বলছি এক কিংবদন্তির কথা -স্মরণ by এম এ মজিদ

যাত্রাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। লোকরীতির সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন এ শিল্পকে। আমরা অমলেন্দু বিশ্বাসের কথা বলছি। দীর্ঘকাল তিনি যাত্রামঞ্চে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলো যেন সত্য হয়ে দেখা দিত মঞ্চে। দর্শক নিমিষেই হারিয়ে যেত ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর মধ্যে।
বাংলার রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে যেমন গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪—১৯১২) এবং শিশির কুমার ভাদুড়ীকে (১৮৯৯—১৯৫১) যুগ-প্রবর্তক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তেমনি শতবর্ষের যাত্রার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন আরও তিনজন যুগান্তকারী প্রতিভা। স্বদেশি যাত্রার প্রবর্তক মুকুন্দ দাশ (১৮৭৮—১৯৩৪), আধুনিক যাত্রাপালা রচনার পথিকৃত্ ব্রজেন্দ্রকুমার দে এমএ, বি-টি (১৯০৭—১৯৭৬) এবং অভিনয়, নির্দেশনা ও পালা সম্পাদনায় অমলেন্দু বিশ্বাস (১৯২৫—১৯৮৭)। যাত্রাশিল্পে বহু শিল্পীর আবিষ্কারক তিনি। আধুনিক ধ্যান-ধারণায় কেটেছে তাঁর সারা জীবন। অভিনয় ক্ষেত্রেও তিনি আধুনিক। লোকজ আঙ্গিকের পালার সঙ্গে আধুনিক প্রয়োগ-কৌশল মিশিয়ে দর্শকনন্দিত পালা প্রযোজনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। গড্ডলিকা প্রবাহ থেকে যাত্রাকে সমকালীন ধারায় উপস্থাপনের মাধ্যমে যাত্রার গুণগত মান বাড়াতে নানামুখী পরিকল্পনা করতেন। মাইকেল মধুসূদন, লেলিন, হিটলার, জানোয়ার, বিনয় বাদল দীনেশ-এর সার্থক রূপকার তিনি। এ-জাতীয় পালা প্রযোজনার পর বিশ্বাসের সঙ্গে নগর সংস্কৃতির যোগসূত্র গড়ে ওঠে। ব্যতিক্রমী প্রযোজনার বহুমাত্রিক অভিনয়গুণে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের একক উত্তম পুরুষ হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন তিনি।
যাত্রামঞ্চে দাপুটে অভিনেতা অমলেন্দু বিশ্বাসকে কল্পনা করাও আজ অনেকের পক্ষে কষ্টকর হবে। আজ একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য এই যাত্রা-নট অমলেন্দু বিশ্বাসের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। সংস্কৃতিকর্মীরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবেন আজ।
অমলেন্দু বিশ্বাস জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালের ২৯ মে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহরে। যাত্রায় সঙ্গে তিনি মিতালি পাতিয়েছিলেন পাকিস্তান আমলে সিরাজগঞ্জের বাসন্তী অপেরার মাধ্যমে। প্রবেশিকা পরীক্ষার পর ১৯৪১ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সে যোগদান, কিছুদিন পুলিশের চাকরি, সিনেমায় অভিনয়ের ব্যাকুলতা, ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম রেঞ্জে চাকরির পাশাপাশি নাটকে অভিনয় শুরু, ১৯৫৮-৫৯ সালে গণসংগীত স্কোয়াড গঠন, আইয়ুব সরকারের হুলিয়া জারি—এসব এড়াতেই তিনি যাত্রাদলকে নিরাপদ হিসেবে বেছে নেন। আমাদের এ তথ্য দিয়েছেন অমলেন্দু বিশ্বাসের দীর্ঘদিনের সহকর্মী মিলন কান্তি দে।
বাসন্তীর পর তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে গীতশ্রী যাত্রা ইউনিট এবং কমলা অপেরা নামে আরও দুটি যাত্রাদলে চাকরি করেন বিশ্বাস। স্বাধীনতার পর বাবুল অপেরা, গীতশ্রী অপেরা ও বাণীশ্রী অপেরা হয়ে ১৯৭৪ সালে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন চারণিক নাট্যগোষ্ঠী।
এ দলের মাধ্যমে মান্ধাতা আমলের রীতিনীতি বর্জন করে চিত্কার-সর্বস্ব অভিনয়ের ধরন থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজলেন, পেলেনও। তাঁর স্ত্রী যাত্রাসম্রাজ্ঞী জ্যোত্স্না বিশ্বাসসহ অন্য শিল্পীরা অমলেন্দু বিশ্বাসের এই উচ্চারণে অনুপ্রাণিত হয়ে সায় জানালেন। তাঁরা খুঁজে পেলেন আধুনিক যাত্রার নতুন ঠিকানা।
রাহুগ্রাস, সোহরাব-রুস্তম, চাঁদসুলতানা, জালিয়াত, রাজ সন্ন্যাসী, একটি পয়সা পালায় এল অসাধারণ সাফল্য।
মাইকেল মধুসূদন-এর পর অমলেন্দু বিশ্বাস ম্যাক্সিম গোর্কির মা আসরে নামাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই ১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর লোকান্তরিত হন তিনি।
অমলেন্দু বিশ্বাস কী ধরনের শিল্প-ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন, তা বোঝা যাবে তাঁর পালাগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখলে। মাইকেল পালায় তিনি বিদ্রোহী এই কবির জীবন যেমন তুলে এনেছেন, তেমনি লেনিন পালায় প্রলেতারীয় বিপ্লবের সিংহপুরুষ লেনিনকে পরিচিত করে তুলেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, ভেদাভেদ থাকবে না ধর্মে-ধর্মে, তারই প্রকাশ ঘটেছে অমলেন্দু বিশ্বাসের পালাগুলোয়। আমাদের সংস্কৃতির আবহমান ধারায় তিনি যে আধুনিকতা যুক্ত করলেন, তা পুরোপুরি মানবতাবাদী। সবার উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ তাহার উপরে নাই—এ কথাটিই তাঁর পালাগুলোয় প্রস্ফুটিত হয়েছে। বোধের জায়গায় তিনি ছিলেন স্বচ্ছ। বাংলার মানুষকে সংস্কৃতি-সুধায় ভরিয়ে তোলার কাজটি করেছেন অমলেন্দু বিশ্বাস। পালা মঞ্চে সেই ধারাটি এখনো ক্ষীণ হয়ে যায়নি। বলা যায়, এ ধারা যত দিন যাত্রাশিল্পে জলসিঞ্চন করবে, তত দিনই লোকজ ও আধুনিকতার সমন্বয়ে ঋদ্ধ হবে এই শিল্প।
যাত্রাশিল্পে অবদান রাখায় তিনি বাচসাস, শিল্পকলা একাডেমী, থিয়েটার সিকোয়েন্সসহ মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। আর অগণিত যাত্রা-দর্শকের হূদয়ে তিনি থাকবেন উত্তম পুরুষ হিসেবে। মধ্যরাতের যাত্রার আসর থেকে এখনো যেন ভেসে আসে বিশ্বাস অভিনীত মাইকেল মধুসূদন-এর অন্তিম মুহূর্তের সেই পঙিক্ত ‘দাঁড়াও পথিক বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল।’

No comments

Powered by Blogger.