যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'মডার্ন হাম্মুরাবি এবং কাঠের ঘোড়া' by আলমগীর সাত্তার

১৫-২০ বছর আগে এথেন্স শহরের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আত্তিকা ওদিয়ন থিয়েটার প্রাঙ্গণে মডার্ন ইউলিসিস নামের হাস্যরসাত্মক একটি নাটক দেখেছিলাম।

হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিলেন গ্রিসের ইথিকা রাজ্যের রাজা ইউলিসিস। ট্রয়ের যুদ্ধের কাঠের ঘোড়া তৈরি করার পরিকল্পনাটি ছিল সেনাপতি ইউলিসিসের। ইউলিসিস গ্রিকদের কাছে খুব প্রিয় চরিত্র হলেও সে ছিল একজন প্রতারক। সম্মুখযুদ্ধে এবং ১২ বছর অবরোধ করে রেখেও গ্রিকরা ট্রয়ের দুর্গ দখল করতে পারল না। তখন ইউলিসিসের বুদ্ধিতে গ্রিকরা বিশাল একটি কাঠের ঘোড়া তৈরি করল এবং ভান করল, তারা গ্রিসে ফিরে যাচ্ছে। এরপর আর পুরো গল্প লেখার প্রয়োজন নেই।
আমাদের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করার পর ঘোষণা দিলেন, নির্বাচন দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীর ব্যারাকে ফিরে যাবেন। এ কথা সত্যি যে তিনি আর ব্যারাকে ফিরে না গিয়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে দেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং জনগণকে গণতন্ত্রের কাঠের ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন। ইউলিসিসের সঙ্গে চারিত্রিক মিল থাকায় জিয়াউর রহমানকে আমার মডার্ন ইউলিসিস বলেই মনে হয়েছে। জিয়াউর রহমানের চরিত্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক আরেক সম্রাটের চরিত্রেরও আমি মিল দেখতে পেয়েছি। এখন থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের সম্রাট হলেন হাম্মুরাবি। তখন মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন রাজার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই ছিল। ওই ঝগড়া-বিবাদকে হাম্মুরাবি সুকৌশলে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি তাঁদের মধ্যে একটির সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে জোট বেঁধে অন্যান্য শত্রুর নগর-রাষ্ট্র দখল করেন। তারপর হাম্মুরাবি আকস্মিকভাবে নিজের সাম্প্রতিক মিত্র নগর রাষ্ট্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তা অধিকার করে নিতেন।
ইউলিসিস এবং হাম্মুরাবি_দুজনের সঙ্গে মিল থাকায় আমি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে মডার্ন হাম্মুরাবি নাম দিয়েছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দুজন অসম সাহসী অধিনায়ক ছিলেন_মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল তাহের। দুজনই সম্মুখে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দুজনই যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর গোলার আঘাতে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। দুজনের মধ্যে প্রথমজন ছিলেন সৈনিকরা যেমন হন ঠিক তেমনই। একদম পেশাদার সেনানায়ক। তিনি ছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির অনুরাগী। এটা তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যও বটে। দ্বিতীয়জন কর্নেল তাহের দেশপ্রেমিক এবং সাহসী যোদ্ধা ছাড়াও ছিলেন রাজনীতিমনস্ক। তিনি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, সেনাবাহিনীর মতো সুসংগঠিত একটি বাহিনীকে দেশরক্ষার কাজে যুদ্ধরত অবস্থায় থাকা ছাড়া অন্য সময়ে দেশের উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। খালেদ মোশাররফ এর বিপক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন, উন্নয়নমূলক কাজের নামে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়লে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা নষ্ট হবে, তাঁদের মধ্যে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়বে, তাঁদের