গল্প- সুরতারিণীর ধারণকৃত কণ্ঠস্বর by মঈনুস সুলতান
মোটরবাইকের
একজস্ট পাইপ দিয়ে বেরুচ্ছে প্রচুর ধোঁয়া। কাদা বাঁচিয়ে মেঠোপথে চালাতে
গেলে বিচিত্র আওয়াজ হয়। উল্টা দিকের বাতাস বয়ে আনে পোড়া ধোঁয়ার গন্ধ।
অনেকদিনের হোন্ডা বাইকখানা বেজায় লজজড়। আদিবাসী পাত্র সম্প্রদায়ের গ্রাম
বহরগুলে যাওয়ার জন্য সরোজ মোহাইমিন বাইকখানা তার সহকর্মীর কাছ থেকে ধার করে
এনেছে। এবড়ো-খেবড়ো সড়কে দু-চাকার বাহনটিকে সামলাতে তার সমস্যা হয়। কাছেই
জাফলংয়ের দিকে ছুটে চলা পিচঢালা হাইওয়ের পাশে তাদের এনজিও, ভিলেজ
ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ সংক্ষেপে ভিডিআই। বছর দুয়েক হলো সরোজ ওখানে কাজ
করছে। কর্মরত হওয়ার আগে সে পাক্কা দশ বছর কাটিয়েছে ঢাকা শহরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ছাড়াও ওখানে সে দেদার সময় ব্যয় করেছে ছোটগল্প
লেখায়। গল্প সে লিখেছে প্রচুর, কিন্তু রচনাগুলোর ছেপেছে কেবলমাত্র লিটল
ম্যাগাজিনে, তা-ও কাজা-কচ্ছিৎ। গল্পগুলোর বিষয়বস্তু অপ্রথাগত, তাই
সম্পাদকরা আগ্রহ দেখাননি। রচনাশৈলীতে নিরীক্ষা থাকায় পাঠকরাও তার সৃষ্টির
কদর করেনি।
ঢাকাতে সরোজের কোন গতি হচ্ছিলো না, এক ধরনের ব্যর্থতাবোধ কাঁচা বাঁশে ঘুণের মতো তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। ভিডিআইতে কাজ পাওয়ায় বেকার বদনাম যেমন ঘুচেছে, তেমনি প্রতি মাসে হাতে আসছে সামান্য কিছু উপার্জন। এতে দিনযাপনে সচ্ছলতা এসেছে বটে, তবে সহকর্মীদের সংস্থাভিত্তিক সংস্কৃতিতে সে নিজেকে মিশ খাওয়াতে পারছে না। তার দুর্বলমাপের লেখক পরিচিতি ও পাঠাভ্যাস আড়াল-আবডালে উপহাসের বিষয় হয়েছে। নিশিরাতে নিরিবিলিতে বসে ধ্রুপদী সঙ্গীত শোনার হবিও হয়েছে সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্তরায়।
এনজিওর পেশাগত কাজে সে প্রচুর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু সংস্থার এজেন্ডানুযায়ী চলতে পারেনি। আদিবাসী পাত্র সম্প্রদায়ের গ্রামে উন্নয়নমূলক কাজের সূচনায় খানা-জরিপের দায়িত্ব পড়েছিলো তার ওপর। জরিপ করতে গিয়ে সে ছোট্ট নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। সিলেটের সংলগ্ন শহরতলি ছাড়িয়ে চা-বাগানগুলোর ফাঁকফোকরে টিলাশোভিত বনভূমির প্রান্ত-ছোঁয়া মাত্র কয়েকটি গ্রামে এ সম্প্রদায়ের বাস। জনসংখ্যার নিরিখে অত্যন্ত ক্ষুদ্র; তবে এদের ভাষা ও সংস্কৃতি মূলধারার হিন্দু-মুসলমানদের চেয়ে ভিন্ন। এদের সম্পর্কে বইপত্রে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য সরোজ খুঁজে পায়নি। তো এক পর্যায়ে সে নিজে থেকে তাদের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মরীতি, বিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে এসবের ভিত্তিতে লিখেছে একটি প্রবন্ধ। রচনাটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। এতে বিরাগভাজন হন কর্মক্ষেত্রে তার সুপারভাইজার। উনার অভিমত হলো, সরোজের দায়িত্ব হচ্ছে পাত্র গ্রামে এনজিওর নির্দিষ্ট কর্মসূচি বাস্তবায়িত করা। কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কহীন তথ্য সংগ্রহ সম্পর্কে তার আপত্তি। তিনি চাচ্ছেন না- সরোজ ব্যক্তিগত আগ্রহের জন্য সংস্থার সময় ব্যয় করুক। পাত্র গ্রামের কিছু পরিবারের সঙ্গে তার গড়ে উঠেছে সুন্দর সম্পর্ক; এ বিষয়টাও সুপারভাইজার পছন্দ করেননি। মাঠে অনেক বছর ধরে কাজ করা অত্যন্ত সিজনড্ ভদ্রলোক তাকে গ্রাম পর্যায়ে কেবলমাত্র পেশাদারি সম্পর্ক রক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সরোজ চরিত্রের দিক থেকে গহন-বিচারি একজন প্যাশনেট প্রকৃতির পুরুষ। যা তার ভালো লাগে, যে বিষয়ে তার মধ্যে তৈরি হয় প্যাশন, তা অবজ্ঞা করে নৈর্ব্যক্তিক আচরণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তো সে সুপারভাইজারের পরামর্শ উপেক্ষা করেছে। পরিণতিতে মাঠ পর্যায়ে দারুণ পরফরমেন্সের পরও বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট পায়নি সরোজ।
