সাঈদীর বিরুদ্ধে আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ-যুদ্ধাপরাধী বিচার

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় ১৫ সাক্ষীর জবানবন্দীকেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।


বৃহস্পতিবার বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ দেয়। একই সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা মোঃ হেলাল উদ্দিনকে আসামি পক্ষের আইনজীবী জেরা অব্যাহত রয়েছে।
অন্যদিকে একই অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষী মামা বাহিনী প্রধান শহীদুল হক মামার জেরা সম্পন্ন হয়েছে। ১৭ জুলাই পরবর্তী দুই সাক্ষী জবানবন্দী প্রদান করবেন। ভিকটিম উইটনেস হিসেবে দুই মাহিলা জবানবন্দী প্রদান করবেন। এ প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর মুহাম্মদ আলী বলেন, ১৭ তারিখ দুজন সাক্ষীর ক্যামেরা ট্রায়েল হওয়ার কথা থাকলেও হবে মূলত একজনের, একজনের জবানবন্দী গ্রহণ করা হবে। ওই দিন উভয় পক্ষের তিন-তিন করে ছয়জন আইনজীবী উপস্থিত থাকবেন। অন্য কাউকে গ্রহণ করেনি আদালত। বৃহস্পতিবার জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষীর জবানবন্দী দেয়ার কথা ছিল। ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযম এলেও কোন সাক্ষীকে আনা হয়নি। ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেছে রবিবার।
রিভিউ আবেদন খারিজ
জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া ১৫ সাক্ষীর জবানবন্দী, সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করেছে ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার আদেশে বলেছে, তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের নজির আরও রয়েছে। সিয়েরালিওন ও রুয়ান্ডায় আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য যে আদালত গঠিত হয়েছে, সেখানে এ বিধান রয়েছে। এ ছাড়া পুনর্বিবেচনার জন্য আসামিপক্ষ যে নথিপত্র ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে সেগুলো প্রমাণ করতে হবে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে তাঁরা সেটা করতে পারবেন। কিন্তু এ পর্যায়ে তাঁদের আবেদনের মেরিট (সারবস্তু) না থাকায় আবেদনটি খারিজ করা হলো।
ফলে তাদের জবানবন্দীই সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে। আদালতে এসে তাদের সাক্ষ্য দিতে হবে না কিংবা আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জেরার মুখেও পড়তে হবে না। এর আগে এ বিষয়ে কয়েক দফা শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে আদেশের জন্য সিএভিতে রেখে দেন। আজ ট্রাইব্যুনাল তার আদেশে আসামিপক্ষের ওই আবেদন খারিজ করে দেয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা
তদন্তকারী কর্মকর্তা এ এসপি মোঃ হেলাল উদ্দিনের জেরা অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যনত তিনি আসামি পক্ষের আইনজীবীরা ২৯ কার্যদিবস তাঁকে জেরা করেছে। বৃহস্পতিবার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আসামিী পক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম জেরা করেন। এ সময় প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী উপস্থিত ছিলেন। জেরার কিছু অংশনিম্নে দেয়া হলো। প্রশ্ন : হরেন ঠাকুরের ছেলেমেয়ে কয়টা।
উত্তর : একমাত্র ছেলে বিধান।
প্রশ্ন : হরেন ঠাকুরের স্ত্রীর নাম কি। তার বয়স কত।
উত্তর : ৭০। তিনি আসেন নি।
প্রশ্ন : কাকে দিয়ে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন।
উত্তর : নোটে নেই।
প্রশ্ন : উমেদপুর হিন্দুপাড়ায ’৭১ সালে বসতি সংখ্যা কত ছিল।
উত্তর : ২৫টি বাড়ি লুটপাট হয় ও তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
প্রশ্ন : ২৫টি বাড়ির মালিকের নাম কি।
উত্তর : (১) অনিল ম-ল, পিতা মৃত নকুল ম-ল, (২) শেখর, এবং তার ভাই মনি ঠাকুর, পিতা মৃত মোকেম ওরফে মুকুন্দ ঠাকুর, (৩) বিধান, পিতা- মৃত হরেন ঠাকুর, (৪) বিশা বালি ও সুখাবালি, পিতা- মৃত ললিত বালি, (৫) বিমল বালা, পিতা মৃত সতীশ বালা, (৬) জীবন, পিতা মৃত জহর তালুকদার, (৭) হরে কৃষ্ণ তালুকদার, পিতা সুধাংশু তালুকদার, (৮) মানিক, পিতা চিত্তরঞ্জন তালুকদার, (৯) উজ্জল, পিতা রবি তালুকদার, (১০) স্বপন, পিতা মৃত গৌরাঙ্গ তালুকদার, (১১) অতুল তালুকদার, (১২) সমীর তালুকদার, পিতা মৃত সুরেন তালুকদার, (১৩) সুশীল তালুকদার, (১৪) বীরেন্দ্র সিকদার, (১৫) নরেন্দ্র নাথ সিকদার, (১৬) অশোক ব্যাপারী, (১৭) নিরঞ্জন মাস্টার, পিতা মৃত নিরোদ তালুকদার, (১৮) রঘুনাথ সাহা (১৯) ধীরেন্দ্র নাথ সাহা। এগুলোর কথা নোটে আছে। বাকি ৬ জনের নাম নোটে নেই।
প্রশ্ন : একুশে টিভি প্রদর্শিত রঘুনাথ সাহা এবং এই রঘুনাথ সাহা কি একই ব্যক্তি?
