আলোচনা- 'ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-অপুষ্টি ও নির্যাতনের শৃঙ্খলে বন্দি শিশুরা' by শুভ রহমান

দেশে শতাধিক শিশু জেলে রয়েছে। আদালত তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। জাতীয় দৈনিকগুলোয় এ খবর দেওয়া হয়েছে। খবরটা অনেককে নিশ্চয়ই হকচকিয়ে দেবে। এত শিশু জেলে! শিশুরা জেলে কেন!

ভিক্টর হুগোর, লা মিজারেবল-এ জাঁ ভালজাঁর কিশোর বয়স থেকে অপরাধ করে বারবার জেল খাটার, সামাজিক বৈষম্য, বিধিনিষেধ ভাঙার ভাগ্যবিড়ম্বনার মর্মস্পর্শী কাহিনী বিধৃত হয়েছে। সেটা ছিল ৪০০ বছর আগেকার ফরাসি সমাজ। কিন্তু আজও পৃথিবীর দেশে দেশে অমন ক্ষুধা-দারিদ্র্য, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নির্যাতনের অসহায় শিকার হওয়া শিশু-কিশোরদের জীবন শুধু অকালেই ঝরে যায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, আশ্রয়, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, মানুষের মতো বাঁচার অধিকার-বঞ্চিত অগণিত শিশু আমাদের সমাজেও যুগ যুগ ধরে গুমরে মরছে।
সম্প্রতি মিডিয়ায় এমন ছিন্নমূল শিশুদের করুণ সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে, যারা ঘুমের ভেতর শুধু 'মা', 'মা' বলে ডুকরে ওঠে। আমাদের শিশুরা শুধু অধিকার-বঞ্চিতই নয়, তারা উৎপীড়িত, অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, ধর্ষিত এবং এমনকি নিষ্ঠুরভাবে হত্যারও অসহায় শিকার হয়ে থাকে। অথচ শিশুরাই হচ্ছে একটি দেশের প্রকৃত উন্নতির মাপকাঠি। যে দেশের শিশুরা অবহেলিত, নির্যাতিত, সে দেশ কোনোক্রমেই উন্নত নয়।
দেশ গড়তে হলে দেশে শিশুদের স্বর্গ গড়তে হবে। একসময় সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দেশগুলোয় শিশু ও নারীদেরই সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিক গণ্য করা হতো। তাদের ছিল সর্বত্র সবচেয়ে মর্যাদার আসন, অবাধ প্রবেশাধিকার। শিশুদের সংগঠন ইয়ং পাইওনিয়ার আন্দোলন অভিনব দেশ ও ধরণী গড়ে তোলার কাজে ব্রতী ছিল। পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করার অঙ্গীকার ছিল ইয়ং পাইওনিয়ারদের। আমাদের দেশেও খেলাঘর, কচিকাঁচার মেলা_এসব সংগঠন সেই অঙ্গীকার নিয়েই কাজ করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তারা তাদের অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
পঞ্চাশের দশকে রাজকাপুরের 'আওয়ারা' ছায়াছবিতে সমাজের দুর্বৃত্তদের প্ররোচনায় এক কিশোরের অপরাধপ্রবণ ও ভবঘুরে হওয়ার করুণ উপাখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। সমাজজীবনটা এমনই। কেউই অপরাধী হয়ে জন্মায় না। আর্থসামাজিক অবস্থাই তাকে দুর্বৃত্ত ও অপরাধী করে তোলে। আমাদের কালের কণ্ঠের প্রতিবেদকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে রেললাইনের বস্তির ঘরের ছেলেদের হেরোইন বিক্রি করে দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবার আর অসুস্থ বাবার সংসারে অর্থ জোগানোর কী নিষ্ঠুর বাস্তব চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। তাদের জীবনে লেখাপড়া শেখার সুযোগ নেই। এ রকম পরিবার শত শত। এ দেশ কী করে শিশুদের বাসযোগ্য হবে। কবে হবে! সমাজে স্বাধীনতার আগের অবস্থাই এখনো চলছে। দিন দিন আরো নরক হয়ে যাচ্ছে এ সমাজ। এখানে দুর্বৃত্ত, অপরাধী তৈরি হবে না তো কী হবে!
