প্রকৃতি- 'কোপেনহেগেনের বিক্ষোভ' by জোয়ান হ্যারি

কোপেনহেগেনে চলমান জলবায়ু সম্মেলন একনজরে আমার কাছে সালভাদর ডালির স্বপ্নের মতো। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের পরনে ভিনগ্রহের কাল্পনিক প্রাণীর পোশাক।

আর হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল_'তোমাদের নেতার কাছে আমাদের নিয়ে যাও। তোমরা কি আমাদের কথা গুরুত্ব দিচ্ছ না?' এর আগে কালো বর্ণের একদল তরুণ স্প্রে ক্যান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল। পরে তারা হিসাব-নিকাশ করে জানাল, কী পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড পৃথিবীর জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে না। এরপর আমার চোখে পড়ল, গরুর আকৃতির পোশাক পরা দুই ব্যক্তি। ঢিল ছোড়ার মতো করে 'গরুর খুর ছোড়া'র অভিযোগে পুলিশ তাদের তাড়া করল।
বাস্তবতা এর চেয়েও অনেক বেশি গভীর ও কলঙ্কজনক। বেলা সেন্টারের ভেতর বিশ্বের ধনী দেশগুলোর নেতারা তাদের নিজ নিজ দেশের বিজ্ঞানীদের সতর্কবাণীও অগ্রাহ্য করছেন। আমাদের এ পৃথিবী নাটকীয়ভাবে বাসযোগ্যতা হারানোর আগে তাকে রক্ষায় কোনো চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছেন তারা। বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, ২০২০ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বকে ১৯৯০ সালের কার্বন নির্গমন মাত্রার ৪০ শতাংশ কমাতে হবে। আর এটা সম্ভব হলেই যে সব বিপদ চুকে গেল তা কিন্তু নয়; কার্বন নির্গমন ওই মাত্রায় রাখা সম্ভব হলে পৃথিবীতে মানুষ বসবাস করতে পারবে। তবে এটাও সত্যি যে, বিশ্বের কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া একবার ভেঙে পড়লে তা আর আগের অবস্থায় ফেরে না। এর অর্থ হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়তেই থাকবে। বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ধনী দেশগুলো কার্বন নির্গমনের মাত্রা যে হারে কমাতে রাজি হচ্ছে, বাস্তবে তা খুব একটা কাজে আসবে না। এটা একধরনের হিসাবের গরমিল। পশ্চিমা দেশগুলো আট থেকে ১২ শতাংশ কার্বন নির্গমনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার চার শতাংশ।
কোপেনহেগেনে বিভিন্ন দেশের নেতারা নিজ নিজ অবস্থানে জোরালো পদক্ষেপ নিলেও ব্যক্তিগতভাবে তারা স্বীকার করছেন, এ আলোচনা শেষ হবে না এবং তা বিশ্বের জন্য ইতিবাচক কোনো ফলও বয়ে আনবে না। মনে হচ্ছে, কোপেনহেগেনে এ সম্মেলন না হলে কিয়োটো ফ্রেমওয়ার্ক আরো বিস্তৃত হতো। কিয়োটোর আওতায় আন্তর্জাতিকভাবে কার্বন নির্গমন মাত্রা নির্ধারণ এবং তা হ্রাসের বিষয়টি আবশ্যিক করা হয়েছে। কিন্তু তা না মানলে যে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা খুবই সামান্য। তবে কিয়োটো প্রটোকল ছিল বিশ্ব রক্ষার প্রথম পদক্ষেপ। কিয়োটোর বর্তমান ধারার মেয়াদ ২০১২ সালে শেষ হবে। তবে ওই চুক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, মেয়াদ শেষে এর কাঠামো ও প্রয়োজনীয়তা আরো জোরালো হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতারা মনে করেন, খুব ইতিবাচক কিছু না হলে অন্তুত কিয়োটো প্রটোকলকে আরো জোরদার করতেই তারা কোপেনহেগেনে সমবেত হচ্ছেন। তবে দীর্ঘ আলোচনার ফসল এ কিয়োটো চুক্তির বদলে যুক্তরাষ্ট্র যে চুক্তির প্রস্তাব করছে, তা কিয়োটো চুক্তির চেয়ে অনেক দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রত্যেক দেশ নিজেই ঘোষণা করবে, দেশটি কী পরিমাণ কার্বন নির্গমন কমাবে। আর দেশটি তা মেনে চলবে নিজের নৈতিক অবস্থান থেকেই। প্রতিশ্রুতি বা ঘোষণা মেনে না চললে কোনো শাস্তির ব্যবস্থা যেমন থাকবে না, তেমনি থাকবে না তদারকির ব্যবস্থাও।
কোপেনহেগেনে বিক্ষোভ যেমন হৃদয়বিদারক, তেমনি উদ্দীপনাপূর্ণ। পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের নৈতিক দেউলিয়াত্ব দেখাচ্ছে; তবে সত্যিকার অর্থে বিশ্বের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ওই সরকারগুলোর মনোভাব পরিবর্তনের পক্ষে চাপ সৃষ্টি করছে। গণমানুষের দাবির মুখে অতীতে অনেক সরকার নিজেদের হারানো নীতি ফিরে পেয়েছে। কোপেনহেগেন সম্মেলনে ইতিবাচক কিছু দেখতে হলে বিশ্বব্যাপী এমন কিছু একটা ঘটাতে হবে। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার আন্দোলনে সোচ্চার এমনই একদল সৈনিক কোপেনহেগেনে সমবেত হচ্ছেন। অযৌক্তিক বা নামমাত্রা কোনো চুক্তির বিরোধিতার সাহস তারা রাখেন। গত শনিবার কোপেনহেগেনে যে বিক্ষোভ হলো, তা বিশ্ব বাঁচানোর দাবিতে একনিষ্ঠ বিশ্বনাগরিকদের প্রয়াস। তাদের হাতে থাকা ব্যানার প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল_'রাজনীতি বদলান, পরিবেশ নয়।' আবার কারো কারো হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল_'জলবায়ু এমন কোনো বস্তু নয়, যা অর্থনৈতিক প্রণোদনার মতো প্যাকেজ দিয়ে রক্ষা করা যাবে।'
