আলোচনা- 'আইন'-এর শাসন বনাম 'অহং'-এর শাসন' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

কিছু দিন আগে বাসায় এসে নেওয়া ইটিভি চ্যানেলে আমার এক সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। সেটি ছিল চ্যানেলটির নিয়মিত সংবাদ-প্রচার অনুষ্ঠানের ক্ষুদ্রাংশ হিসেবে। কিন্তু সেভাবে

তো সাক্ষাৎকার দিইনি। ফলে আমার পুরো বক্তব্যে উত্থাপিত সব কয়টি যুক্তি পরিবেশিত না হওয়ায় প্রচারিত আমার বক্তব্য সম্ভবত শ্রোতাদের কাছে স্পষ্ট হয়নি। সাক্ষাৎকারটিতে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি ইজারা দেওয়া কী আইনানুগ ছিল? প্রশ্নটির কী প্রেক্ষাপট, প্রিয় পাঠক, আপনার নিশ্চয়ই ধারণায় এসেছে। হ্যাঁ, সেটা ছিল ওই ইজারা দেওয়ার আগাগোড়া কার্যক্রম বেআইনি_এই সিদ্ধান্ত দেওয়া হাইকোর্ট বিভাগের রায়টিই। প্রিয় পাঠক, সাক্ষাৎকারটি না দিতে হলে আমার এ লেখাটির জন্ম হতো না।
ইজারার বিষয়বস্তু হচ্ছে, ঢাকা সেনানিবাসের অন্তর্গত একটি বাড়ি, যেটা যদিও ছিল বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর উপপ্রধানের সরকারি বাসভবন। কিন্তু যখন জিয়া চট্টগ্রামে নিহত হন, তখন তিনি সেটাতে সপরিবারে বসবাস করতেন, অথচ বঙ্গভবনে তাঁর বসবাস করার কথা। যদি তাঁর বসবাস অস্বাভাবিক না হয়ে যথাস্থানে থাকত, তাহলে তর্কিত বাড়িটি তাঁর বিধবা স্ত্রীকে ইজারা দেওয়ার কথা আদৌ উঠত না। আর তখন জিয়ার স্মৃতিবিজড়িত বঙ্গভবন হলেও সেটা ইজারা দেওয়ার কথাও উঠত না। সে অবস্থায় যা আইন ও ন্যায়সঙ্গত উভয়ই হতো, সেটাই তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ করেছিলেন। তাঁরা গুলশান এলাকায় দেড় বিঘা জমিসহ একটি বাড়ি (সম্ভবত সেটা তখন পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের দখলে ছিল) খালেদা জিয়াকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং সেটা কার্যকর করেছিলেন। সে বাড়িটির এখন মালিক খালেদা জিয়া। এদিকে তৎকালীন সেনাপ্রধান তর্কিত বাড়িটিও খালেদা জিয়ার অনুকূলে বার্ষিক এক টাকা খাজনা প্রদানে ইজারা দেওয়ার প্রস্তাব করেন এবং সেটির গতানুগতিক সম্মতি দেওয়ার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠান। তৎকালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আব্দুস সাত্তার এবং তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি থাকার কারণে জিয়া নিহত হওয়ায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন। অতঃপর তর্কিত বাড়িটি খালেদা জিয়ার অনুকূলে ইজারা দেওয়া হয়।
এখন হাইকোর্ট বিভাগের রায়টির কথা বলা যাক। সরকার কর্তৃক ওই ইজারা বাতিল করার আদেশের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করেন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করা তাঁর সংবিধানে প্রদত্ত অধিকার, যা সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের ২ দফায় বিস্তারিত উল্লেখ আছে। রিট এখতিয়ার কালক্রমে বিভিন্ন প্রতিকূল ও অনুকূল পরিস্থিতির ফলস্বরূপ অবশেষে সুনির্দিষ্ট হয় এবং তারই পরিপক্ব রূপটি বাংলাদেশের সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের ২ দফায় গ্রহণ করা হয়েছে। সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি এই : ''সুপ্রিম কোর্ট একটি 'কোর্ট অব রেকর্ড' হইবেন এবং ইহার অবমাননার জন্য তদন্তের আদেশদান বা দণ্ডাদেশদানের ক্ষমতাসহ আইন সাপেক্ষে অনুরূপ আদালতের সকল ক্ষমতার অধিকারী থাকিবেন।" 