শিশুশ্রম এখানে আইনত নিষিদ্ধ হলেও গৃহকর্মী, হোটেল-রেস্টুরেন্টের বয়-বেয়ারা, মুটে-মজুর, বুটপলিশের কাজ, বাস কন্ডাক্টর ও হেলপার_এমনি নানা কায়িক শ্রমের জীবিকায় নিয়োজিত থেকে শিশু-কিশোররা শৈশব-কৈশোরেই তাদের জীবনের সব সম্ভাবনা নিঃশেষ করে দিচ্ছে। সমাজের এ আইন লঙ্ঘন ওপেনসিক্রেট, এ জন্য সমাজকে দণ্ডিত হতে হচ্ছে না। অপরাধ জগতের প্ররোচনায় শিশু-কিশোররা চুরি-ছিনতাই, মাদক ও অস্ত্র বহন এবং বিক্রি, খবর আদান-প্রদানকারীসহ বিভিন্নমুখী অপরাধকর্মে জড়িত থেকে বলতে গেলে সমাজের একরকম জ্ঞাতসারেই অপরাধ জগতকে জিইয়ে রেখেছে। অনেক অপরাধের ক্ষেত্রেই প্রকৃত ও মূল অপরাধীরা ঠিকই সরে পড়ে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারানির্যাতন ভোগ করতে হয় শিশু-কিশোরদের, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা পরিস্থিতির শিকার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পক্ষে মামলা লড়ার কেউ থাকে না।
শিশুরা অবস্থার চাপে কিংবা ঘটনাচক্রে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং অসহায়ভাবে জেল খাটে। জেল থেকে তারা বেরোয় আরো বড় দাগি অপরাধী হয়ে। সংশোধনকেন্দ্র বা ভবঘুরে কেন্দ্রেও শিশুরা অপরাধ-প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে পারে না, বরং নেশাসক্ত ও আরো অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। এটাই রূঢ় সমাজ বাস্তবতা। এ অবস্থাটা দেশ পরিচালকরা বিলম্বে হলেও হয়তো উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। গেল বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সহযোগী দৈনিকের খবরে প্রকাশ, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক দেড় শতাধিক শিশু-কিশোরের অবস্থার উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্যাবিনেট সচিবের নেতৃত্বাধীন উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স আটক শিশুদের পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা দেওয়া, তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য 'সেফ হোম'-এ প্রেরণ এবং দ্রুত মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। সে সময় খবরটিতে আগের বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের ছয় বিভাগের অধীন কারাগারগুলোয় শিশুবন্দির সংখ্যা ১৯১ থাকার কথা বলা হয়। এরপর তিন মাসে ২৭ জন শিশু মুক্তি পায়। ফলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বন্দি শিশুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৪। আইনগতভাবে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত শিশুদের সেফ হোমে রেখে উপযুক্তভাবে বিকাশ অব্যাহত রাখতে টাস্কফোর্স নির্দেশ দিয়েছে বলে গেল বছরের ওই খবরে উল্লেখ করা হয়।
এখন দেড় বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর মহামান্য হাইকোর্টের একটি সুয়োমোটো রুলিংয়ের ওপর প্রদত্ত রায়ে জানা যাচ্ছে, দেশের জেলখানাগুলোয় শতাধিক বন্দি শিশু রয়েছে। আদালত তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে শিশুদের যেকোনোভাবে জেলে রাখাই অবৈধ ঘোষণা করেন। বিচারপতি মো. ইম্মান আলী এবং বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, '১৮ বছরের কম বয়সী শতাধিক শিশু নিরাপদ হেফাজতের নামে জেলে রয়েছে।'
উল্লেখ্য, সম্প্রতি জাতিসংঘের দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সীরা হচ্ছে শিশু। এ সংজ্ঞা বর্তমানে বাংলাদেশেও প্রযোজ্য।
এ প্রসঙ্গে কারা নির্যাতনসহ সব ধরনের নির্যাতন থেকে শিশুদের মুক্ত রাখার জন্য জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের 'অনুচ্ছেদ ৩৭'-এ যেসব ধারা উলি্লখিত হয়েছে, সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হচ্ছে :
(ক) কোনো শিশুকে নির্যাতন কিংবা অন্য নিষ্ঠুর, অমানবিক কিংবা অবমাননাকর পীড়ন বা শাস্তি দেওয়া যাবে না। ১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের অপরাধের দরুন মুক্তির সম্ভাবনা ছাড়া মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, কোনোটাই দেওয়া যাবে না। (খ) কোনো শিশুকেই বেআইনি বা যথেচ্ছভাবে স্বাধীনতাবঞ্চিত করা যাবে না। শিশুর গ্রেপ্তার, ডিটেনশন বা কারাদণ্ডদান আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে এবং তা শুধু শেষ পন্থা হিসেবেই এবং যথাযথভাবে সবচেয়ে কম সময়ের জন্যই দেওয়া যাবে। (গ) স্বাধীনতাবঞ্চিত সব শিশুকেই (মেয়ে বা ছেলে) তার বয়সী ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়ী মানুষের সহজাত মর্যাদার প্রতি মানবিক সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। বিশেষভাবে শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থে করা উচিত বিবেচিত না হলে স্বাধীনতাবঞ্চিত সব শিশুকেই প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখতে হবে এবং ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে চিঠিপত্র বা দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে শিশুর (ছেলে বা মেয়ে) পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার অধিকার থাকবে। (ঘ) স্বাধীনতাবঞ্চিত সব শিশুরই (ছেলে বা মেয়ে) আদালতে দ্রুত আইনি বা অন্য যথাযোগ্য সহায়তা পাওয়া ও (ঙ) স্বাধীনতাবঞ্চিত সব শিশুরই (ছেলে বা মেয়ে) আদালতে কিংবা অন্য উপযুক্ত, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের কাছে তার বঞ্চনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দ্রুত আইনি বা অন্য যথাযথ সহায়তা ও এ জাতীয় যেকোনো কার্যক্রমে ত্বরিত সিদ্ধান্ত লাভের অধিকার থাকবে।
শিশুদের কারামুক্তির ব্যাপারে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের উপর্যুক্ত ধারাগুলো অনুসৃত হবে, এটাই কাম্য।
আমাদের সমাজে শিশুরা এমনিতেই নিজ নিজ পরিবারের সদস্য হিসেবে দারিদ্র্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি ও শোষণ-নির্যাতনের অসহায় শিকার হয়ে রয়েছে। তাদের নিজেদের পক্ষে আলাদাভাবে সেসব থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো উপায় নেই। একটি সত্যিকার শিশুবান্ধব, দায়িত্বশীল ও গণতান্ত্রিক সরকারই পারে শিশুদের জন্য বিশেষ মানবিক পরিবেশ সৃষ্টি করে সমাজের অবহেলা, বৈষম্য, অপরাধ ও দুর্বৃত্তায়ন থেকে তাদের রক্ষা করতে এবং দেশের ভবিষ্যৎ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। কারামুক্তিসাপেক্ষে সেফ হোমে রাখার পরও তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে যায়। শুধু প্রিভিলেজড বা সুবিধাভোগী শ্রেণীর শিশুদের উন্নত ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা কখনোই ডিজিটাল বাংলাদেশ বা রূপকল্প ২০২১ গড়ার নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে না।
সুখের কথা, সম্প্রতি শেখ রাসেলের ৪৭তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, 'প্রতিটি শিশুর সুন্দর নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করার জন্য চেষ্টা করছি আমরা। এ জন্য শিশু নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কোনো শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আমরা চাই না কোনো শিশু তার মৌলিক অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হোক। ছিন্নমূল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াক।' শিশুর মানসিক বিকাশের স্বার্থে তিনি রাজধানীতে ফ্ল্যাট নির্মাতাদের শিশুদের জন্য খেলাধুলার পর্যাপ্ত জায়গা রেখে ফ্ল্যাট নির্মাণের আহ্বান জানান।
আমরা দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি, দেশে শিশুদের সুন্দর ভুবন গড়াই সুন্দর দেশ গড়ার পূর্বশর্ত।
২৬.১০.২০১০
========================
গল্পালোচনা- 'এমন ঘটনাও ঘটে'! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী  আলোচনা- 'হাইকোর্টের রায় এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে' by শক্তিপদ ত্রিপুরা  আলোচনা- 'আইন'-এর শাসন বনাম 'অহং'-এর শাসন' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  খবর- কজাহাজভাঙা শিল্পে সংকটমোচন  আলোচনা- 'বাংলাদেশের সংবিধানের দর্শনের গল্পসল্প' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ও পঙ্কিল রাজনীতি  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মুক্ত বাতাসে সু চি' by রফিকুল রঞ্জু  বিশ্ব অর্থনীতি 'জি-২০ সম্মেলনে ধাক্কা খেল আমেরিকা'  ভ্রমণ- 'রেলগাড়িতে চড়ে' by মঈনুস সুলতান  'উৎসবের আমেজ সময়ের সংস্কৃতির' by শামসুজ্জামান খান  গল্প- 'কাজল রানীর হারেম' by পাপড়ি রহমান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'এক-এগারোর প্রেতাত্মা চারপাশেই ঘুরছে by আবেদ খান  খবর- মহাজোট আছে মহাজোট নেই!' by পার্থ প্রতীম ভট্টাচায্য  আলোচনা- 'বাঙ্গালির বদলে যাওয়া' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  খবর- আফগানিস্তান শান্তি কত দূর?' by তৌহিদ আজিজ  গল্প- 'ঝল্সে ওঠে জরিণ ফিতা' by রফিকুর রশীদ  ফিচার- ‘আক্রান্ত' by জাফর তালুকদার


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্য
লেখকঃ শুভ রহমান


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.