জীবনের অর্ধসত্য রূপ by আতাউর রহমান

মানুষ যখন একটা বয়সে এসে পৌঁছায় তখন তার মনে ঔচিত্য বোধের প্রশ্ন জাগে। অনেকে বলেন, যার নয় বছরে হয় না তার নব্বই বছরেও হয় না। এ প্রবচনের সঙ্গে আমি একমত নই। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও মানুষের মধ্যে ইতি ও নেতির দ্বন্দ্ব জোরালো থাকে। যৌবনের ক্ষরা স্রোতে প্রায় সবকিছুকেই অবজ্ঞা ও অবহেলা করা যায়, কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্রেইন সেল হয়ত মরতে শুরু করে, কিন্তু মানুষের চেতনায় ও মননে একটা স্থিতি বাসা বাঁধতে শুরু করে। একে মৃত্যু-চিন্তার ফল হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই না।

একজন ডাকাতও প্রৌঢ়ত্বে দাঁড়িয়ে তার কৃতকর্মের জন্য দুঃখিত হয়। ব্যতিক্রম হিসেবে অনেক অনমনীয় লোক দেখা যায়, যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অপরিবর্তিত থেকে যায়। তাদের বেলা ৯ আর ৯০ বছরের প্রসঙ্গটা হয়তবা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। মানুষের জীবন সমস্যাবহুল; সে যৌবনকাল কী বৃদ্ধকাল, যে কালই হোক না কেন। এ প্রসঙ্গ এলেই আমি তুখোড় সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র 'বহিপীর' নাটকের সংলাপ আওড়াই, পীর সাহেব এক মুরিদকে বলছেন-'বাবা যৌবনেও শান্তি নেই, বৃদ্ধকালেও শান্তি নেই।' এই উক্তির সত্যতা অনস্বীকার্য। খুব খোলাসা করে না বললেও দুই বয়সে দু'রকম সমস্যা হয়। যৌবনে হয়তবা কারও কারও প্রেমহীনতার সমস্যা হয় আর বৃদ্ধকালে খাদ্য হজমের সমস্যা হয়। আমার সব বলায় ও লেখায় রবীন্দ্রনাথের কথা একটু বেশি করে আসে। প্রথমত, উনি বাঙালি কবি বলে তাকে একটু বেশি বুঝি, দ্বিতীয়ত, মনে হয় তার লেখায় ও জীবনাচরণে আমি অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই। আমি তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথের 'তাসের দেশ' নাটকে রাজপুত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। বিন্দুমাত্র গান না জেনেও আমি ১৫-১৬টি গান মঞ্চের ওপর গেয়েছিলাম। তখনকার বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক অন্তরাল থেকে আমার গানগুলো গেয়ে দিয়েছিলেন। আমি প্রচুর মহড়া দিয়ে তার গীত গানের সঙ্গে ঠোঁট-মেলাতে পেরেছিলাম। দুই-এক জায়গায় যেখানে হোঁচট খেয়েছি দর্শকদের পশ্চাৎদেশ প্রদর্শন করে ম্যানেজ করেছি। আমি ষাটের দশকে ঢাকা শহরে রাজপুত্র খ্যাতি অর্জন করি। পুরনো বন্ধু-বান্ধবরা এ প্রৌঢ় বয়সে আমাকে এখনও রাজপুত্র বলে ডাকে। এই মিথ্যা রাজপুত্র হতে আমার ভালোই লাগে। 'তাসের দেশে'র একটি গান তখন আমাকে আন্দোলিত করত। গানটা ছিল-'যাবই আমি যাবই ওগো, বাণিজ্যতে যাবই। লক্ষ্মীরে হারাই যদি, অলক্ষ্মীরে পাবই।' অলক্ষ্মীকে কেউ কামনা করে না, কিন্তু এ কামনার মধ্যে একজন বীর্যবান পুরুষের চিত্র খুঁজে পেতাম, যা যে কোনো তরুণকে প্রাণিত করতে পারে। পরে জেনেছিলাম এ নাটকের পুস্তিকাটি রবীন্দ্রনাথ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন, যিনি ভারতবর্ষকে ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন। তার