'কোর্ট অব রেকর্ড' পরিভাষার অর্থ হচ্ছে, যেখানে বিচারসংক্রান্ত কার্যাবলি সংরক্ষিত হয় পার্চমেন্ট কাগজে চিরস্থায়ী স্মারক ও প্রামাণিক সাক্ষ্যের উদ্দেশ্যে, সেগুলোকে বলা হয় কোর্টের রেকর্ডসমূহ, যেগুলো এমনতরো গুরুত্বপূর্ণ ও অতিশ্রদ্ধেয় কর্তৃত্ববহ যে তাদের যথার্থতাকে প্রশ্ন করা যায় না। ইতিপূর্বে বলেছি, রিট আবেদন করা একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। তেমনি বলা যায়, রিট আবেদনে প্রদত্ত রায়টি মান্য করা একজন নাগরিকের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি এই : 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত সকল নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্র্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সহায়তা করিবেন।' সে জন্য ইতিপূর্বে সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয়েছে কোর্ট অব রেকর্ড এবং সহায়তা অর্থ মান্য করা।
এখন হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায়টির পর্যালোচনা করা যাক। ১৯৩৭ সাল থেকে অদ্যতক কার্যকর 'সেনানিবাস ভূমিপ্রশাসন বিধিমালা' অনুযায়ী উপরিউক্ত ইজারা দেওয়া সম্পত্তিটি এ শ্রেণীভুক্ত ও সে কারণে আদৌ হস্তান্তরযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, সম্পত্তিটি উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার চাকরিকালীন সরকারি বাসভবন হিসেবে নির্দিষ্ট। তৃতীয়ত, সম্পত্তিটির ইজারা-দলিলে দাতা হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান, যাঁর সেনানিবাসের অন্য কোনো সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষমতা নেই এবং এ শ্রেণীভুক্ত সম্পত্তি তো হস্তান্তরের কথা উঠতেই পারে না। চতুর্থত, রাষ্ট্রের কোনো সম্পত্তি যাকে ইচ্ছে যেকোনো মূল্যে দেওয়ার ক্ষমতা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রপতিরও নেই। পঞ্চমত, একই ব্যক্তিকে একই কারণে কিংবা বিভিন্ন কারণে রাষ্ট্রের দুটি সম্পত্তি দেওয়া যায় না। সম্ভবত, উপরিউক্ত যুক্তিসংগত কারণে হাইকোর্ট বিভাগের রিট বেঞ্চ কর্তৃক দেওয়া রায়ে খালেদা জিয়ার রিট আবেদনপত্র ডিসমিস করা হয়েছে।
এতদসত্ত্বেও তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রায়টির বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন। এটা তাঁর সংবিধানে প্রদত্ত অধিকার। সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদের ১ দফার উদ্ধৃতি এই : 'হাইকোর্ট বিভাগের রায়, ডিক্রি, আদেশ বা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির ও তাহা নিষ্পত্তির এখতিয়ার আপিল বিভাগের থাকিবে।' উল্লেখ্য, খালেদা জিয়া যদি আপিল দায়ের করেন সেটি ১০৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফা অনুযায়ী 'কেবল আপিল বিভাগ আপিলের অনুমতিদান করিলে সেই মামলায় আপিল চলিবে।' অর্থাৎ হাইকোর্টের রায়ে আইনি কোনো অসংগতি কিংবা ত্রুটি দেখাতে না পারলে আপিল বিভাগ কর্তৃক আপিলটি সরাসরি ডিসমিস হবে। সুতরাং তর্কিত ইজারা বৈধ কিংবা অবৈধ, সেটা চূড়ান্ত জানার জন্য জনগণকে অপেক্ষা করতে হবে এবং আপিল বিভাগ যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সবাইকে মান্য করতে হবে। এটাই 'আইন'-এর শাসন। এই শাসনই সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ার একমাত্র ভিত্তি।
প্রিয় পাঠক, এখন আপনাকে এই লেখাটির শিরোনাম লক্ষ করার জন্য অনুরোধ করব। আপনার বোধে নিশ্চয়ই এসেছে, শিরোনামটি দ্বারা আমি কী বোঝাতে চেয়েছি। হ্যাঁ, আইনের শাসন বিপর্যস্ত করে থাকে 'অহং'-এর শাসন। অহং অর্থ আমিত্ব-জ্ঞানসম্পন্ন সত্তা, যার মধ্যে খুঁটা গাড়ে অহংকার, অহমিকা, অহংসর্বস্ব-ভাব, যার ইংরেজি ভাষার প্রতিশব্দ হচ্ছে 'ইগো-ইজম', যা যুক্তিশীলতাকে খেদিয়ে দেয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ এখনো হতদরিদ্রদের দেশ এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বেড়িবাঁধ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এই সমাজব্যবস্থা, মানবেন্দ্র রায় তাঁর লেখা 'দ্য প্রবলেম অব ফ্রিডম' (স্বাধীনতার সংকট) বইটিতে লিখেছেন, ব্যক্তিমানুষকে একাকিত্বের পথে নিয়ে যায়। এই মারাত্মক একাকিত্বতা থেকে উদ্ধার করার ধাপ্পা দিতে ফ্যাসিবাদীরা রাষ্ট্রীয় একনায়কত্বের গুণগান করে এবং অবশেষে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যক্তিমানুষকে গ্রাস করে ফেলে।
