প্রত্যাশা ও সামর্থ্য রয়েছে, প্রয়োজন সাহসী উদ্যোগ -সম্ভাবনার শক্তিশালী বাংলাদেশ

সমস্যা ও সম্ভাবনার জোড়লাগা ভূমি এই বাংলাদেশ। ৩৮ বছরের পথচলায় এই সমস্যা আর সম্ভাবনা কখনো পালা করে, আবার কখনো সমান্তরালে বিরাজ করেছে। স্বাধীনতা যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছিল, একের পর এক রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ আর রাজনৈতিক হোঁচট তাকে সীমিত করে দেয়। ক্ষমতার মধ্যে জন্ম নেওয়া দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা যখন চোখের বালি হয়ে ওঠে, তখনই জনগণের উত্থান ও উদ্যোগ উত্তরণ ঘটিয়ে দেয়। তবে সমস্যার দিকটি যত নজরে এসেছে, সম্ভাবনার দিকটি রয়ে গেছে ততই আড়ালে। এই বাংলাদেশই দরিদ্র দেশ থেকে মাঝারি আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছে, অনুন্নত দেশের সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠছে উন্নয়নশীল দেশের সোপানে। ২০০৫-০৬ সাল থেকে ২০০৭-০৮ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আশাপ্রদভাবে ছয়ের ঘরেই ছিল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনারে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের বিপুল সম্ভাবনার কথাও ঘোষিত হয়েছে। উচ্চারিত হয়েছে জনগণের সৃষ্টিশীলতা ও গণতান্ত্রিকতার জয়গান। আশার এ উচ্ছ্বাস যেমন সত্য, তেমনি সত্য সমস্যার চাপও। এ দুইকে একসঙ্গে বিবেচনায় রেখেই জাতীয় অবস্থার খতিয়ান করা উচিত।
এ বছর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়ে ১৮২টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম হয়েছে। অর্থনীতিতে বৈষম্য বাড়ার পাশাপাশি গড় জাতীয় উত্পাদন আবার ছয়ের ঘরে উঠতে যাচ্ছে, ২০০৫-২০০৭ সালে যা সাত ছুঁই ছুঁই করছিল। সন্তোষজনক না হলেও এটা অগ্রগতি। একদিকে দেশ বিশিল্পায়িত হলেও প্রবাসী শ্রমিকদের আয় ও কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি খাদ্যনিরাপত্তা এনেছে এবং বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়কে স্বাস্থ্যবান করেছে। কোটি কোটি তরুণ-তরুণী আত্মকর্মসংস্থানের পথে বাড়িয়েছে সার্বিক গতিশীলতা। সামাজিক সেবা প্রসারিত হলেও সরকারি সেবার মান কমেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অগণতান্ত্রিকতা বহাল থাকলেও নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিকতা ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা বেড়েছে। মোদ্দাকথা, সমাজ যতই এগোতে চেয়েছে, রাষ্ট্রের দুর্বলতা তাতে শক্তি জোগানোর চেয়ে বাধাই সৃষ্টি করেছে বেশি।
খেয়াল করলেই দেখা যাবে, সাফল্য এসেছে জনগণের উদ্যোগ ও উদ্যমের ফলে, আর সমস্যা জন্মেছে ওপরতলার বৃত্তে। হার্ভার্ড সেমিনারের গবেষকেরা আশা করেছেন, সরকার পরিচালনায় নতুন চিন্তার সন্নিবেশ ঘটবে, বিনিয়োগ ও সম্পদের প্রবাহ নতুন মাত্রা পাবে ইত্যাদি। বিশেষভাবে নজর দিতে হবে শিক্ষা, কৃষি, শিল্প ও জ্বালানিক্ষেত্রে। অব্যবস্থাপনা, জবাবদিহির অভাব, দুর্নীতি ও দলীয়পনার প্রতিকার করতে হবে কঠোরভাবে। দুর্বলতা নিয়ে সচেতনতার পাশাপাশি ইতিবাচক দিকগুলো সামনে তুলে ধরে অগ্রযাত্রার আত্মবিশ্বাস জাগাতে হবে। জনগণের উদ্যোগ ও কর্মকুশলতাকে পৃষ্ঠপোষকতা, সীমিত সম্পদের সুদূরপ্রসারী ব্যবহার এবং সব পর্যায়ে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি জোরদার করতে হবে। কিন্তু এই উপলব্ধি জনগণের মধ্যে যত, নবীন প্রজন্মের মধ্যে যত, শাসকদের মধ্যে ততটা নয়।
ব্রিটিশ লেখক রবার্ট লুই স্টিভেনসনের উপন্যাস ড. জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড ছিলেন একই ব্যক্তি। তিনি দিনে এক আর রাতে আরেক চরিত্র। একটি দিক আলোকিত, অন্যটি অন্ধকার। বাংলাদেশও এখনো আলো-অন্ধকারে দুলছে। এই দোলাচল জনগণের মধ্যে নেই। তারা নিজেদের জীবন ও দেশের অবস্থানকে সমৃদ্ধ ও সম্মানজনক দেখতে চায়। এটা যেহেতু সম্ভব, সেহেতু এর কম প্রত্যাশা হতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.