রম্য-খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না by গওহার নঈম ওয়ারা

আমরা যখন বড়দের সঙ্গে খেলার জন্য বায়না ধরতাম, কান্নাকাটি করে তাদের জীবন জেরবার করে দিতাম তখন গুরুজনদের ভয়ে বড় ভাই-বোনরা আমাদের খেলায় নিতে বাধ্য হতেন। আমরা বুঝতাম আমরা খেলছি; দলে আছি। দম ধরে দৌড়াদৌড়ি করতাম কিন্তু তাতে খেলার কিছু যেত আসত না। সুকুমার রায়ের ছড়ার মতো 'খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না'।


আমরা ছিলাম মিছিমিছি খেলার সাথী। মিছিমিছি শব্দটা বুঝে যাব বলে বলত 'দুধভাত'। এটাও একটা জুতসই শব্দ হতে পারে দফতরবিহীনতার। দুধভাত মন্ত্রী। মন্দ শোনায় না

কাকডাকা ভোর না হলেও বেশ ভোরেই ফোনটা এসেছিল। এত সকালে ফোন এলে মনে নানা কথা উঁকি দেয়। বিশেষ করে মোবাইলের পর্দায় যখন ভেসে ওঠে জান পাহচান মানুষের নাম, তখন দমাদম দম বন্ধের পালা শুরু হয়। অনুরোধ এলো পাকিস্তানি চ্যানেল জিও টিভি দেখার। আল্লাহর কাছে শুকুর আদায় করে এক গ্গ্নাস পানি গিলে টিভির সামনে গিয়ে বসলাম। তখনও সকালের অনেক আবশ্যিক কাজ বাকি।
বাতচিত চলছে বাংলাদেশ নিয়ে। ইন্টারেস্টিং মানে মজাদার আলোচনা। বলা যায় অরুন্তুদ বাক্যধর্মী বিদ্রূপাত্মক বাকমেলা বা টক শো। বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, অর্থনীতি, জীবনযাত্রাকে একরকম হেয়প্রতিপন্ন করার প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা। কেউ কেউ নিছক কৌতুক হিসেবে নিতে পারেন। বলতে পারেন চড় মারেনি, গালে মাছি বসেছিল তাই তাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের নাম নিয়েও প্রশ্ন উঠল, এটার শেষাংশ কোনো 'স্তান' না হয়ে দেশ হলো। 'স্তান' শব্দটি অনেক বেশি ইসলামিক 'দেশ' শব্দের তুলনায়। বাংলা বর্ণমালা আরবি হরফে না লেখাটাও যে ইসলামের সঙ্গে গাদ্দারি করা সেটাও বাক্যবাগীশদের কথার মারপ্যাঁচে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। বাকমেলার মূল চরিত্র একজন 'চারণ কবি'; যে কেউ তাকে জাসুস বা গুপ্তচর বলে সন্দেহ করতে পারেন। ঢাকায় এসে দিব্যি ঘুরপাক খেয়ে গেছেন। মন্ত্রমুগ্ধ না হলেও অনেকে মুগ্ধ হয়েছেন অনেক দিন বাদ 'পাক সার জামিন শাদ বাদ' বলা এক পাক আদমির দেখা পেয়ে। টেলিভিশন তাদের মুগ্ধ বদন কাছ থেকে, দূর থেকে, দেখাতে কসুর করেনি।
সবচেয়ে গোলমেলে লাগল যখন তিনি একদল এফএম ব্যান্ড মার্কা তরুণ-তরুণীর সঙ্গে 'পাকিস্তান-বাংলাদেশ' সম্পর্ক নিয়ে বাহাস শুরু করলেন। এহে তোমরা উর্দু জানো না? পিত্তি জ্বলে যাওয়া এমন প্রশ্ন আমাদের নতুন প্রজন্মের পোলাপানকে যেন মুষড়ে দিল। একজন তো 'হ্যাব হ্যাব নো হ্যাব নো হ্যাব একবার তো সি ' মার্কা উর্দু ছোটাতে গিয়ে লাইনচ্যুত মানে ডিরেল হতে থাকল বারবার। অনেকটা আমাদের সেন কর্তার মতো। মুখ থুবড়ে পড়েও বলেন, 'কয়ি বাত নেহি।' বিদ্রূপাত্মক একটা অনুষ্ঠানের সস্তা মসলা পানির দামে কিনে নিলো জিও টিভি। একজন মাত্র তরুণ অনেক সাহস করে বলে ফেললেন, 'হে হে হে, তোমরা তো বাংলায় বাত করতে পার না। হে হে হে।'
হয়তো মনে হবে এটা একটা নিছক 'বাকমেলা' বা টক শো, হাজার লক্ষ বাকমেলার মধ্যে একটি ; কে তার খবর রাখে? কী হবে ওসব দিয়ে। হক কথা! কেউ আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তা সে যত কঠিন গালিই হোক আর যত উচ্চকণ্ঠের গলাবাজিই হোক। কথাটা ঠিক; তবে কন্ডিশন অ্যাপ্লাই_ শর্তটা হচ্ছে আমাদের ধারণাটা যদি স্বচ্ছ আর সুদৃঢ় থাকে। গ্যাঞ্জামটা ওখানেই।