বালুকাময় পথে হোন্ডাটি ফটফটিয়ে থেমে যায়। ঠেলা-ধাক্কা করে সে বাহনটিকে নিয়ে আসে একটি পাখিয়ারা গাছের তলায়, কিন্তু স্টার্ট করতে পারে না। ভারি উদ্বেগ হয়, কলকব্জা কিছু যদি গড়বড় হয়, তাহলে যে সহকর্মীর কাছ থেকে বাইকটি ধার করে এনেছে, তার কাছে সে লজ্জা পাবে। এ বাইকের সহায়তা ছাড়া অফিস-কর্মের চাপের ভেতর এক ফাঁকে হুট করে পাত্র গ্রাম ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা মুশকিল হয়ে পড়বে।
বেশ খানিকটা সময় বাইকটি সারাই করার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে সিগ্রেট ধরায়। স্মোক করতে করতে দেখে, কাছের একটি আমগাছের তিডালার গোড়া থেকে বেরিয়ে এসেছে গোলাপিতে ছোপ ছোপ শুভ্রতা ছড়ানো আমকুড়ালির ফুল। সে ব্যাকপ্যাক থেকে ক্যামেরা বের করতে যায়। তখনই খেয়াল করে, আমকুড়ালির অর্কিড গুচ্ছটি ঘিরে উড়ে উড়ে সুচালো ঠোঁটে মধু চয়ন করছে অত্যন্ত ছোট্ট একটি মৌটুসি পাখি। দৃশ্যটি থেকে ছড়াচ্ছে এমন এক ধরনের মায়া, সে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। ক্যামেরার শাটার টিপতে তার আগ্রহ হয় না। এ অলিম্পিয়া ক্যামেরাটিও সরোজ ধার করে নিয়েছে ভিডিআইর একজন সহকর্মীর কাছ থেকে। বয়সের কারণে অলিম্পিয়া হালফিল তেমন একটা কার্যকর না। এতে ছবি ওঠে বটে, কিন্তু কীভাবে যেন ফিল্মের সর্বত্র আঁকা হয়ে যায় আলোর বেজায় উজ্জ্বল দাগ। এতে আলোকচিত্রের বিষয়বস্তুর ডিটেলস্ ঝাপসা হয়ে পড়ে।
এ ক্যামেরা দিয়ে কয়েক মাস আগে পাত্র সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বণের দারুণ কিছু দৃশ্য ধারণ করেছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আলোকচিত্রগুলো এমনভাবে ঝাপসা হয়েছে যে, এগুলো কোন লেখার সাথে ব্যবহার করার কোন উপায়ই থাকেনি। পাত্রদের পূজার রীতি-রেওয়াজ মূলধারার হিন্দুদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দু দেব-দেবীর আরাধনা তারাও করে থাকে, তবে তাদের অর্চনায় কোন মূর্তি বা বিগ্রহের ব্যবহার নেই। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বহরগুল গ্রামের এক মহিলা- সুরতারিণীর সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। চার সন্তানের জননী বিধবা সুরতারিণী সরোজকে ভাই ডাকেন। গ্রামে গেলে তিনি তাকে তার দাওয়ায় বসিয়ে শসা খেতে দেন। সরোজও তার জন্য কখনো-সখনো নিয়ে যায় গ্লুকোজ বিস্কিটের প্যাকেট। পাত্ররা জংগলের অনেক পত্রলতা ও শিকড়-বাকড়ের রস জারিত করে তৈরি করে 'খর' নামে পরিচিত পানীয়। সুরতারিণী তার ঘরের পেছনে মাটির তলায় শিয়ালের গর্তের মতো সুড়ঙ্গ খুঁড়ে খর প্রক্রিয়াজাত করেন। মাঝেমধ্যে সরোজের ভাগেও জোটে যৎসামান্য ঝাঁঝালো পানীয়। বস্তুটি পান করে সে একবার অফিস ফিরলে, উৎকট গন্ধে তার সুপারভাইজার জোড়া ভুরু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।