উত্তর : একই।
প্রশ্ন : রঘুনাথ সাহার বয়স কত।
উত্তর : নোটে নেই।
কাদের মোল্লা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষী মামা বাহিনীর প্রধান সৈয়দ শহীদুল হক মামার জেরা শেষ হয়েছে। ১৭ এপ্রিল ভিকটিম উইটনেস এমন দু’জন জবানবন্দী প্রদান করবেন। তাঁদের নাম কৌশলগত কারণে এখানে উল্লেখ করা হলো না। এর আগে গত ৩ জুলাই প্রথম সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমেদ খান সাক্ষ্য দেন। বৃহস্পতিবার চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ মামা বাহিনীর প্রধান সৈয়দ শহীদুল হক মামার জেরা সম্পন্ন করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবী একরামুল হক তাঁকে জেরা করেন। এ সময় প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী উপস্থিত ছিলেন। নিম্নে তার জেরার অংশ বিশেষ দেয়া হলো।
প্রশ্ন : আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সালে ভর্তি হলেন।
উত্তর : ১৯৭৩ সালে।
প্রশ্ন : কাদের মোল্লার সঙ্গে কোন দিন সাক্ষাত হয়েছিল। হলে প্রথম কোন দিন।
উত্তর : পরিষ্কার বলেছি, ১৯৭০-এর নির্বাচনে গোলাম আযমের প্রার্থিতার পক্ষে কাদের মোল্লা কাছাবেঁধে কি কি করেছে রেকর্ড আছে। কোন দিন এটা নয়। ৭০ নির্বাচনে দেখেছি।
প্রশ্ন : কোন এলাকায়।
উত্তর : মিরপুর এলাকায়।
প্রশ্ন : উনাকে ৭০ সালে দেখলেন দাড়িপাল্লার পক্ষে, আপনি নৌকার পক্ষে। এখানে কাদের মোল্লার সঙ্গে মৌখিক কথা হয়নি। মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। দেখলে কথা হয়।
উত্তর : উত্তেজিত হয়ে সাক্ষী বলেন, এ বাংলায় মুসলমান হয়ে মুসলমানকে জবাই করেছে। কোন কুশল বিনিময় হয়নি।
প্রশ্ন : সেই সময় উনি কোথায় থাকতেন তা জেনেছেন।
উত্তর : জানি বাড়ি ফরিদপুরে। তবে দুয়ারিপাড়ায, মিরপুর-১২, মুসলিম ঈদগাহ সহ বিভিন্ন স্থানে দাড়িপাল্লার পক্ষে ক্যাম্পিং করেছেন।
প্রশ্ন : উনি মোহাম্মদপুর এবং মিরপুর এলাকায় ভাড়াটিয়া হিসেবে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন।
উত্তর : জানি না।
প্রশ্ন : এই সেই খালেক, উনি কি জীবিত আছেন।
উত্তর : জীবিত আছেন। বিউটি সিনেমা হলের মালিক।
প্রশ্ন : আমি সম্ভবত এই বার ২০১২ সালে ২১ মে বাংলাদেশে আসি।
উত্তর : মে বলিনি। জানুয়ারি বলেছি।
প্রশ্ন : ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসেন, পত্র পত্রিকা ও টিভিতে বিবৃতি দিয়েছেন।
উত্তর : বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বলেছেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমি সাক্ষাতকার দিয়েছি।
প্রশ্ন : বিটিভিতে একটা স্বাধীনতা বিষয়ে ২০/৪/২০১২ সাক্ষাতকার দিয়েছেন।
উত্তর : দিয়েছি।
প্রশ্ন : রাত ১১টায় প্রচার হয়েছে। তাঁকে আপনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় থাকতে পারে বলেছেন।
উত্তর : কত কথাই তো বলেছি। সব কথা মনে থাকে।
প্রশ্ন : ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত বর্ণনা দিয়েছেন।
উত্তর : অসংখ্য সাক্ষাতকার দিয়েছি। আমি রাষ্ট্রবিরোধী সাক্ষাতকার দিয়েছি।
প্রশ্ন : অতীব সত্য কথাই বলেছেন।
উত্তর : সত্য কথাই বলেছি। জীবনে মিথ্যা কথা বলিনি।