পেশাদারিত্বের ক্ষতি হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে দুই দেশপ্রেমিক সেনানায়কের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর খুনি বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা বঙ্গভবনে বসে হুকুম জারি করে দেশ ও সেনাবাহিনী চালাচ্ছিল। ব্যাপারটা খালেদ মোশাররফ, ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিলরা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে '৭৫-এর নভেম্বর মাসের ৩ তারিখ এক সেনা অভ্যুত্থান ঘটান। সেনাবাহিনীর জওয়ানদের মধ্যে কর্নেল তাহেরের মতাদর্শে বিশ্বাসী জওয়ানদের সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহের ও তাঁর অনুসারীদের সমর্থন আদায় করেন। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেনানায়কসহ নিহত হন। এর অল্প কয়েক দিন পর জিয়াউর রহমান তাঁর উদ্ধারকারী কর্নেল তাহেরকে কারারুদ্ধ করেন এবং আরো কিছু দিন পর বিচারের নামে প্রহসন করে তাঁকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেন। এখানেই জিয়াউর রহমানের হাম্মুরাবি নামের সার্থকতা প্রমাণিত হয়। জেনারেল মঞ্জুর ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সফলতম সেক্টর কমান্ডার। পণ্ডিত ব্যক্তি বলেও তাঁর সুনাম ছিল। জেনারেল মঞ্জুর কিন্তু কর্নেল তাহেরের মতো একই ভুল করেছিলেন। অর্থাৎ জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, জিয়া বুঝি দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি সেনানিবাসে ফিরে যাবেন।
কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে মঞ্জুর দেখলেন, জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পরামর্শ ছাড়া কিছু করেন না। কিছুটা সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক চেতনাধারী হলেও তিনি জিয়াউর রহমান কর্তৃক ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নবাদীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া পছন্দ করেননি। জিয়া যখন আমাদের স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তখন জেনারেল মঞ্জুর তার প্রতিবাদ করেন। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও জিয়াউর রহমানের পাকিস্তানপ্রেম ছিল নির্ভেজাল। ২১ অক্টোবর ২০১০ তারিখের জনকণ্ঠ পত্রিকায় আবদুল মান্নান সাহেব যে লিখেছেন_'জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন এঙ্েিডন্টাল মুক্তিযোদ্ধা', কথাটার সত্যতা জেনারেল মঞ্জুর অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই মঞ্জুরের মতো সফলতম সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে মডার্ন হাম্মুরাবির সংঘাত ছিল সময়ের ব্যাপার এবং একই সঙ্গে অনিবার্যও বটে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ এবং জেনারেল মঞ্জুরের সম্পর্ক ভালো ছিল না। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সেনাপ্রধান কে হবেন_এ বিষয়ে এরশাদ এবং জেনারেল মঞ্জুর ছিলেন একে অপরের প্রতিপক্ষ। জেনারেল এরশাদ আনুগত্যের এমন অভিনয় করলেন যে জিয়াউর রহমান তাঁর একসময়ের প্রচণ্ড শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সহযোদ্ধা মঞ্জুরকে দূরে ঠেলে দিয়ে এরশাদকে কাছে টেনে নিলেন। জিয়াউর রহমান তাঁর অতি মূল্যবান ফটোমেট্রিক সানগ্লাসের কাচের ভেতর দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেও এরশাদের অভিনয় বুঝতে পারলেন না। মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় সাফল্য এবং পাণ্ডিত্যের জন্য মঞ্জুর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে জিয়াউর রহমানের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। এ কারণে জিয়া তাঁকে ভয় করতেন। এরশাদকে বেশ অনুগত এবং সরল মনে করে জিয়া তাঁকে সেনাবাহিনীর প্রধান করলেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যাকাণ্ডে এরশাদ কতটা জড়িত ছিলেন, সে বিষয়ে তথ্যভিত্তিক কিছু বলা যাবে না। তবে জেনারেল মঞ্জুর অবশ্যই জড়িত ছিলেন না। একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে হাম্মুরাবির মতো খেলাতে গিয়ে জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছিলেন_এ অভিযোগ অমূলক কি? জিয়ার হত্যাকাণ্ডে এরশাদ এবং মঞ্জুরের_কে কতটা জড়িত সে বিষয়ে আলোচনা করতে চাই না। যে বিষয়ে বিশদভাবে জানি না, সে বিষয়ে আলোচনা করা অবশ্যই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু মডার্ন হাম্মুরাবির স্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনীতি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলতে চাই।
গত ২৯ অক্টোবর কালের কণ্ঠে 'জিয়ার বিএনপি বনাম আজকের বিএনপি' শিরোনামে এম আবদুল হাফিজ যে লেখাটা লিখেছেন, সেখান থেকে কয়েকটি লাইনের উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। আমাদের দেশের সম্মানিত কলাম লেখকদের মধ্যে এম আবদুল হাফিজ অন্যতম একজন। তিনি লিখেছেন, 'জিয়া সত্যিকার অর্থে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা আওয়ামী লীগের মতো বনেদি দলের সক্ষমতায় পেঁৗছেছিল। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই বিএনপির তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তি ঘটেছে। দুর্বল, অপারগ ও দুর্নীতিপরায়ণ তাঁর উত্তরসূরিরা দলকে খুবলে খুবলে খেয়েছে। ম্যাডাম জিয়া কোনোক্রমেই জিয়ার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। আশ্চর্য নয় যে বিএনপি এত দ্রুত ২০০৬ সালে দলের যে অবস্থান, সেই শোচনীয় পর্যায়ে পেঁৗছেছিল। ...জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের মুখে শুনেছি, ম্যাডাম জিয়ার গৃহবধূর অধিক কোনো পরিচয় ছিল না। তাও আবার তিনি ছিলেন অলস গৃহবধূ, কিন্তু কর্তৃত্ববাদী। এই দুইয়ের সমন্বয় কালেভদ্রে সম্ভব হয়। ...সময়ে বিএনপির অস্তিত্ব সম্পর্কেই ভুলে যেতে হয়।' লেখার শেষপ্রান্তে এসে বলব, জিয়াউর রহমান বাংলার জনগণকে গণতন্ত্রের নামে একটি কাঠের ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন।
===========================
আলোচনা- 'কারাগার থেকে সংশোধনাগার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ' by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু  শিল্প-অর্থনীতি 'ক্ষুদ্রঋণের বিড়ম্বনা' by আহমদ রফিক  আন্তর্জাতিক- 'চীন ও দুর্লভ ধাতু নিয়ে উদ্বেগ' by পিটার কাস্টার্স  আলোচনা- 'সুশাসন-সহায়ক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো' by এ এম এম শওকত আলী  খবর ও ফিচার- 'মুক্তি পেল নীলকণ্ঠ পাখি' by শরীফ খান  প্রকৃতি- 'বাংলাদেশে জীবিকা হারানো মানুষের ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুতি’  আলোচনা- 'প্রসঙ্গ : দুর্নীতি উৎপাটন' by মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম  ইতিহাস- পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পরিচিতি  প্রকৃতি- 'কোপেনহেগেনের বিক্ষোভ' by জোয়ান হ্যারি  আলোচনা- 'আদিবাসীদের সম্পৃক্ত করা দরকার' by ইলিরা দেওয়ান  আলোচনা- 'ভুরকি গ্রামের স্ব্বপ্না বিবি থেকে রুশনারা আলী' by ইফতেখার মাহমুদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'সংবিধান সংশোধন, যুদ্ধাপরাধের বিচার' by শ্যামল সরকার  প্রকৃতি- 'জলবায়ু পরিবর্তন : অদ্ভুত আঁধার এক' by আজাদুর রহমান চন্দন  প্রকৃতি- 'বাঘ রক্ষার বিশ্বসভা রাশিয়ায়' by ইফতেখার মাহমুদ


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আলমগীর সাত্তার
অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন, সাবেক বৈমানিক ও কথাসাহিত্যিক


এই গল্পালোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.