কোপেনহেগেনে বিক্ষোভ করতে আসা কেনীয় যুবপ্রতিনিধিদের অন্যতম লরেন্স মুলি জানান, কেনিয়ায় স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ খরা চলছে। সময়ের আবর্তনে এ বছর ঋতু বদলেছে ঠিকই, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারেননি। তার পরিবার আর ফসল ফলাতে পারে না; তাই তাদের ক্ষুধার্ত থাকতে হচ্ছে। কোপেনহেগেনে তিনি জানতে এসেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তিনি, তার পরিবার বা দেশ দায়ী নয়। তিনি চুপচাপ বসে ক্ষুধায় আপনজনের মৃত্যু দেখতে পারেন না।
নেপাল থেকে আসা ভুবন শম্ভু তার দেশে রাতারাতি হিমবাহ গলে যাওয়া দেখেছেন। তারই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেক্সিকো সিটির ম্যানুয়েল উইশার্স জানান, রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিতে তার নিজ শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার কথা। ৭৬ বছর বয়সী জার্মান নারী উটে রিখটার এসেছেন বিবেকের টানে। তিনি বলেন, 'বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে এ কোপেনহেগেন সম্মেলনে। এমন সময় বাড়ি বসে থাকা অনৈতিক হবে। আমরা আমাদের পুরনো পথের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। বাঁচতে হলে আমাদের পথ বদলাতে হবে।'
কোপেনহেগেনের বেলা সেন্টারের আলোচনার টেবিলে দরিদ্র দেশগুলোর প্রতিনিধিদের মুখে একই কথা উচ্চারিত হলো। তারা এমন কোনো চুক্তি করতে চান না, যা তাদের দেশ আরো মরুময় হতে বা আরো ডুবতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের খুব কাছের দেশ টুভালুর নেতারা খুব বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের দেশের অনেক এলাকা এরই মধ্যে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে মৃত্যুই তাদের একমাত্র পরিণতি।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট জি-৭৭-এর মুখ্য আলোচক লুমুম্বা ডি-আপিং বলেন, বিশ্ব নেতারা যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি বিশ্বাস করে, তাহলে তারা চুপ থাকতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে একমুহূর্ত বিলম্ব করার অর্থ হলো বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।
সম্মেলনের শেষ দিনগুলোতে বিক্ষোভ হবে বাইরে ও ভেতরে। মূল সমস্যা পাশ কাটিয়ে প্রতীকী কোনো চুক্তির উদ্যোগ নেয়া হলে প্রস্তাব বা চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে সম্মেলনের ভেন্যু বেলা সেন্টার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন অনেক নেতা। আর এতে বিক্ষোভকারীরা যে উজ্জীবিত হয়ে সম্মেলনের ভেন্যুতে ঢুকতে চাইবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা সত্যি যে, পশ্চিমা গণমাধ্যম বরাবরই বিত্তবানদের স্বার্থ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে। কোপেনহেগেন সম্মেলনের শেষদিকে বিশ্বের গণমাধ্যম এমনটা করলে এর পরিণতি শুভ হবে না। মার্টিন লুথার কিংয়ের স্বপ্নকে বিদ্রুপ করে অনেকে মার্কিন লুজার কিং বলেন। কিন্তু তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। কালো বর্ণের মানুষ আজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আমাদের সবুজের পক্ষে আন্দোলন করে 'গ্রিন প্রেসিডেন্ট' হওয়ার মতো ব্যক্তির অভাব এখনো বিশ্বের পূরণ হলো না।
===================
আলোচনা- 'আদিবাসীদের সম্পৃক্ত করা দরকার' by ইলিরা দেওয়ান  আলোচনা- 'ভুরকি গ্রামের স্ব্বপ্না বিবি থেকে রুশনারা আলী' by ইফতেখার মাহমুদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'সংবিধান সংশোধন, যুদ্ধাপরাধের বিচার' by শ্যামল সরকার  প্রকৃতি- 'জলবায়ু পরিবর্তন : অদ্ভুত আঁধার এক' by আজাদুর রহমান চন্দন  প্রকৃতি- 'বাঘ রক্ষার বিশ্বসভা রাশিয়ায়' by ইফতেখার মাহমুদ  শিল্প-অর্থনীতি 'অবকাঠামোর উন্নয়নে পেছনের সারিতে বাংলাদেশ' by হানিফ মাহমুদ  প্রবন্ধ- 'সাবধান থেকো তাদের থেকে...' by বদিউল আলম মজুমদার  আলোচনা- 'ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-অপুষ্টি ও নির্যাতনের শৃঙ্খলে বন্দি শিশুরা' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- 'এমন ঘটনাও ঘটে'! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী  আলোচনা- 'হাইকোর্টের রায় এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে' by শক্তিপদ ত্রিপুরা 


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্য
লেখকঃ জোয়ান হ্যারি
ভাষান্তর করেছেন মেহেদী হাসান


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.