শেকড়ের ডাক-হারিয়ে যাচ্ছে ধানের জাত হারাচ্ছে ঐতিহ্য by ফরহাদ মাহমুদ
ভারতে নর্মদা ড্যাম নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন সে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। কিন্তু নানা আইনগত জটিলতা ও কৌশলগত কারণে সেটি করা সম্ভব হয়নি। সত্তরের দশকের শেষ দিকে তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পুনরায় সেই উদ্যোগ নেন। ১৯৮৪ সালে অর্থাৎ তিনি নিহত হওয়ার বছর এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছিলেন তিনি। এতে নর্মদা নদীর ওপর ছোটবড় প্রায় তিন হাজার বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা
ছিল। নতুনভাবে কয়েক লাখ হেক্টর আবাদি জমি তৈরি করাসহ এর বিশাল উপযোগিতা থাকা সত্ত্বেও ভারতের সচেতন মহল এর বিরোধিতা শুরু করে। 'নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন' নামে ভারতজুড়ে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। স্থগিত থাকে বাঁধ নির্মাণের কাজ। এক দশকেরও বেশি সময় আন্দোলনের পর ১৯৯৩ সালে বিশ্বব্যাংক নর্মদা ড্যাম নির্মাণে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে। আন্দোলনকারীদের আপাতত বিজয় হয়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী এই লেখককে গর্ব করে বলেছিলেন, 'নর্মদার তীরবর্তী অঞ্চল থেকে আমরা বিশেষ ধরনের গুণাগুণসম্পন্ন এক ডজনেরও বেশি ধানের নতুন জাত সংগ্রহ করেছি, যার মূল্য নর্মদা ড্যাম যে উপকার করত, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি।' বিজ্ঞানীর সেই কথাগুলো আজ খুব বেশি করে মনে পড়ছে, যখন দেখি বাংলাদেশে স্থানীয় জাতের ধানগুলো প্রায় হারিয়েই গেছে।
এক শ বছরও হয়নি, বিখ্যাত ধানবিজ্ঞানী ড. জি পি হেক্টর বাংলাদেশে বিভিন্ন মৌসুমে জন্মানো প্রায় ১৮ হাজার জাতের ধানের চাষ হয় বলে জানিয়েছিলেন। ১৯৮২ সালেও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক জরিপে ১২ হাজার ৪৮৭ জাতের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। আর বর্তমানে চাষাবাদের আওতায় স্থানীয় জাতের ধানের সংখ্যা বড়জোর শখানেক। কে জানে, এই শখানেক জাতও কবে 'নাই' হয়ে যাবে? অবশ্য এর পেছনে অনেক যুক্তিসংগত কারণও আছে। বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমাদের কেবলই উচ্চফলনশীল জাতের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ক্রমেই বাড়ছে এই নির্ভরতা। ফলে কম উৎপাদনশীল স্থানীয় জাতগুলোর প্রতি কৃষকেরও আগ্রহ থাকছে না। আবার অনেক ধানের জাতের বীজ বপন করা থেকে ধান কাটা পর্যন্ত সময় লেগে যায় অনেক বেশি_প্রায় দেড় গুণ। তদুপরি ফলন কম। তাই কৃষকরা দ্রুত ও বেশি উৎপাদনশীল ফসলের দিকেই ঝুঁকছে। আবার বেশির ভাগ নদী মরে যাওয়ায় একদিকে বেড়েছে বন্যা, অন্যদিকে বেড়েছে খরা। এতে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি যেমন বদলেছে, তেমনি বদলে গেছে ফসলের ধরনও। একসময় ধানচাষে আমনের প্রাধান্য ছিল। অনেক এলাকায় আউশের আবাদও ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা বারবার আউশের উল্লেখ পাই। যেমন_
'বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর।'
বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবল থেকে আউশকে রক্ষা করা না গেলে একসময় হয়তো আউশের চাষ পুরোপুরিই উঠে যাবে। ভুশরা আউশ, বলেশ্বর, চকজামিরা, ফলকেলে, কানাইবাঁশি, চারনক, সরুজাতের বাঁশফুল, লক্ষ্মীজটা, বোয়ালধর, সরিষাফুল, রংমহলের মতো ধানগুলো আমরা কোথায় খুঁজে পাব? এখন বোরোটাই হয়ে উঠেছে প্রধান ফসল। ফলে আউশ ও আমনের অনেক জাত হারিয়ে গেছে। তবে সামান্য হলেও মনে আশা জাগে, মাঠ থেকে হারিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এ রকম প্রায় পাঁচ হাজার জাতের ধানবীজ তাদের বীজব্যাংকে সংরক্ষণ করছে। কিছু বেসরকারি সংস্থাও স্থানীয় জাতের কিছু বীজ সংরক্ষণ করছে এবং পরীক্ষামূলক উৎপাদনও করছে। গবেষণা চলছে এসব ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপায় নিয়ে। তার পরও ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে ১৩ হাজারের বেশি ধানের জাত। এসব ধানের যে গুণাবলি ছিল, সেগুলো ফিরিয়ে আনাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ধান উৎপাদনকারী প্রায় সব দেশেই একই অবস্থা। স্থানীয় জাতগুলো ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানেও কিছুটা আশা জাগিয়ে রেখেছে ফিলিপাইনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। তাদের সংগ্রহশালায় এক লাখ ২০ হাজারের ওপর ধানের জাত রয়েছে। সেখানেও হয়তো বাংলাদেশেরও বেশ কিছু জাত রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কি আর কোনো দিন মাঠে ফিরতে পারবে? আমাদের পাতে আসতে পারবে?
