আলোচনা- 'বাংলাদেশের সংবিধানের দর্শনের গল্পসল্প' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

আগের লেখাটি ছিল 'আইন-এর শাসন বনাম অহং-এর শাসন'। লেখাটির সারমর্ম যে আইনের শাসন হচ্ছে সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ার একমাত্র ভিত্তি এবং আইনের শাসনকে বিপর্যস্ত করে অহং-এর শাসন। লিখেছিলাম অহং শব্দটি বোঝায় অহংকার, অহমিকা, অহং-সর্বস্বভাব, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ইগো-ইজম।

লেখাটিতে আইনের শাসন মান্য করার পক্ষে বিবেকি যুক্তিগুলো উল্লেখ করেছিলাম। বিবেক হচ্ছে দেহাতীত, যার নাম আত্মা। এই কথাটি কিন্তু দেখা যাচ্ছে কিছু লোক প্রাচীনকাল থেকেই মানছেন না। তাঁদের একজন চার্বাক। তিনি বললেন, দেহই আত্মা, দেহ ছাড়া আত্মার অস্তিত্ব নেই। কে এই চার্বাক বা কারা? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল ধূর্ত চার্বাক, শিক্ষিত চার্বাক, অহং চার্বাকদের।
তারই পিছু পিছু পাওয়া গেল চার্বাক কোনো একজন ব্যক্তি নয়, ব্যক্তিসমষ্টি, যার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তারা চার্বাক নামটি কেন পেল? প্রশ্নটির উত্তর এই। চারুবাক থেকে চার্বাক। কেননা, তাদের কথার চাতুরিতে লোকেরা আকৃষ্ট হন। কিংবা চর্ব থেকে চার্বাক। কেননা, খাওয়া-পরা ও স্ফূর্তি করাই তাদের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা।
লেখাটি ছাপা হওয়ার পরে দুই সপ্তাহ ধরে খবরের কাগজগুলোতে যে ঘটনাগুলো পড়ছি, তাতে মনে হচ্ছে আইনের শাসন না মানার চার্বাকদের সংখ্যা ক্রমাগত যেন বাড়ছে। ফলে বিমূর্ত ধারণা হিসেবে আইনের শাসন জোর পাচ্ছে না। কাজেই বাংলাদেশের সংবিধানের দর্শন জানা ও মান্য করা তার প্রতিটি নাগরিকের যে আইনি বাধ্যবাধকতা আছে ও অবাধ্যকতা যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এই মূর্ত ধারণাটি উচ্চারিত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশের সংবিধান বিষয়ে আলোচনা করার আগে উপরিউক্ত শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে 'রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ সম্পর্কিত'। এ অধ্যায়ে সর্বমোট ১৩টি ধারা আছে। এর মধ্যে দুটি ধারার উল্লেখ করব। ১২৩ক ধারাটির পার্শ্ব শিরোনাম হচ্ছে, 'রাষ্ট্র সৃষ্টি নিন্দাকরণ ও উহার সার্বভৌমত্বের বিলোপ সমর্থন করা।' এই ধারার মূল কথা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের সৃষ্টি সম্পর্কে নিন্দা করা এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করতে পারে এমনভাবে কোনো ব্যক্তিকে বা জনসাধারণকে বা জনগণের বিশেষ শ্রেণীকে প্রভাবিত করার জন্য কিছু বলা বা লেখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরটি হচ্ছে ১২৪ ধারা। এই ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারি নির্বাহী প্রধান কিংবা অন্য কোনো কর্মকর্তাকে চাপ সৃষ্টি করে বা বলপ্রয়োগ করে বেআইনি কোনো কিছু করতে বাধ্য করা কিংবা তারা আইনানুগ যা করছিল তাতে বাধা দেওয়া কিংবা আক্রমণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উল্লেখ্য, দণ্ডবিধির উপরিউক্ত ধারা দুটি গৌণ বিবেচনা করতে হবে, যেহেতু সংবিধান হচ্ছে মুখ্য এটা লক্ষ রেখে।
