রাজনৈতিক আলোচনা- 'সংবিধান সংশোধন, যুদ্ধাপরাধের বিচার' by শ্যামল সরকার

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার  তাদের পাঁচ বছরের শাসন আমলে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। একটি সংবিধান সংশোধন, অপরটি যুদ্ধাপরাধের বিচার। সরকারের নীতিনির্ধারক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পাঁচ দফায় বলা আছে, ‘রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিষিদ্ধ করা হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা হবে।’ প্রকৃতপক্ষে এই ব্যবস্থা ১৯৭২ সালের সংবিধানে থাকলেও ১৯৭৮ সালের সামরিক ফরমানবলে সংশোধিত সংবিধানে এ সুযোগ রহিত করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সরকার বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বললেও অবিকল তা সম্ভব কি না সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তবে মৌলিক জাতীয় উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কিছু সংশোধনী আনার বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। এ বিষয়ে ভেতরে ভেতরে প্রশাসনিক প্রক্রিয়াও চলছে।
সংশোধনীগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতির প্রতিস্থাপন। যার মধ্য দিয়ে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়কে সরকার ভিত্তি ধরেই এগোতে চায়। যদিও হাইকোর্টের রায় ও পর্যবেক্ষণ—দুটি ভাগ রয়েছে। পর্যবেক্ষণ অংশ বাস্তবায়নে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সরকার ইচ্ছা করলে এর সুযোগ নিতে পারে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
প্রসঙ্গত, পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে করা আপিলের ওপর ৩ জানুয়ারি শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের পর সরকার আপিল করতে না চাওয়ায় বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এতে পক্ষভুক্ত হয়ে আপিল করেন।
এদিকে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সচেতন মহলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধর্মকে অপব্যবহার করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিপক্ষে অনেকের মত থাকলেও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব আছে। গত ৩৮ বছরে অনেক কিছুই সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে, যার সবগুলো বাদ দেওয়া হলে মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, অনেকগুলো এতটাই স্পর্শকাতর যে বাদ দেওয়ার কারণ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে এখনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। তাই হুট করে তা করা হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খানের মতে, সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সংবিধান সংশোধন করা এ সরকারের জন্য সহজ কাজ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসংবলিত সংবিধান জাতির আকাঙ্ক্ষা। তিনি বলেন, ৩৮ বছরে সংবিধানকে এমনভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে, যার অনেক কিছুই জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। তাঁর মতে, অনেক স্পর্শকাতর বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত আছে। আবার আজকের বাস্তবতায় অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয়ও রয়ে গেছে। সে জন্য বারবার সংবিধান সংশোধনের মতো কাজে হাত না দিয়ে একটি কমিশন বা কমিটি করে সংবিধান পর্যালোচনা করে যা দরকার তা একটি সংশোধনীর মাধ্যমে করার পক্ষে মত দেন তিনি। তবে তিনি এও বলেন, সংবিধান সংশোধন সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে যা হবে: সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ৮(১) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতির বিষয়ে বাহাত্তরের সংবিধানে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র। ১৯৭৮ সালে সামরিক ফরমানবলে এই মূল নীতি পরিবর্তন করে বলা হয়, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অর্থাত্ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার।’
সামরিক ফরমানবলে পরিবর্তিত সংবিধানে ৮(১)ক অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়। এতে বলা হয়, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি।’ বাহাত্তরের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মীয় অপব্যবহার এবং (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য ও তার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে।’
আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সামরিক ফরমানবলে (যা পরে পঞ্চম সংশোধনীতে বৈধ করা হয়) ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে দেওয়ায় জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। তাঁর মতে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত হবে। এ ছাড়া পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে ’৭৯-এর ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জারি করা সব সামরিক ফরমান বাতিল হবে। তবে এসব ফরমানের অধীনে গৃহীত বা বাস্তবায়িত কার্যক্রমকে আদালত ‘পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড’ করায় বাস্তবায়িত কাজ বা গৃহীত পদক্ষেপ অক্ষুণ্ন থাকবে।