প্রিয় পাঠক, সবশেষে 'চিরন্তন বোঝা' নামে একটি অনূদিত বিদেশি গল্প সংক্ষেপ করে শোনাই। খলিফা হাকাম জাঁকজমক খুব ভালোবাসতেন। তিনি তাঁর প্রাসাদ আরো বড় করতে ইচ্ছে করলেন। তিনি আশপাশের সব জমি কিনে নিলেন। কাছেই থাকতেন দরিদ্র এক বিধবা মহিলা। তিনি কিছুতেই তাঁর জমি বেচতে রাজি হলেন না। খলিফার খুব রাগ হলো। তিনি জোর করে বিধবার জমি দখল করে নিলেন। মহিলাটি কাঁদতে কাঁদতে বিচারপতির কাছে গিয়ে নালিশ করলেন। সে সময় ইবনে বেশ্শির ছিলেন জেলার বিচারক। তিনি নালিশ শুনলেন। আইনের চোখে বিধবার পক্ষেই রায় হওয়ার কথা। কিন্তু খলিফাকে সামাল দেওয়া কঠিন হবে। কেননা তিনি তাঁর মর্জিমাফিক কাজ করতে চান, আসল বিচার চান না। বিচারক একটা খচ্চরের গলায় মস্ত একটা থলি ঝুলিয়ে তার পিঠে চড়ে রাজপ্রাসাদে পেঁৗছালেন। বিধবার জমিতে যে সুন্দর দালানটি বানানো হয়েছে, ঘটনাচক্রে খলিফা তখন সেখানে। বিচারক এভাবে আসায় খলিফা একটু অবাক হলেন। তিনি আরো অবাক হলেন, যখন ইবনে বেশ্শির ওই জমি থেকে মাটি নিয়ে ওই থলি ভর্তি করে নিতে অনুমতি চাইলেন। থলি ভর্তি হলে সেটা খচ্চরের পিঠে তুলতে সাহায্য করার জন্য তিনি খলিফাকে অনুরোধ করলেন। কিন্তু থলিটা তোলা গেল না। খলিফা বললেন, বিচারপতি, এটা বড্ড ভারী, তোলা কষ্ট। মৃদু গলায় ইবনে বেশ্শির বললেন, হুজুর, এটা খুব ভারী মনে হচ্ছে আপনার। কিন্তু বিধবার যে জমি আপনি অধিকার করেছেন, এতে তো আছে তাঁর মাত্র একটি সামান্য অংশ। তাহলে পুরো জমিটার ভার আপনি বইবেন কী করে? যদি শেষ বিচারের দিনে বিশ্বের বিচারক সবটা জমি আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দেন? এ কথা শুনে খলিফা হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন এবং ওই জমিতে যে দালান তোলা হয়েছে, সে-সবসুদ্ধ জমি বিধবাকে ফেরত দিলেন।
গল্পটি নিয়েছি 'জার্মান সাহিত্য' নামের বই থেকে। সম্পাদনা সৈয়দ আলী আহসান, পৃষ্ঠা ৫৬-৫৮। ইতিমধ্যে জানা গেছে, তর্কিত বাড়িটির জমির পরিমাণ ১৬৫ কাঠা এবং তার বাজারমূল্য ৪০০ কোটি টাকা।
=======================
খবর- কজাহাজভাঙা শিল্পে সংকটমোচন  আলোচনা- 'বাংলাদেশের সংবিধানের দর্শনের গল্পসল্প' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ও পঙ্কিল রাজনীতি  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মুক্ত বাতাসে সু চি' by রফিকুল রঞ্জু  বিশ্ব অর্থনীতি 'জি-২০ সম্মেলনে ধাক্কা খেল আমেরিকা'  ভ্রমণ- 'রেলগাড়িতে চড়ে' by মঈনুস সুলতান  'উৎসবের আমেজ সময়ের সংস্কৃতির' by শামসুজ্জামান খান  গল্প- 'কাজল রানীর হারেম' by পাপড়ি রহমান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'এক-এগারোর প্রেতাত্মা চারপাশেই ঘুরছে by আবেদ খান  খবর- মহাজোট আছে মহাজোট নেই!' by পার্থ প্রতীম ভট্টাচায্য  আলোচনা- 'বাঙ্গালির বদলে যাওয়া' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  খবর- আফগানিস্তান শান্তি কত দূর?' by তৌহিদ আজিজ  গল্প- 'ঝল্সে ওঠে জরিণ ফিতা' by রফিকুর রশীদ  ফিচার- ‘আক্রান্ত' by জাফর তালুকদার  স্মরণ- 'একজন বিস্মৃতপ্রায় বুদ্ধিজীবী' by আহমাদ মাযহার  গল্প- 'অলৌকিক উপাখ্যান' by হাসান মোস্তাফিজুর রহমান  গল্প- 'জয়মন্টপের জায়াজননী' by জামাল উদ্দীন  আলোচনা- 'তুর্গিয়েনেফ প্রসাদাৎ' by হায়াৎ মামুদ  গল্প- 'একটাই জীবন' by হাজেরা নজরুল  ফিচার- 'এটি একটি সংখ্যামাত্র' by রণজিৎ বিশ্বাস



কালের কণ্ঠ এর সৌজন্য
লেখকঃ মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আপিল বিভাগ


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.