গেরিলা রুমী ও তাঁর সহযোদ্ধারা by প্রশান্ত কর্মকার

রেডিও আজ একচোটেই বলে দিয়েছে, আটটা-পাঁচটা কারফিউ থাকবে না। সবাই গেলাম গুলশানে। রুমী-জামীকে বাড়ি নিয়ে আসতে। আজ রুমীর জন্মদিন, অন্তত দুপুরে কিছু রান্না করে খাইয়ে দিই। গিয়ে দেখি কিটি ওখানে বেড়াতে গেছে। গুলশানে বেশির ভাগ বাড়িতে বিদেশিদের বাস; সেখানে চলাফেরার একটু সুবিধে, আর্মির উৎপাত একটু কম।’
জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলির অংশবিশেষ। গতকাল
২৯ মার্চ ছিল রুমীর জন্মদিন। যে গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন রুমীরা, আজ তারই কিছু ঘটনা বলব। মায়ের সঙ্গে অনেক যুক্তিতর্কে অবতীর্ণ হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি আদায় করতে সক্ষম হন, চলে যান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে। তখন মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো মেলাঘরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছ থেকে গেরিলা ট্রেনিং নেন রুমীরা।
১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের দিন পর্যন্ত ঢাকায় অনেক সফল অপারেশন চালান গেরিলারা। উল্লেখ্য, ঢাকা ছিল অধিকৃত বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি শাসক ও তাদের সহযোগীদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্রধান কর্মকেন্দ্র। ঢাকার নাগরিক জীবনযাত্রা স্বাভাবিকভাবে চলছে—এ কথা বিশ্ববাসীকে বোঝানোর জন্য হানাদারদের তৎপরতা ছিল প্রবল। ঢাকার বুকে মুক্তিবাহিনীর ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর গেরিলারা একের পর এক দুঃসাহসিক অপারেশন ও নানা ধরনের রেইড চালিয়েছেন। গেরিলাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গ ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব ঘোষণা করা।
প্রথম দফায় এসে তাঁরা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের (বর্তমানে শেরাটন) সামনের গাড়ি, ওয়াপদা গেট, পুরানা পল্টন ও বিভিন্ন সিনেমা হলে হাতবোমা নিক্ষেপ করেন। এরপর তাঁরা ঢাকা ছেড়ে চলে যান। কিছু দিন পর উন্নত ধরনের অনেক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁরা আবার ঢাকায় প্রবেশ করেন। এ পর্যায়ে তাঁরা ঢাকার পাঁচটি পাওয়ার স্টেশনের মধ্যে প্রথমে দুটির ওপর সফল অপারেশন চালান।
উলন পাওয়ার স্টেশন (রামপুরা এলাকা)
উলন পাওয়ার স্টেশনে (একটি ট্রান্সফরমার ১৩২/৩৩ কেভি, ৩০/৪০/৫০ এমভিএ) অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন গাজী দস্তগীর। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মতিন-১, মতিন-২, জিন্না, নিলু ও হাফিজ (পরে শহীদ হন)। রাত আটটা থেকে পৌনে নয়টার মধ্যে স্টেশনটি গেরিলারা সফলভাবে উড়িয়ে দেন। এ সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা রামপুরা এলাকা।
খিলগাঁও পাওয়ার সাব-স্টেশন (গুলবাগ এলাকা)
খিলগাঁও পাওয়ার সাব-স্টেশনটি (গুলবাগ পাওয়ার সাব-স্টেশন নামে পরিচিত, ৩৩/৩১ কেভি, দুটি ট্রান্সফরমার ৫ এমভিএ করে) উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল পুলু, সাঈদ, জুয়েল (পরে শহীদ হন), হানিফ, মুখতার, মোমিন, মালেক ও বাশারের ওপর। গেরিলারা এটি সফলভাবে উড়িয়ে দেন রাত আটটা ৪৭ মিনিটে। ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দে গোটা গুলবাগ, শান্তিবাগ, মালিবাগ, খিলগাঁও, শান্তিনগর ও মগবাজার এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
বিচ্ছুদের কবলে: গ্যানিজ ও ভোগ
ঢাকার অভিজাত বিপণিকেন্দ্র গ্যানিজ ও ভোগে বিচ্ছুরা গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি ছোড়ে ১৮ জুলাই বিকেলে। গ্যানিজের অপারেশনে মারা গিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি চার পুলিশ। ।