এ ছাড়া ১৯৭৮ সালে সামরিক ফরমানবলে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ পুরোপুরি বিলুপ্ত করা হয়। বাহাত্তরের সংবিধানে এই অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধসাপেক্ষ শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।’
ওই অনুচ্ছেদে এরপর উল্লেখ করা হয়, তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করার বা তার সদস্য হওয়ার বা অন্য কোনো প্রকারে তার তত্পরতায় অংশগ্রহণ করার কোনো ব্যক্তির অধিকার থাকবে না। ১২ এবং ৩৮ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করার সুবাদে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ও রাজনৈতিক দল রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। সরকার এই অনুচ্ছেদগুলো পুনঃস্থাপন করবে।
সরকার যা সংশোধন করতে চায়: সরকার মূলত কয়েকটি মৌলিক ক্ষেত্রে সংবিধান পরিবর্তন করতে চায়। এর মধ্যে চার রাষ্ট্রীয় মূল নীতি অন্যতম। ধর্মের অপব্যবহার করে রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করারও চিন্তা রয়েছে সরকারের। স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করা হয়। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদে অতিরিক্ত ২(ক) অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হবে। তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে। সরকারের মধ্যে কেউ কেউ এটিও সংশোধনের পক্ষে। তবে সবকিছু একবারে করা নিয়ে দ্বিমত আছে। সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের সঙ্গে কথা বলে এ রকম মতামত পাওয়া গেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের প্রথম অধিবেশনে সমাপনী ভাষণে বাহাত্তরের সংবিধান প্রবর্তনে সরকারের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন। আইনমন্ত্রী একাধিকবার বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন। আইনমন্ত্রী প্রথম আলোকে সম্প্রতি বলেছেন, তাঁরা অপেক্ষা করছেন পঞ্চম সংশোধনীর বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য। তিনি বলেন, নতুন বছরে সরকারের অগ্রাধিকার থাকবে সংবিধানের মৌলিক ক্ষেত্রে ফিরে যাওয়া।
সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, সংবিধানে সংযোজিত ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অপরিবর্তিত থাকবে। তবে একই সঙ্গে তিনি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতির কথাও ব্যক্ত করেন।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজ্ঞ এম জহির প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান সংশোধন এ সরকারের জন্য সহজ কাজ। কারণ এ জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংসদে তাদের রয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ—এটি সর্বোচ্চ আদালতে নিশ্চিত হলে সরাসরি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্ভব কি না, সে সম্পর্কে পুরো রায় কী হয়, তা দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আইন বিশেষজ্ঞ ও সরকারের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলেও সরাসরি ১৯৭২ সালের সংবিধান বলবত্ হবে না। এ জন্য অনেক সংশোধনী আনতে হবে। কারণ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তাতে সামরিক আইন জারি করে সংবিধান সংশোধন করাকে অবৈধ বলা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তার মতে, পঁচাত্তরে জারি করা সামরিক আইন বা ফরমান দিয়ে সংবিধানের যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে, তাও অবৈধ। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে চতুর্থ সংশোধনী (যা কার্যত ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যম অকার্যকর হয়েছে) পুনরুজ্জীবিত হবে কি না, সেটাও আরেকটি বিতর্কের বিষয় হতে পারে। সে জন্য সরকারকে আগে ঠিক করতে হবে কী কী ক্ষেত্রে সরকার সংশোধন চায়। সে অনুযায়ী নতুন বিল আনতে হবে সংসদে।
প্রসঙ্গত, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত করা হয়।
যুদ্ধাপরাধের বিচার: সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, সংবিধান সংশোধন করেই সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাজে হাত দিতে আগ্রহী। কারণ এতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের ভাষায় চিহ্নিত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। নিষিদ্ধ দলের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে বলে সরকার মনে করছে।
সূত্র বলছে, সম্ভব হলে নতুন বছরে অনুষ্ঠেয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সংবিধান সংশোধন বিল উত্থাপন ও পাস করার চিন্তাভাবনা রয়েছে সরকারের ভেতরে। যদিও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে সংশ্লিষ্ট কেউ রাজি হননি।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সরকার অবশ্য আগামী মার্চ নাগাদ ট্রাইব্যুনাল ও তদন্ত কর্তৃপক্ষের নাম ঘোষণা করে আনুষ্ঠানিক তদন্তকাজ শুরু করবে বলে জানা গেছে। আইনমন্ত্রী ইতিমধ্যে এমন কথাও বলেছেন। ইতিমধ্যে বিচারের জন্য পুরোনো হাইকোর্ট ভবনকে চূড়ান্ত স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বছরের শুরুতেই জাতির আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়ে যাবে।