আমাদের নতুন প্রজন্ম একটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। এফএম ব্যান্ড মার্কা বলেই হোক বা বুনিয়াদি কোনো কারণেই হোক তারা যে একবারেই কনফিউজড তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সঞ্চালক যখন তাদের প্রশ্ন করলেন, একাত্তরের কারণে তোমরা পাকিস্তানিদের 'হেট' করো না তো? পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে তারা যা বললেন তাতে আক্কেল গুড়ূম হয়ে যাওয়ার কথা। যে বয়সের তরুণরা বুকের রক্ত ঢেলে দিতে কুণ্ঠা করেনি, মাত্র একচলিল্গশ বছর পর সেই একই বয়সের তরুণরা শোল্ডার শেক করে, ঘাড় ঝাড়া দেয়_ যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন মাফ চাইলেই আমরা মাফ করে 'আ গলে লাগ যা' বলে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। মাফ করে দেব, মাফ চাও বন্ধু_ এ যে চার বছরের শিশুকে এটিকেট শেখানোর কসরত_ 'বাবু বলো, বলো, সরি বলো; সরি বলো।'
আর সহ্য হলো না। রিমোটে দিলাম এক চাপ। রিমোটটা আজকাল বড় পেরেশান করছে। যতই কষে চাপ দিই না কেন সরি সরি করেও সরে না। ঘুরে আসে আবার আগের জায়গায়। খুব ছোট বিরতি নিলেও তা স্থায়ী হয় না। হঠাৎ দেখি পাকিস্তানি চ্যানেলে আমাদের সেন কর্তাকে দেখাচ্ছে_ উজিরে খামাখা বানানো হয়েছে_ রেলের উজিরকে। বড় বেয়াদব দফতরবিহীন মন্ত্রীর উর্দু করেছে উজিরে খামাখা। উজিরে আজম তাকে উজিরে খামাখা বানিয়েছেন। উর্দুতে প্রধানমন্ত্রীকে উজিরে আজম বলে, মমতা পশ্চিমবঙ্গে উজিরে আলা মানে মুখ্যমন্ত্রী, এসব অজানা নয় কিন্তু উজিরে খামাখা_ তারা কি কোনো ব্যঙ্গ করছে?
বাংলা খামাকা বা খামোকা অথবা খামোখা শব্দটা এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। ফারসি ভাষায় এর উচ্চারণ হবে অনেকটা 'খ্বাহম খ্বাহ'। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর রম্যরচনার গুরু মুজতবা আলী শব্দটি বহুবার ব্যবহার করেছেন। অবশ্য বঙ্কিমের সময় বাংলায় 'ম'-এর বদলে 'ন' লেখা হতো খামোকার ক্ষেত্রে। বঙ্কিম লিখেছেন_ খানকা নাচ্ব েকেন গো। রবীন্দ্রনাথ অন্যভাবে লিখেছেন_ খামাকা আজ একটা বিপদ ঘটত। নজরুল কিছুটা রঙ্গ করেছেন শব্দটা নিয়ে; লিখেছেন_ খামাখা কাজী শুষ্ক তোমার শাস্ত্র ঘেঁটে। মুজতবা আলী কিছুটা সরাসরিই শব্দটা ব্যবহার করেছেন_ 'এ কথা অস্বীকার করে খামোখা মিথ্যেবাদী হতে যাব কেন?'
বিচারপতি হাবিবুর রহমান তার যথাশব্দ কেতাবে খামোখাকে দিয়েছেন অন্য এক দিশা। তার মতে, এর যথাশব্দ হচ্ছে_ উদ্দেশ্যহীনতা, অকারণে, বিনা উদ্দেশ্যে, মিছিমিছি, শুধু শুধু। যেহেতু হাবিবুর রহমান সাহেব একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ছিলেন এবং অনেক রাষ্ট্রীয় আচরিক শব্দ উপহার দিয়েছেন (বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক ইত্যাদি) সেহেতু খামাখার উচিত যথাশব্দ 'মিছিমিছি' আমরা ব্যবহার করতে পারি। বিচারপতি অবশ্য খামোখার আরও কিছু যথাশব্দ বাতলেছেন। তার মতে, অহেতুক বা বেওজর শব্দ দুটিও ব্যবহার করা যায় অন্য আরও যথাশব্দের সঙ্গে। তাই বলে দফতরবিহীন মন্ত্রীকে অহেতুক মন্ত্রী বা উজিরে বেওজর মোটেও ভালো শোনাবে না। তার চেয়ে বরং মিছিমিছি মন্ত্রী অনেক বেশি সহজ আর পরিষ্কার শোনাবে। আমরা যখন বড়দের সঙ্গে খেলার জন্য বায়না ধরতাম, কান্নাকাটি করে তাদের জীবন জেরবার করে দিতাম তখন গুরুজনদের ভয়ে বড় ভাই-বোনরা আমাদের খেলায় নিতে বাধ্য হতেন। আমরা বুঝতাম আমরা খেলছি; দলে আছি। দম ধরে দৌড়াদৌড়ি করতাম কিন্তু তাতে খেলার কিছু যেত আসত না। সুকুমার রায়ের ছড়ার মতো 'খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না'। আমরা ছিলাম মিছিমিছি খেলার সাথী। মিছিমিছি শব্দটা বুঝে যাব বলে বলত 'দুধভাত'। এটাও একটা জুতসই শব্দ হতে পারে দফতরবিহীনতার। দুধভাত মন্ত্রী। মন্দ শোনায় না! বেশ নিষ্পাপ পবিত্র পবিত্র একটা ভাব আছে শব্দটার। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে একটা ঐতিহ্যের গন্ধও আছে। আবার অনুপস্থিত গুরুজনদের চোখে ধুলো দিয়ে শ্যাম আর কুল দুটো রক্ষার ব্যাপারটাও স্পষ্ট। তাহলে তাই হোক, দফতরবিহীন মন্ত্রী না বলে আমরা দুধভাত মন্ত্রী বলি_ কেমন?

গওহার নঈম ওয়ারা : কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.