টেন্ডুলকার-আবেগে পন্টিংয়ের লাগাম

সবরমতি নদীর তীরে দুই মহাতারকার একজনের বিশ্বকাপ-জীবনের ইতি ঘটতে চলেছে আজ। পরের বিশ্বকাপ শচীন টেন্ডুলকার বা রিকি পন্টিংকে পাবে কি না, সে প্রশ্ন পরে। কিন্তু আপাতত দুই তারকার একজনকে বিশ্বকাপ মঞ্চ থেকে বিদায় দিতে তৈরি সরদার প্যাটেল স্টেডিয়াম।
কাল দুপুরে যখন সংবাদ সম্মেলনে এলেন পন্টিং, তাঁর দিকে ধেয়ে গেল নানা বিতর্কিত প্রশ্ন। নিজের ফর্মহীনতা, আউট জেনে টেন্ডুলকারের মতো না ‘হাঁটা’, মেজাজ হারিয়ে এই বিশ্বকাপেই ড্রেসিংরুমে টিভি ভাঙাসহ কত কী না করলেন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক। অধিনায়ক হিসেবে ম্যাচ-পূর্ব নিজের শেষ সংবাদ সম্মেলনটাও করে ফেললেন কি না—বাতাসে ভাসল এমন সব গুঞ্জনও।
আসলে নিয়তির লিখন। এবং এখানেই দেখা যাচ্ছে টেন্ডুলকার-পন্টিং দুজনই নিজ নিজ ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে দুই মেরুতে। টেন্ডুলকার আছেন ফর্মের সপ্তস্বর্গে, ব্যাট ছুটিয়ে চলছে রানের ফোয়ারা, শাণিত ব্যাটটা গত বছর দুয়েকে টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে কুড়িয়েছে ১৬টি সেঞ্চুরি, এই বিশ্বকাপেই যার দুটি। উল্টো দিকে পন্টিংয়ে ব্যাটে মরুর খরা, ১৭ ম্যাচ আগে পেয়েছেন শেষ সেঞ্চুরি, গত জুনের পর থেকে দেখা পাননি একটা ফিফটিরও।
এই অবস্থায় তাঁর নিজের মনে বিদায়ের রাগিণী বেজে থাকলে অপ্রকাশিতই রাখলেন পন্টিং। দুটি বিশ্বকাপ জেতা অধিনায়ক তাকাতে চান সামনে। কিন্তু পন্টিংকে এদিন দেখে মনে হয়েছে, সম্রাট নেপোলিয়নের সেই ওয়াটার লুর যুদ্ধের মতো তাঁর সামনেও আজ একটা যুদ্ধ। সরদার প্যাটেল স্টেডিয়াম সেই যুদ্ধের ময়দান। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় এখানে ঘটেছিল গোধরা হত্যাকাণ্ড। যেটির বর্ণনা দিতে গিয়ে আজও শিউরে ওঠেন স্থানীয়রা। পন্টিং শুনে থাকলে নিশ্চয়ই বিড়বিড় করে বলবেন, ‘আজ তো আমারও যুদ্ধ!’
নিজেকে বাঁচানো, দলকে বাঁচানো এবং অতঃপর টেন্ডুলকার ঠেকাও—পন্টিংয়ের সামনে চ্যালেঞ্জের অভাব নেই। সেই চাপেই যেন রোগাটে হয়ে গেছেন। যদি আজ টেন্ডুলকার নিজের শততম সেঞ্চুরিটা পেয়ে যান এবং ভারত জিতে যায় তাহলে? টেন্ডুলকারকে আটকাতে নিশ্চয়ই কাজ করেছেন পন্টিং?
প্রশ্ন শুনে স্মিত হাসি পন্টিংয়ের মুখে, ‘আশা করি, সে কাল (আজ) সেঞ্চুরিটা পাবে না। আমরা তাকে সেই সুযোগ দেব না নিশ্চিত থাকুন।’ কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৯৯টি সেঞ্চুরির মালিকের বিদায় কি ব্যক্তি পন্টিংকে একটু বেদনাহত করবে না?
আবেগের লাগাম পন্টিংয়ের গলায়, ‘এটা অসাধারণ ব্যাপার। শচীন যেভাবে এতটা পথ এল, সহজ ব্যাপার নয়। তবে এটা বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, আমরা আবেগতাড়িত নই।’
কিন্তু আবেগ ছুঁয়ে যাচ্ছে আহমেদাবাদের গা-পোড়ানো রোদেও। টেন্ডুলকার-পন্টিংয়ের মতো চরিত্র না থাকলে বিশ্বকাপ কি ঔজ্জ্বল্য হারায় না? নির্মম সত্য হচ্ছে, আজ একজনকে মঞ্চ ছাড়তেই হচ্ছে।
পন্টিং বিদায় নিক, ভারত সেটাই চাইছে। কিন্তু টেন্ডুলকারের বিদায় মাতম তুলবে এখানে। চেন্নাইয়ে শততম সেঞ্চুরি পাননি, আহমেদাবাদবাসী বুক বেঁধে আছে, নায়ক এখানে রেখে যান আরেকটা কীর্তি। স্থানীয় এক সংগঠক বলছিলেন, ‘ভারত হারলেও ততটা দুঃখ পাব না, টেন্ডুলকার শততম সেঞ্চুরি না পেলে যতটা বেশি পাব।’
এই সরদার প্যাটেল স্টেডিয়ামে টেন্ডুলকার পেয়েছেন তাঁর টেস্টের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি (প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড), কিছুদিন আগে নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের দুই দশক এখানেই উদ্যাপন করেছেন। টেন্ডুলকারের জন্য মঞ্চটা দুহাত বাড়িয়েই রয়েছে।
সেই মঞ্চে কাল মধ্যদুপুরে ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি বললেন, ‘আমরা ওর ওপর চাপ তৈরি করতে চাই না। আগে ওকে রানটা করতে দিন।’
সকালে আইসিসির প্রধান নির্বাহী হারুন লরগাত বলে গেলেন, ‘টেন্ডুলকার শততম সেঞ্চুরি পেলে আমরা ওকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়ার কথা ভাবব।’
কলকাতার এক রিপোর্টার গত তিন সপ্তাহে টেন্ডুলকারের ওপর ১৮টি লেখা লিখেছেন। চারটি তৈরি রেখেছেন, শততম সেঞ্চুরি হলেই এগুলো ‘বাজারে’ ছাড়বেন। বাজারে এলে পন্টিং যে হাতে পেয়ে ভুলেও চোখ বোলাবেন না, কাল তাঁকে দেখে ভালোই বোঝা গেছে!

No comments

Powered by Blogger.