গল্প- হলুদ পাতার বিছানা by শরীফ খান
অলংকরণ: মাসুক হেলাল |
ঘুঙুরের
শব্দটা কান থেকে হারিয়ে যেতেই নানি রান্নাঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে
তাকালেন। নাতির কাণ্ড দেখে হেসে ফেললেন। তিন বছর বয়সী নাতিটা এখন ছাগলছানার
পিঠে গিয়ে চড়ার কসরত করছে। ছোট সাদা ছাগলছানাটি প্রবল আপত্তি জানাচ্ছে।
চাইছে পালাতে। সাগর ওটার একটা কান মুঠিতে ধরে রেখেছে। নানি নিজের মেয়ে
অর্থাৎ সাগরের মাকে দৃশ্যটা দেখালেন। মা-ও হেসে বললেন, ‘ঘুম ছাড়া ওর তো
কোনো বিশ্রাম নেই, যা দুষ্টু হয়েছে না! নানি বাটিতে রুই মাছের মাথাটা
কেটে গামলায় রেখে বললেন, ‘তাই তো দিয়েছি ওর কোমরে ঘুঙুর বেঁধে। যেখানেই
যাক, টের পাব আমরা।’
সাগর মা-বাবার সঙ্গে নানিবাড়িতে এসেছে এই সাত-আট দিন হলো। আসার পর থেকেই ওর দুরন্তপনা বেড়ে গেছে শতগুণে। ঢাকায় থাকে। দৌড়ঝাঁপের জায়গা নেই। মাথার ওপরে খোলা আকাশ নেই। চাঁদ-তারা-জোনাকির আলো নেই। ফুল-পাখি-প্রজাপতি নেই। তাই তো নানিবাড়িতে আসার পর থেকেই ও স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। ঘরের সামনে মস্ত বড় উঠোন। সে উঠোনের চারপাশজুড়ে গাছপালা। সাদা-বাদামি আর কালো রঙের ছয়টা ছাগলছানা আছে নানির। ছানাগুলো কী সুন্দর যে লাফ-ঝাঁপ দেয়, তিড়িং বিড়িং করে। সাগরও ছোটে আর লাফায় ওদের পেছন পেছন। উঠোনে রাজহাঁস ঘুরে বেড়ায় চারটা। প্রথম প্রথম সাগরকে কাছে দেখলেই গলা তুলে ‘কোয়াঙ কোয়াঙ’ শব্দে ডাকত, ঠোকর দিতে চাইত। এখন অবশ্য ওরা বুঝে গেছে বোধ হয়—এ বাড়ির আদরের নাতি এটা! তাই অত্যাচার সহ্য করে। সাগর গলা ধরে টানে। পিঠে চড়ে বসতে চায়। নানির মুখে শোনা গল্পের মতো রাজহাঁসের পিঠে চড়ে পরির দেশে উড়ে যেতে চায়।
রোজ সকালে নানি যখন ছাগলের পাল নিয়ে মাঠের দিকে যান, সাগরও যায় পেছন পেছন। নানি ওকে বড় বড় খাসি ছাগলের পিঠে চড়িয়ে দেন। খুশি তখন দেখে কে সাগরের! নিজেকে মনে হয় রাজপুত্র। সারা দিন নানির সঙ্গেই কাটে। নানি ওকে পুকুরে নিয়ে গোসল করিয়ে দেন। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনান। পাখির বাসা দেখান। আমের বোলের গন্ধ বোঝান। নানি যেখানে, সাগর সেখানে। রান্নাঘরের পেছনেই পুকুর। এই চৈত্রে জল নেমে গেছে। সাগরের হাঁটুজল আছে। ওই হাঁটুজলে নেমে নানির হাত ধরে কতবার যে হেঁটে সে পুকুর পাড়ি দিল। নানি তাই ওর কোমরে বেঁধে দিয়েছেন ঘুঙুর।
নানি আজ এই একটু আগে দূরের রেলস্টেশনে গেছেন। সঙ্গে গেছেন সাগরের বাবা। সাগরের বড় খালা আসছেন বেড়াতে। আনতে গেছেন ওদের।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে নানির মনে হলো—তাই তো! ঘুঙুরের শব্দ তো শোনা যাচ্ছে না! বাইরে এলেন তিনি। সঙ্গে সাগরের মা। সাগর কই! মা নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলেন। নানি গেলেন পুকুর পাড়ে। তারপর শুরু করলেন চেঁচামেচি। পাড়া-প্রতিবেশীরা ছুটে এল। খবর শুনে একজন বলল, ‘ইদানীং ছেলেধরাদের কথা শোনা যাচ্ছে! ওরাই কী...!’ সাগরের মা এবার বুক চাপড়াতে চাপড়াতে মাটিতে বসে পড়লেন। এ সময় অন্য একজন বলল, ‘আবার অপহরণ-টরণ নাকি...!’ সাগরের নানি চিৎকার দিয়ে সবাইকে থামালেন। বললেন, ‘আমি জানি, কোথায় গেছে ও! আজ তো যেতে পারেনি নানির সঙ্গে!’
বাগানের শুড়িপথ ধরে অনেকটা দৌড়ে চললেন নানি। পেছনে অন্যরা। অনেকটা দূরে আসার পরে একটা আমড়াগাছের কাছে থামলেন নানি। এগিয়ে এল সবাই। দৃশ্য দেখে সবাই যেন অভিভূত হয়ে গেল। আমড়াগাছের ঝরে পড়া হলুদ পাতায় যেন পুরু পাতার বিছানা পাতা হয়ে গেছে মাটিতে। সেই বিছানায় একটি সাদা ছাগলছানার গলা জড়িয়ে ধরে কী নিশ্চিন্তে যে ঘুমোচ্ছে সাগর! পাশে শোয়া আরও দুটি ছাগলছানা। আমড়ার বোলের ঝরে পড়া পাপড়ি আর হলুদ ছোট ছোট পাতাগুলো ঝরছে চারটি প্রাণীর মুখ-মাথা-শরীরে!