আচানক সেমসাইড
ভুল বুঝে নিজেদের দুই পক্ষের মধ্যে সারা রাত গুলি বিনিময় হলো। ভোরে দেখা গেল ‘সেমসাইড’। এ পক্ষেও খানসেনা ও পক্ষেও খানসেনা। দুই পক্ষে নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০। ঘটনাটি ঘটেছিল ঢাকার সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী এলাকায় জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে। এই সেমসাইড ঘটনার নায়ক ছিলেন ঢাকায় কর্মরত ক্র্যাক-প্লাটুনের চার গেরিলা—পুলু, হানিফ, মোজাম্মেল ও বারেক।
ফার্মগেট অপারেশন
গাড়ি থেকে নেকড়ের মতো নিঃশব্দ অথচ ক্ষিপ্র গতিতে নামলেন পাঁচজন গেরিলা। এক মিনিটের মধ্যে পজিশন নিলেন। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলল পুরো এক মিনিট ব্রাশফায়ার। কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়তে লাগল ফার্মগেট চেকপোস্টের রাজাকার ও মিলিটারি পাকিস্তানি পুলিশেরা। এই অপারেশনে ছয়জন গেরিলা অংশ নেন। এঁদের একজন হলেন সামাদ। তিনি ছিলেন গাড়িচালক। বাকি পাঁচজন হলেন জুয়েল, বদি (এ দুজন পরে শহীদ হন), আলম, পুলু ও স্বপন। অপারেশনটি হয় আগস্টের প্রথম সপ্তাহে রাত আটটা থেকে আটটা পাঁচ মিনিটে।
ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়ক
এই তাত্ক্ষণিক অপারেশনটি সফলতার সঙ্গে চালানো হয় একাত্তরের ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কে। হামলাটি চালিয়েছিলেন রুমী, বদি, স্বপন, আলম, কাজী, হ্যারিস, মুক্তার, জিয়া ও আনু। দুটি গাড়ি নিয়ে এ হামলা চালান ক্র্যাক-প্লাটুনের সদস্যরা। এতে সাত-আটজন মিলিটারি পুলিশ নিহত হয়। এই হামলায় সময় লাগে কয়েক সেকেন্ড। ফেরার পথে আবার তাঁরা হামলা করেন বাকি মিলিটারিদের ওপর। এর একটু পরে চেকপোস্টের সামনে তাঁরা হত্যা করেন এলএমজি নিয়ে অবস্থানরত পাকিস্তানি দুই সেনাকে। পাকিস্তানি সেনারা তখন জিপ নিয়ে তাড়া করে তাঁদের। এ সময় গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে ফেলেন রুমী। তারপর সেই ভাঙা অংশ দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকেন বদি, স্বপন ও রুমীরা। কজন নিহত হলো, তা জানা গেল না। কিন্তু উল্টে গেল জিপ। ওই তিনটি আক্রমণ মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের লন্ডভন্ড করে দেয়। এ হামলার বর্ণনা দিয়েছিলেন রুমী। সেই বর্ণনাই লিখেছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর একাত্তরের দিনগুলি বইতে।
এ ধরনের অতর্কিত হামলায় পাকিস্তানি সেনারা রাজধানী ঢাকায় যেমন হতাহত হয়েছিল, তেমনই পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল তাদের মনোবল। এভাবেই রুমীদের মতো তরুণেরা একাত্তরের নয় মাস অসীম সাহস নিয়ে, জীবন বাজি রেখে নগণ্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁরা যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার ক্ষতি না করলে অথবা হানাদারদের মনে ত্রাস সৃষ্টি না করলে নিয়মিত বাহিনী খুব সহজে রাজধানী দখলে নিতে পারত না। রুমীকে ২৯ আগস্টেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানিরা, ওকে হত্যা করেছিল। সে মর্মান্তিক ঘটনার কথা বহুবার লেখা হয়েছে। তাই এখানে আর নয়। ’৭১-এর ঢাকার গেরিলাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কবি শামসুর রাহমানের ‘গেরিলা’ কবিতার অংশবিশেষ দিয়ে শেষ করতে চাই—
‘দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আতিপাতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতি ঘর।...
তুমি আর ভবিষ্যত্ যাচ্ছে হাত ধরে পরস্পর।
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন সন্তান আমার।’

No comments

Powered by Blogger.