এখন বাংলাদেশের সংবিধানের কথা বলা যাক। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের মতোই বাংলাদেশের সংবিধান কর্তৃক যে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রটি নির্মাণ করা হয়েছে তার আবশ্যিক চারটি পিলার আছে, যথা_জনগণের মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় নির্বাহী বিভাগ, জাতীয় সংসদ ও বিচার বিভাগ। মৌলিক অধিকারগুলোর অপর নাম রাজনৈতিক অধিকার। কারণ, এগুলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বলবৎ করা যায়। সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারগুলো বলবৎ করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করার অধিকারও জনগণের একটি মৌলিক অধিকার। চলাফেরার স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৬), সমাবেশের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৭) এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাসহ বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৯) একে অপরের সম্পূরক। চিন্তা শব্দটি ৩৯ অনুচ্ছেদে খাপ খায় এমন আভিধানিক অর্থ হবে_মনের চালনা, ভাবা, অনুধাবন। সে রকম বিবেক শব্দটির আভিধানিক অর্থ হবে_বিবেচন (বিবেচক=যে বিবেচনা করে)। অতএব দেখা যাচ্ছে, চিন্তা ও বিবেক শব্দ দুটিকে পৃথক করা যায় না। শব্দ দুটির সমষ্টিগত অর্থ এখানে নির্দেশ করা হয়েছে, অর্থাৎ অবাধ চিন্তার স্বাধীনতা নয়, বিবেকগ্রাহ্য চিন্তার স্বাধীনতার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাই মৌলিক অধিকার। বিবেকগ্রাহ্য শব্দগুচ্ছটির সর্বজনীন সংজ্ঞা হচ্ছে, যার মাধ্যমে আমরা একটি কাজকে ভালো আবার অন্য কাজটিকে মন্দ বলে বুঝতে পারি। তাই ভালো-মন্দের পার্থক্য যে বুঝতে চায় না কিংবা পারে না তাকে বিবেকহীন বলা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বিবেকের প্রতি দায়বদ্ধতার সুন্দর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ভারত রাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে। তার স্বচ্ছন্দ অনুবাদ এই : বিচারকার্যে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। বিচারে কাজটি বিচারপতিদের এমন সহজাত আচরণ গড়ে দেয় যার ফলস্বরূপ বিচারপতিরা সহানুভূতিশীল হন। তাঁর নিজের পদটিই একজন বিচারপতিকে এমন প্রশিক্ষণ দেয় যার আশিসে তিনি সংবেদনশীল হওয়ার বদলে সহানুভূতিশীল হন। বিচারপতিরা সব সময় অশুদ্ধ আচরণের বিরুদ্ধে উৎকৃষ্ট যুক্তিগুলোর খোঁজ করেন। তাঁরা জানেন, প্রত্যেক মুদ্রারই দুটি পিঠ আছে। যেহেতু বিচারপতিরা অন্যান্যদের কিংবা ঘটনাবলিকে নৈর্ব্যক্তিক অথচ সহমর্মী দৃষ্টিতে দেখেন, সেহেতু কোনো ব্যক্তিকে অসন্তুষ্টি করা কিংবা কোনো ব্যক্তির প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা অন্যদের চেয়ে একজন বিচারপতি মামলারত ব্যক্তিদের অহমিকা, হতাশা, অনুভূতি ও মানসিক চাপ বেশি হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম। তবু তাঁর একটা সীমারেখা থাকা অত্যন্ত জরুরি। একজন বিচারপতির প্রতি অপবাদ রটনা কখনো কোনো মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না, যার ফলে বিচারব্যবস্থা কলঙ্ক, হুমকি কিংবা নষ্টের সম্মুখীন হয়। এর অর্থ এই নয় যে বিচারপতিদের রক্ষা করা আবশ্যক। কারণ বিচারপতিরা নিজেদের রক্ষা করতে অসমর্থ নন। এর প্রকৃত অর্থ জনগণের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যেই বিচারব্যবস্থাকে অপবাদ-রটনা থেকে সুরক্ষা করতে হবে। (দেখুন, ১৯৮৩ অল ইন্ডিয়া রিপোর্টস, এসসি, পৃষ্ঠা ১১৫১)।
এখন জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রীয় নির্বাহী বিভাগের কথায় আসি। জাতীয় সংসদ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক সংগঠন, যেটা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা জোটের সদস্যদের সমাবেশও বটে। যে দল বা জোট সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা পাবে এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ দল বা জোটের সংসদ সদস্যদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে সরকারের কর্মকাণ্ডের সমর্থন কিংবা সমালোচনা করবেন। এটা স্কুলের নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরাও জানে। তারা আরো জানে, সংসদের কার্যকাল পাঁচ বছর এবং তারপর আবার নির্বাচনের মাধ্যম জনগণের ইচ্ছানুযায়ী ভোটের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কিছু সংসদ সদস্য সেটা জানেন না। তাঁরা সংসদের বাইরে বলপ্রয়োগে, চাপ সৃষ্টি করে সংসদকে বাতিল করার পাঁয়তারা করছেন। জনগণের কিছু করার এখন উপায় নেই। এঁদের পুনর্নির্বাচিত করা সমীচিন হবে কি না তার জন্য জনগণকে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে।
ফরাসি বিপ্লবের পরে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইংরেজ ঔপনিবেশিকের পতনের পরে ওই প্রশ্নটি উঠেছিল, তবে তার তখন সুরাহা করা যায়নি। তখন কথা উঠেছিল সংবিধানে এমন বিধান রাখা যায় কি না যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে ভোট দেওয়ার আগে একজন সংসদ সদস্য যেন যাচাই করে নেন তাঁর নির্বাচন এলাকার ভোটাররা কী চান। দেশে এখন যা অবস্থা, সংসদে ভোট দেওয়া তো দূর অস্ত, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে যান না। অদূর ভবিষ্যতে সংসদের বাইরে পথেঘাটে, মাঠে-ময়দানে, অফিস-আদালতে কী যে হট্টগোল হুলস্থূল করা হবে, আমার কল্পনায় সেটা কেমনতরো ধরা দিচ্ছে সেটার রূপক ধারণা দিতে পরশুরামের সেরা হাসির গল্পগুলোর একটি থেকে শেষ অংশের উদ্ধৃতি দিচ্ছি (যদিও সঠিক ও মনের মতো নয়) :
'তারপর যে ব্যাপার আরম্ভ হইল তাহা মনে করিলেও কলমের কালি শুখাইয়া যায়। শিবুর তিন জন্মের তিন স্ত্রী এবং নৃত্যকালীর তিন জন্মের তিন স্বামী_এই ডবল ত্র্যহস্পর্শযোগে ভূশণ্ডীর মাঠে যুগপৎ জলস্তম্ভ, দাবানল ও ভূমিকম্প শুরু হইল। ভূত, প্রেত, দৈত্য, পিশাচ, তাল, বেতাল প্রভৃতি দেশি উপদেবতা যে যেখানে ছিল, তামাশা দেখিতে আসিল। স্পুক, পিঙ্,ি নোম, গবলিন প্রভৃতি গোঁফ-কামানো বিলাতি ভূত বাঁশি বাজাইয়া নাচিত লাগিল। জিন, জান, আফ্রিদ, মারীদ প্রভৃতি লম্বা-দাঁড়িঅলা কাবুলি ভূত দাপাদাপি আরম্ভ করিল। চিং চ্যাং, ফ্যাচাং ইত্যাদি মাকুন্দে চিনে-ভূত ডিগবাজি খাইতে লাগিল।...কে এই উৎকট দাম্পত্য সমস্যার সমাধান করিবে?...নিতান্ত যদি না পারেন, তবে চাঁদা তুলিয়া গয়ায় পিণ্ড দিবার চেষ্টা দেখুন, যাহাতে বেচারারা অতঃপর শান্তিতে থাকিতে পারে।'
=============================
রাজনৈতিক আলোচনা- 'মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ও পঙ্কিল রাজনীতি  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মুক্ত বাতাসে সু চি' by রফিকুল রঞ্জু  বিশ্ব অর্থনীতি 'জি-২০ সম্মেলনে ধাক্কা খেল আমেরিকা'  ভ্রমণ- 'রেলগাড়িতে চড়ে' by মঈনুস সুলতান  'উৎসবের আমেজ সময়ের সংস্কৃতির' by শামসুজ্জামান খান  গল্প- 'কাজল রানীর হারেম' by পাপড়ি রহমান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'এক-এগারোর প্রেতাত্মা চারপাশেই ঘুরছে by আবেদ খান  খবর- মহাজোট আছে মহাজোট নেই!' by পার্থ প্রতীম ভট্টাচায্য  আলোচনা- 'বাঙ্গালির বদলে যাওয়া' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  খবর- আফগানিস্তান শান্তি কত দূর?' by তৌহিদ আজিজ  গল্প- 'ঝল্সে ওঠে জরিণ ফিতা' by রফিকুর রশীদ  ফিচার- ‘আক্রান্ত' by জাফর তালুকদার  স্মরণ- 'একজন বিস্মৃতপ্রায় বুদ্ধিজীবী' by আহমাদ মাযহার  গল্প- 'অলৌকিক উপাখ্যান' by হাসান মোস্তাফিজুর রহমান  গল্প- 'জয়মন্টপের জায়াজননী' by জামাল উদ্দীন  আলোচনা- 'তুর্গিয়েনেফ প্রসাদাৎ' by হায়াৎ মামুদ  গল্প- 'একটাই জীবন' by হাজেরা নজরুল  ফিচার- 'এটি একটি সংখ্যামাত্র' by রণজিৎ বিশ্বাস


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্য
লেখকঃ মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.