সাগরের নানি এগিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লেন হলুদ পাতার বিছানার ওপরে। আদরের নাতিকে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। বললেন, ‘খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে কী সুন্দর ঘুমিয়ে গেছে আমার ভাই! আমিও এমন সুখের ঘুম চাই।’
সাগর মা-বাবার সঙ্গে নানিবাড়িতে এসেছে এই সাত-আট দিন হলো। আসার পর থেকেই ওর দুরন্তপনা বেড়ে গেছে শতগুণে। ঢাকায় থাকে। দৌড়ঝাঁপের জায়গা নেই। মাথার ওপরে খোলা আকাশ নেই। চাঁদ-তারা-জোনাকির আলো নেই। ফুল-পাখি-প্রজাপতি নেই। তাই তো নানিবাড়িতে আসার পর থেকেই ও স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। ঘরের সামনে মস্ত বড় উঠোন। সে উঠোনের চারপাশজুড়ে গাছপালা। সাদা-বাদামি আর কালো রঙের ছয়টা ছাগলছানা আছে নানির। ছানাগুলো কী সুন্দর যে লাফ-ঝাঁপ দেয়, তিড়িং বিড়িং করে। সাগরও ছোটে আর লাফায় ওদের পেছন পেছন। উঠোনে রাজহাঁস ঘুরে বেড়ায় চারটা। প্রথম প্রথম সাগরকে কাছে দেখলেই গলা তুলে ‘কোয়াঙ কোয়াঙ’ শব্দে ডাকত, ঠোকর দিতে চাইত। এখন অবশ্য ওরা বুঝে গেছে বোধ হয়—এ বাড়ির আদরের নাতি এটা! তাই অত্যাচার সহ্য করে। সাগর গলা ধরে টানে। পিঠে চড়ে বসতে চায়। নানির মুখে শোনা গল্পের মতো রাজহাঁসের পিঠে চড়ে পরির দেশে উড়ে যেতে চায়।
রোজ সকালে নানি যখন ছাগলের পাল নিয়ে মাঠের দিকে যান, সাগরও যায় পেছন পেছন। নানি ওকে বড় বড় খাসি ছাগলের পিঠে চড়িয়ে দেন। খুশি তখন দেখে কে সাগরের! নিজেকে মনে হয় রাজপুত্র। সারা দিন নানির সঙ্গেই কাটে। নানি ওকে পুকুরে নিয়ে গোসল করিয়ে দেন। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনান। পাখির বাসা দেখান। আমের বোলের গন্ধ বোঝান। নানি যেখানে, সাগর সেখানে। রান্নাঘরের পেছনেই পুকুর। এই চৈত্রে জল নেমে গেছে। সাগরের হাঁটুজল আছে। ওই হাঁটুজলে নেমে নানির হাত ধরে কতবার যে হেঁটে সে পুকুর পাড়ি দিল। নানি তাই ওর কোমরে বেঁধে দিয়েছেন ঘুঙুর।
নানি আজ এই একটু আগে দূরের রেলস্টেশনে গেছেন। সঙ্গে গেছেন সাগরের বাবা। সাগরের বড় খালা আসছেন বেড়াতে। আনতে গেছেন ওদের।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে নানির মনে হলো—তাই তো! ঘুঙুরের শব্দ তো শোনা যাচ্ছে না! বাইরে এলেন তিনি। সঙ্গে সাগরের মা। সাগর কই! মা নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলেন। নানি গেলেন পুকুর পাড়ে। তারপর শুরু করলেন চেঁচামেচি। পাড়া-প্রতিবেশীরা ছুটে এল। খবর শুনে একজন বলল, ‘ইদানীং ছেলেধরাদের কথা শোনা যাচ্ছে! ওরাই কী...!’ সাগরের মা এবার বুক চাপড়াতে চাপড়াতে মাটিতে বসে পড়লেন। এ সময় অন্য একজন বলল, ‘আবার অপহরণ-টরণ নাকি...!’ সাগরের নানি চিৎকার দিয়ে সবাইকে থামালেন। বললেন, ‘আমি জানি, কোথায় গেছে ও! আজ তো যেতে পারেনি নানির সঙ্গে!’
বাগানের শুড়িপথ ধরে অনেকটা দৌড়ে চললেন নানি। পেছনে অন্যরা। অনেকটা দূরে আসার পরে একটা আমড়াগাছের কাছে থামলেন নানি। এগিয়ে এল সবাই। দৃশ্য দেখে সবাই যেন অভিভূত হয়ে গেল। আমড়াগাছের ঝরে পড়া হলুদ পাতায় যেন পুরু পাতার বিছানা পাতা হয়ে গেছে মাটিতে। সেই বিছানায় একটি সাদা ছাগলছানার গলা জড়িয়ে ধরে কী নিশ্চিন্তে যে ঘুমোচ্ছে সাগর! পাশে শোয়া আরও দুটি ছাগলছানা। আমড়ার বোলের ঝরে পড়া পাপড়ি আর হলুদ ছোট ছোট পাতাগুলো ঝরছে চারটি প্রাণীর মুখ-মাথা-শরীরে!
সাগরের নানি এগিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লেন হলুদ পাতার বিছানার ওপরে। আদরের নাতিকে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। বললেন, ‘খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে কী সুন্দর ঘুমিয়ে গেছে আমার ভাই! আমিও এমন সুখের ঘুম চাই।’
No comments