কথা হলো, আমরা কি কেবল ১৮ হাজার বা তারও বেশি জাতের ধানই হারাচ্ছি? সেই সঙ্গে আমরা কি আমাদের খাদ্য ঐতিহ্যও হারিয়ে ফেলছি না? উড়কি ধানের মুড়কি, বিনি্ন ধানের খই, শালি ধানের চিঁড়া_আরো কত কী! আমাদের সাহিত্যে, কবিতায়, গানে এ রকম বহু ধানেরই তো উল্লেখ রয়েছে_এ সবই কি অর্থহীন হয়ে পড়বে? ছোটবেলায় পড়া সেই বিখ্যাত ছড়াটির কথা মনে পড়ছে। সব ভুলে যেত বলে চাকরটি বাজারের ফর্দ মুখস্থ করতে করতে যাচ্ছিল, অবশ্য সেখানেও সে গোল বাধিয়েছিল। ফর্দটিতে ছিল, দাদখানি চাল, মসুরের ডাল, চিনি পাতা দই, ডিমভরা কই_এমনি আরো কিছু জিনিস। কিন্তু এখন ঢাকার প্রধান বাজারগুলো খুঁজলে কি এক কেজি দাদখানি চাল পাওয়া যাবে? তেমনি ছিল রাজদিঘা, লক্ষ্মীদিঘা, বাঁশফুল, চিনিবিলাস, হনুমানজটা, নরই, রাতুল, কলমিলতা, নাতোল, ষাইটা, ঠাকুরভোগ, নয়নতারা, কালিঝলি, বুড়িমুরলি, বউরোশ, কালামাছি, দুধমাছি, সূর্যমণি, বকরমিঠা, চৈতনদুমা, দুমরা, বৌমাইল, অলিরাজ, চম্পাকলি, লক্ষ্মীবিরালি, ইন্দুশাইল, ভাদনিয়া, ফুলকড়ই, ইছাআমন, খামা, গুয়ারশাইল, কড়ি আমন, লক্ষ্মীবিলাস, লালগোটক, আশমিতা, কিরণ, পানিকাওরি, খিরণী, গাবুরা, হিলবোরাগ, বাগদাইর, গোলাপবেরি, বাঁশাবোরো_আরো কত কত নাম! এর কয়টা নামের অস্তিত্ব এখন আছে?
পুরনো দিনের ধানের কথা বলতে গিয়ে পুরনো দিনের বহু মানুষই যথেষ্ট পরিমাণে নস্টালজিক হয়ে পড়েন। সেসব ধানের কত না বৈশিষ্ট্য ছিল! কিছু ধান ছিল, সেসব ধানি জমির কাছ দিয়ে গেলে সুবাসিত বাতাস প্রাণ জুড়িয়ে দিত। মুড়ি তৈরির জন্যও বিশেষ বিশেষ জাতের ধান ছিল। সেসব মুড়ির স্বাদ আজকালের মুড়িতে কি পাওয়া যায়? তেমনি কিছু ধান ছিল ক্ষীর-পায়েস বা সেমাইয়ের জন্য। কত রকমের পিঠা-পুলি তৈরি হতো গ্রামেগঞ্জে! একেক ধরনের পিঠার জন্য ছিল একেক ধরনের ধান। ভালো চিঁড়ার জন্যও শালি ধানসহ বিশেষ বিশেষ ধান ছিল। কোথায় গেল সেসব ধান! কোথায় যাচ্ছে আমাদের খাদ্যের সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য! শুধু নস্টালজিয়ার জন্যই নয়, গবেষণার জন্যও এসব ধানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, খুঁজে বের করা এবং সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। গবেষকরা হয়তো উচ্চফলনশীল জাতের সঙ্গে পুরনো সেসব জাতের সংকরায়ণের মাধ্যমে আমাদের পুরনো সেসব স্বাদ-গুণ কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিতে পারবেন। তাই খুঁজে খুঁজে কিংবা অন্যান্য দেশ থেকে এনে আমাদের জাত সংরক্ষণের ভাণ্ডার আরো শক্তিশালী করতে হবে। সে উদ্যোগটি আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে। পুরনো ধান সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, কৃষি মন্ত্রণালয় এই ক্ষেত্রটিতেও সফল হবে।
লেখক : সাংবাদিক
No comments