামর্থ্য রয়েছে। জ্ঞানীসমাজের অতি মূল্যবান এসব কথা শুনে আমরা তো রীতিমতো ধন্দে পড়ে গেলাম। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা- কিছুই বুঝতে পারছি না।
অবেলায় জ্ঞানের পিপাসা- হার মানলে হবে কেন? ধন্দে যখন পড়েছি, সেই ধন্দ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতে দোষ কি? পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট ও বইয়ের দ্বারস্থ হলাম। দেখি, কে কোথায় কী বলছেন। সেখানে গিয়ে আরো বেশি ধন্দে পড়লাম। পত্রপত্রিকার বড় বড় উপসম্পাদকীয়, নিবন্ধগুলোর বক্তব্যও পরস্পরবিরোধী। আর শুধু আমাদের দেশের জ্ঞানীসমাজই নয়, বিদেশের বড় বড় পণ্ডিত ব্যক্তিও বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে এমনই বিপরীত মেরুতে থেকেই কথাবার্তা বলছেন। কেউ বলছেন, বিশ্বব্যাংক হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ত্রাণকর্তা। বিশ্বব্যাংক আছে বলেই সেসব দেশের মানুষের নানামুখী কল্যাণ হচ্ছে। অন্যরা বলছেন, বিশ্বব্যাংক যেসব দেশে গেছে এবং যেসব দেশের সরকার বিশ্বব্যাংকের কথা শুনেছে, সেসব দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, অর্থনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। হায় আল্লাহ! কার কথা শুনি?
আগেই বলেছি, যাঁরা এসব কথা বলছেন তাঁদের সবাই বিদগ্ধজন, জ্ঞানের ভাণ্ডার। আমি সেসব জ্ঞানী ব্যক্তির, বিশেষ করে দেশের জ্ঞানী ব্যক্তিদের নাম নিতে চাই না। কারণ কে জানে, মূর্খতার কারণে কোথায় আবার কার অসম্মান করে ফেলি। যুক্তরাষ্ট্রের একজন পণ্ডিত ব্যক্তির নাম জোসেফ ই স্টিগলিৎস। তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া একজন অর্থনীতিবিদ। তিনি একসময় বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন। বিশ্বব্যাংকে থাকাকালেই তিনি বিশ্বব্যাংকের ঋণের কার্যকারিতার বিষয়ে কিছু সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেসব সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের বর্তমান নীতি ও কর্মকৌশল উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপকারে আসছে না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ফের পুঁজিবাদে ফিরে যাওয়া কয়েকটি দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, যে কয়টি দেশ বিশ্বব্যাংকের উপদেশ শুনে ঋণ নিয়েছে, তাদের অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। আর শুধু অর্থনৈতিক ধসই নয়, সেসব দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিনষ্ট হয়েছে। যেমন- আর্জেন্টিনায় একসময় ছয় মাসে পাঁচবার সরকার বদলের ঘটনা ঘটেছিল। যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেকজন পণ্ডিত ব্যক্তির নাম জন পারকিন্স। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) পিস কোরে এবং পরে ১৭ বছর কাজ করেছেন একজন ইকোনমিক হিট ম্যান হিসেবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বিবেকের তাড়নায় তিনি 'কনফেশন অব অ্যান ইকোনমিক হিট ম্যান' শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। বঙ্গানুবাদে বইটির শিরোনাম হয়েছে, একজন অর্থনৈতিক ঘাতকের স্বীকারোক্তি। এনএসএ বাছাই করলেও তাঁকে নিয়োগ দিয়েছিল মাইনার নামের একটি আমেরিকান করপোরেশন। এটি একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেই সুবাদে তিনি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পে বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ কেমন করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। কেমন করে উন্নত দেশগুলোর স্বার্থ হাসিলে ব্যবহৃত হয়। স্বার্থের পথে বাধা হলে কেমন করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার উৎখাত করা হয়। বহুজাতিক তেল কম্পানিগুলোর স্বার্থের পথে বাধা হওয়ায় কেমন করে পানামার জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ওমর টরিজো এবং ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট জেম রোলডসকে বিমান দুর্ঘটনার মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কেমন করে 'লোকাল জ্যাকলস' 'সুধী সমাজ' তৈরি করা হয়। বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে লোভনীয় চাকরির আগাম প্রস্তাব, বিদেশ ভ্রমণ, উৎকোচ প্রদান, অবসরজীবনে কনসালটেন্সির নিশ্চয়তা দিয়ে কিভাবে আমলাদের 'ম্যানেজ' করা হয়। রাজনীতিবিদদের কিভাবে বশীভূত করা হয়। জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য কিভাবে উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলকে কাজে লাগানো হয়। নীতিনির্ধারণী ও অন্যান্য বিষয়ে কথা বলার জন্য কিভাবে কিছু এনজিও তৈরি করা হয়- এমনি আরো অনেক বিষয়ই স্থান পেয়েছে বইটিতে।
কিন্তু কী লাভ? যত পড়ি, ততই ধন্দ বাড়ে। অবশেষে ধন্দ কাটানোর জন্য পরিচিত একাধিক পণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলি। হায় কপাল! কোথায় তাঁরা ধন্দ কমাবেন, তা না করে ধন্দে নতুন মাত্রা যোগ করে দিলেন। প্রথমে গেলাম বিশ্বব্যাংকের পক্ষে কথা বলেন এমন একজনের কাছে। তিনি স্বাধীনতার পর থেকে বিশ্বব্যাংক কত প্রকল্পে কী বিশাল পরিমাণ ঋণ দিয়েছে, ফলে দেশের কত উপকার হয়েছে, তার বিশাল ফিরিস্তি দিলেন। বুঝলাম বিশ্বব্যাংক সত্যিই বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রভূত সহায়তা করেছে। এরপর গেলাম পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের প্রস্থানকে যাঁরা আশীর্বাদ মনে করেন তেমন একজনের কাছে। তাঁর কথাগুলো হুবহু বলার ক্ষমতা আমার নেই, সেই জ্ঞানও আমার নেই। সেগুলো অনেকটা এ রকম- 'আপনি কি মনে করেন, সম্ভাব্য দুর্নীতির কারণেই পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে? কিংবা কিছু লোককে সরিয়ে দিলেই তাঁরা সন্তুষ্ট হয়ে অর্থ দিয়ে দিত? এমন মনে করাটা নির্বুদ্ধিতা। মন্ত্রী, সচিব ও প্রকল্প পরিচালককে তো সেতুসংশ্লিষ্ট দায়িত্ব থেকে সরানোই হয়েছিল। এর পরও বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হলো না কেন?' আমি লাজওয়াব। তিনি বললেন, "আসলে বিশ্বব্যাংকের এই গোসার অন্য কারণ আছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্ব কোনো বিদেশি মহাজনকে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। সেটি দেওয়া হয়নি। বঙ্গোপসাগরে নৌঘাঁটি স্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। গোপন-প্রকাশ্য চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রেও এ সরকার 'বন্ধুত্বের' মনোভাব প্রদর্শন করছে না। তাহলে বিশ্বব্যাংক কেন এ সরকারকে ঋণ দেবে?" আমার তো আক্কেল গুড়ুম। মনে দ্বিধা ও ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্বব্যাংকের সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে যেসব কথা বলছেন, সেগুলোই কি ঠিক? জবাবে হাসলেন তিনি। বললেন, 'বিশ্বব্যাংকের অডিট হয় কি না, জবাবদিহি আছে কি না, চুক্তি বাতিলের পেছনে কেউ আছে কি না অথবা উদ্দেশ্য কী- সাড়ে তিন বছর পরে এসে তাঁরা এ প্রশ্ন তুলছেন কেন? রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার আগেই তো এ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা বাঞ্ছনীয়। ঋণ না পাওয়াতে তাঁদের আপাতত যে বোধোদয় হয়েছে, সেই বোধোদয় কোনো স্থায়ী বোধোদয় নয়।' আমি আর কোনো কথা না বলে সালাম জানিয়ে বিদায় নিয়েছিলাম।
কথায় বলে, 'সুখে থাকতে ভূতে কিলায়'। আমাদেরও হয়েছে সেই অবস্থা। কী দরকার ছিল এতসব চিন্তা করার কিংবা এমন ধন্দে পড়ার। এভাবে মনের শান্তি নষ্ট করে কী লাভ? এই মুহূর্তে ফরাসি দার্শনিক ভোলতেয়ারের গল্পের সেই ব্রাহ্মণের কথাটি মনে পড়ছে। এমনই এক প্রশ্নের জবাবে ব্রাহ্মণ বলেছিলেন, 'আমি জানি, আমার প্রতিবেশী বৃদ্ধা মহিলাটি দুনিয়ার কোনো কিছু না জেনে এবং শত অভাবের মধ্যেও বেশ সুখে আছেন। আমিও বারবার আমার মনকে সেভাবেই সুখী হতে বলেছি। কিন্তু মন যে সেভাবে সুখী হতে চায় না।' আসলে এটি কিছু মনেরই বৈশিষ্ট্য। এই মন প্রশ্নহীন, উত্তরহীন সহজ শান্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.