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, সব প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। বিদেশি পর্যবেক্ষক কারা কীভাবে আসবেন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিতে ইতিমধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাহাত্তর সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি এখন সরকারের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ।
পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় ও পর্যবেক্ষণ: সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জারি করা সব ধরনের ফরমান আদালত অবৈধ ঘোষণা করেন। রায়ে ১৯৭৫ সালে খোন্দকার মোশতাক আহমেদ, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ এবং সামরিক শাসন জারি অবৈধ ও সংবিধানপরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করেন আদালত।
তবে আদালত ওই সময়ে জনকল্যাণে নেওয়া রাষ্ট্রপতি বা সামরিক আইন প্রশাসকের সব কার্যক্রমকে সমুন্নত (পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড) করেছেন।
২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই রায় দেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবীরা হাইকোর্টের এই রায়কে ঐতিহাসিক হিসেবে অভিহিত করেন।
মুন সিনেমা হলের মালিক মাকসুদুল হক তাঁর সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার জন্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে আদালত এই রায় দেন। মুন সিনেমা হলের মালিক পঞ্চম সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ২০০০ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
১৯৭২ সালে পুরান ঢাকার মুন সিনেমা হল পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এটি পরিচালনা করত। কিন্তু ১৯৭৫ সালে পরিত্যক্ত সম্পত্তি সম্পর্কিত সরকারি কমিটি একে পরিত্যক্ত নয় বলে ঘোষণা করে। ১৯৭৭ সালের সামরিক শাসনবিধির ৭ ধারা অনুযায়ী সরকারের সব কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হয়। ফলে মুন সিনেমা হলের মালিকানা ফেরত না দেওয়াও বৈধ হিসেবে উল্লেখ করে মালিকানা দেওয়া হয়নি।
পঞ্চম সংশোধনীর ফলে মুন সিনেমা হলের মালিক সামরিক আদেশের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেননি। এ অবস্থায় তিনি তাঁর সম্পত্তি ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদ সংবিধানকে হেয় করেছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯-এর ৯ এপ্রিল সময়ে সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে তা অবৈধ।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, সংবিধান লঙ্ঘন আইনের এক বিশাল ভ্রান্তি। এটা পরম্পরা হিসেবে থেকেই যায়, যা অনুচিত।
আদালত সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩(ক) অনুচ্ছেদ সংবিধানপরিপন্থী হিসেবে ঘোষণা করেন। এই তফসিলে ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি সম্পর্কে কতিপয় ফরমান বৈধকরণ ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
আদালত বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ সংবিধানবহির্ভূত ও বেআইনি। একইভাবে ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা হস্তান্তরও অবৈধ। আদালত বলেন, বিচারপতি সায়েমের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণ ও তাঁকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ এবং জিয়াউর রহমানকে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগও সংবিধানবহির্ভূত। তাঁদের সব ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগও অবৈধ হিসেবে উল্লেখ করেন আদালত।
পর্যবেক্ষণে আদালত ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর সামরিক শাসন জারিকেও সংবিধানবহির্ভূত ও অবৈধ হিসেবে উল্লেখ করেন।
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ সংবিধানের সীমাবহির্ভূত। তাঁর এই নিয়োগ বেআইনি, সংবিধানবহির্ভূত ও অবৈধ।
============================
প্রকৃতি- 'জলবায়ু পরিবর্তন : অদ্ভুত আঁধার এক' by আজাদুর রহমান চন্দন  প্রকৃতি- 'বাঘ রক্ষার বিশ্বসভা রাশিয়ায়' by ইফতেখার মাহমুদ  শিল্প-অর্থনীতি 'অবকাঠামোর উন্নয়নে পেছনের সারিতে বাংলাদেশ' by হানিফ মাহমুদ  প্রবন্ধ- 'সাবধান থেকো তাদের থেকে...' by বদিউল আলম মজুমদার  আলোচনা- 'ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-অপুষ্টি ও নির্যাতনের শৃঙ্খলে বন্দি শিশুরা' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- 'এমন ঘটনাও ঘটে'! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী  আলোচনা- 'হাইকোর্টের রায় এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে' by শক্তিপদ ত্রিপুরা  আলোচনা- 'আইন'-এর শাসন বনাম 'অহং'-এর শাসন' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  খবর- কজাহাজভাঙা শিল্পে সংকটমোচন  আলোচনা- 'বাংলাদেশের সংবিধানের দর্শনের গল্পসল্প' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ও পঙ্কিল রাজনীতি  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মুক্ত বাতাসে সু চি' by রফিকুল রঞ্জু  বিশ্ব অর্থনীতি 'জি-২০ সম্মেলনে ধাক্কা খেল আমেরিকা'  ভ্রমণ- 'রেলগাড়িতে চড়ে' by মঈনুস সুলতান  'উৎসবের আমেজ সময়ের সংস্কৃতির' by শামসুজ্জামান খান

প্রথম আলো এর সৌজন্য
লেখকঃ শ্যামল সরকার


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.