সংগ্রাম ছিল যৌবনের খরা তেজে সুবোধ লক্ষ্মীকে বিসর্জন দেবারই সংগ্রাম। উনি ইংরেজ সরকারের ঔপনিবেশিক শাসন মেনে নিতে পারেননি। সুভাষচন্দ্রকে আমার রবীন্দ্রনাথের এই গানের শেষ স্তবকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হিরো মনে হতো। গানের কথায়-'অকুল-মাঝে ভাসিয়ে তরী যাচ্ছি অজানায়, আমি শুধু একলা নেয়ে আমার শূন্য নায়।' এমন রোমান্টিক হিরোর চিত্রকল্প কেবল স্বপ্নেই সম্ভব, তবুও নেতাজি তার কাছাকাছি গিয়েছিলেন। 'তাসের দেশে'র আরেকটি গান যৌবনে আমাদের শোণিতে রক্তপ্রবাহ চঞ্চল করে দিত, এই প্রাণদীপ্ত গানের বুঝি কোনো তুলনা হয় না-'আমরা নতুন যৌবনেরই দূত। আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত। আমরা বেড়া ভাঙ্গি, আমরা অশোকবনের রাঙা নেশায় রাঙ্গি। ঝঞ্ঝার বন্ধন ছিন্ন করে দিই-আমরা বিদ্যুৎ'॥যৌবনের প্রিয় গানগুলো এখন আর তেমন শোনা হয় না। শুনলেও হয়ত আগের মতো রক্ত নেচে উঠবে না। সময় মানুষকে পাল্টে দেয়। আমি তরুণদের হেভি মেটাল বা রকসঙ্গীত শোনাকে কখনও নিন্দা করি না। এই সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্যে প্রচন্ড একটা শক্তির তরঙ্গ আছে, যন্ত্রসঙ্গীত যার সুযোগ্য পথিক-বন্ধু হয়ে ঐকতানের সৃষ্টি করে। সময় পাল্টায়, মানুষের রুচিবোধ পরিবর্তিত হয়, এই হচ্ছে জগতের কাল পরিক্রমার স্বভাব। এমনও দেখা গেছে, বাতিল হওয়া পুরনো বস্তু আবার নতুনের খোলস নিয়ে ফিরে এসেছে। আমি একবারও এই লেখার মাধ্যমে তরুণ ও বৃদ্ধের পছন্দের তারতম্যের কথা বলতে চাইছি না। আমি শুধু জানাতে চাই আমাদের পছন্দগুলোর ক্রমবিন্যাস সময়ের সঙ্গে কীভাবে জায়গা বদলা-বদলি করে। এ আবর্তন ও বিবর্তনের মধ্য দিকে জগতের মহাযজ্ঞশালার চির ঘূর্ণায়মান অশেষ বৃত্তটির সৃষ্টি হয়। 'তাসের দেশ' নাটকের গানগুলো এখনও আমার কাছে অপ্রিয় নয়। তবে বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে-'আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।' মৃত্যুকে জয় করার সাধনায় নিজের মনকে প্রস্তুত করতে থাকি, বরাভয় হওয়ার চেষ্টা করি, তবুও ভয় কাটে না, বুকের বাঁ দিকে সামান্য চিন চিন করলে জগৎ ও জীবনকে হারানোর ভয়ে কিছুটা হলেও ম্রিয়মাণ হয়ে যাই। তখন সেই রবীন্দ্রনাথকে সম্বল করে মনে মনে আবৃত্তি করতে থাকি- যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়। এই হার-জিত খেলা, জীবনের মিথ্যা এ কুহক, শিশুকাল হতে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা- দুঃখের পরিহাসে ভরা। ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি- মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ অাঁধারে॥ এত কিছুর পর জীবন বিশ্বনিয়ন্তার এক অপূর্ব দান যার বিচরণ ভূমি হলো বিশ্ব নামে এই অনন্য গৃহ। হাজারও হতাশা ও দারিদ্র্যের মধ্যে পৃথিবী নামক গ্রহকে আমরা ভালোবাসি। জগতের সমগ্র কুৎসিতকে আলিঙ্গন করে আমরা যতদিন সম্ভব টিকে থাকতে চাই, এটাই মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা। লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক

No comments

Powered by Blogger.