প্রশ্ন : আপনি ঐ যে ৭২ সাল থেকে ২০/৪/২০১২ তারিখ পর্যন্ত জাতীয় পত্রপত্রিকায় টিভিতে যা বলেছেন তা সবই সত্য কথা বলেছেন।
উত্তর : মনে পড়ছে না। মনে হয় সত্য কথা বলেছি। তবে সাংবাদিকরা কিছু বেশি লিখে ফেলে আবার কিছু অংশ বাদ দেন। আবার অতিরিক্ত লিখে ফেলেন। এর দায়দায়িত্ব আমার নয়।
প্রশ্ন : আপনার মুখ দিয়ে যে কথা বের হয় সেটাই সত্য।
উত্তর : মুখ না কান দিয়ে কথা বের হয়। অসংখ্য সাংবাদিকও অত্যাচারে মারা গেছে।
প্রশ্ন : তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে এর পূর্বে জবানবন্দী প্রদান করেছিলেন।
উত্তর : মনে হয় যে মামলার সাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছি সেটা রেকর্ড করা হয়েছে। সেটা ঐতিহাসিক দিন ছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ।
প্রশ্ন : কোথায় দিয়েছিলেন।
উত্তর : রূপনগর আমার বাসায়।
প্রশ্ন : ২৫ মার্চ একাত্তর সাল থেকে ৩১ জানুযারি ১৯৭২-এর মধ্যে আপনি যে সৈনিক ছিলেন পত্রপত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছিল তা ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছেন।
উত্তর : আমি জানি না। এরা যদি সংগ্রহ করে ট্রাইব্যুনাল দেয় সেটা তাদের ব্যাপার।
প্রশ্ন : ছবি পত্রিকায় উঠেছে।
উত্তর : সাংবাদিক কম নেয়নি। যখন সাংবাদিক এসেছে প্রাণ খুলে বলেছি। ছবি জমা দিয়েছে কিনা জানি না।
প্রশ্ন : এই জবানবন্দী দিচ্ছেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। আপনি তাকে কখনই দেখেননি।
উত্তর : এটা আপনার উক্তি।
প্রশ্ন : কাদের মোল্লার বিষয়ে যে সমস্ত ঘটনার কথা বলেছেন, এটা সঠিক নয়।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : কাদের মোল্লার নির্দেশে হত্যাযজ্ঞ লুটপাট হয়নি।
উত্তর : পরিষ্কার লেখা আছে।
প্রশ্ন : এই সময়ে কাদের মোল্লা ইসলামী ছাত্র সঙ্ঘের নেতা ছিলেন। মেহেরুন নেসা ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের হত্যা করেছে। এমন ঘটনা ঘটেনি।
উত্তর : ঘটেছে।
প্রশ্ন : মিরপুরের জল্লাদখানা বা কসাইখানা ছবি তুলেছেন।
উত্তর : অদ্ভুত প্রশ্ন।
প্রশ্ন : কখন অস্ত্র জমা দিলেন।
উত্তর : স্বাধীনতার পর। তারিখ মনে নেই। বঙ্গবন্ধুর কাছে জমা দিয়েছি।
প্রশ্ন : কাদের মোল্লার নামটি পরবর্তীতে জড়িয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন। আগে বলেন নি।
উত্তর : মিথ্যা কথা।
প্রশ্ন : ভিডিও মিরপুর দি লাস্ট শেলটার তাতে কাদের মোল্লার নাম বলেননি। ২০/৪/১২তে বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছে। এ জাতীয় আরও প্রামাণ্য চিত্র আছে। পরিচালক সাগির মোস্তফা। কাদের মোল্লা ৭ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন না।
উত্তর : ইহা সত্য নয়।
প্রশ্ন : কোন দল বা গোলাম আযমের পক্ষে প্রচার চালাননি। উনি যেহেতু আওয়ামী লীগ কে দল হিসেবে সমর্থন করেন না। সে কারণেই উনাকে এই মামলায় জড়িয়েছেন।
উত্তর : ইহা সত্য নয়।
প্রশ্ন : কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যে সমস্ত বক্তব্য দিয়েছেন তা সঠিক নয়।
উত্তর : সঠিক বলেছি।
প্রশ্ন : যেহেতু অনেক লোকের সঙ্গে সাক্ষাতকার দিয়েছেন, দেখলে বুঝবেন।
উত্তর : সময় বলে দেবে।

No comments

Powered by Blogger.