সুরতারিণী তাকে পূজার দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। মাস চারেক আগে চৈত্র মাসের অপরাহেপ্ত সরোজ বহরগুলে ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলো। অই দিন সুরতারিণী খর পানে দারুণভাবে মাতেলা ছিলেন। তিনি ক্রমাগত নাসির বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে পাতানো ভাই সরোজকে নিয়ে গিয়েছিলেন পাকুড় গাছের তলায় পূজার থানে। পাত্রদের পূজা-পার্বণে পূজারি ব্রাহ্মণের কোন চল নেই। সুরতারিণীর জেঠা, বহরগুলের বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বি সুরেশ পাত্র পূজা পরিচালনা করছিলেন। লাঠি ভর দেয়া থুরথুরে মানুষটি প্রচুর পানে এমনভাবে বিভোর হয়েছিলেন যে, তিনি ক্যামেরা ব্যবহারে কোন আপত্তি তোলেননি। গাছের গোড়ায় ভারি স্নিগ্ধ চেহারার এক পাত্র-কিশোরী কুলায় করে নিয়ে এসেছিলো পান, সুপারি, নারিকেল, গুড়, কলা প্রভৃতি দিয়ে সাজানো উপাচার।
মেয়েটির নাম রত্নামণি। সে হাসি হাসি মুখে উপাচারের ডালাটি হাতে ছবির জন্য ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়েছিলো। পূজাতে এক জোড়া কবুতর ও গজার মাছ বলি দেয়া হয়। রত্নামণি আধলা ইট দিয়ে বানানো খোলা চুলায় রান্না করে ভোগ। গ্রামবাসীর সাথে সরোজেরও জুটেছিলো কলাপাতায় প্রসাদ। এ ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর বহরগুলে এসে সে ঝাপসা হয়ে ওঠা ফটোগ্রাফের একটি প্রিন্ট মেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো। তাতে রত্নামণি এমন খুশি হয় যে, সে কেবলই সরোজকে জোড়-হাতে প্রণাম জানাতে থাকে।
আজ সুরতারিণীর তালাশে সরোজ বহরগুলে গিয়েছিলো। কিন্তু তিনি বাড়িতে ছিলেন না। প্রতিবেশীদের সাথে বাতচিত করে সে জানতে পারে, সকালবেলা সুরতারিণী গ্রামের দুটো ছেলের কান কাঁটা দিয়ে ফুঁড়ে দেন। কৈশোর অতিক্রান্ত পাত্র ছেলেদের মধ্যে কান ফোঁড়ার রেওয়াজ আছে। এ আচার সম্পাদন করতে গিয়ে সুরতারিণী নাকি পান করেছেন প্রচুর পরিমাণে খর। তারপর হেঁটে গেছেন পিচঢালা রাজসড়কের দিকে। সরোজ ভেবেছিলো, সুরতারিণীকে নিয়ে সে যাবে সুরেশ পাত্রের কাছে। তিনি 'সিটকই' বলে সমাজে পরিচিত, জোর করে পাত্র যুবতীদের অনভিপ্রেতভাবে বিবাহ করা সম্পর্কে কিছু তথ্য দিতে রাজি হয়েছিলেন। তো সুরতারিণীকে না পেয়ে সে একাই চলে গিয়েছিলো সুরেশ পাত্রের ঘরে।
সরোজ ভাবতেও পারেনি, সুরেশ পাত্রের স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়ে এত দ্রুত তিনি মরণাপন্ন হয়ে উঠবেন! ঘরের দাওয়ায় বাতাবি লেবু গাছের ছায়াতলে তাকে চাটাইতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার গলা দিয়ে বেরুচ্ছে ঘড়-ঘড়ে আওয়াজ। কোন ডাক্তার-কবিরাজের ব্যবস্থা নেই। পাশে বসে রত্নামণি বাটি থেকে কেরাইয়া পাতার রস ত্যানা দিয়ে তুলে লেপে দিচ্ছে মরণাপন্ন বৃদ্ধের কপালে। তাকে দেখতে পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয় রত্নামণি। তার হলুদাভ আভা ছড়ানো ত্বক যেন জ্বলে-পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। রাহুগ্রাসে বিলুপ্ত হওয়া জ্যোৎস্নার মতো মেয়েটির অবয়ব থেকে মুছে গেছে স্নিগ্ধ শ্রী।
রত্নামণির হাতে ঝাপসা ফটোগ্রাফটি তুলে দেয়ার ঠিক চার দিন পর মেয়েটি কলসি কাঁখে পানি আনতে যায়। সেনানিবাসের সংলগ্ন হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের জংলা ভূমিতে হামেশা সৈনিকদের মহড়া চলে। যতটা জানা যায়, জল নিয়ে ফেরার পথে দু'জন সৈনিক বিন্নাঝোপের আড়ালে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ভায়োলেন্টভাবে ধর্ষণ করে। এতে তার জননেন্দ্রিয় জখম হয় মারাত্মকভাবে। ভিডিআইর এক মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে এ তথ্য পেয়ে সরোজ চেষ্টা করেছিলো রত্নামণির নাম উল্লেখ না করে স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদটি ছাপানোর। কিন্তু দেশে চলছে জেনারেল এরশাদের কড়া মার্শাল-ল। যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া কোন পত্রিকা এ ধরনের সংবাদ ছাপতে রাজি হয় না।
রত্নামণির প্রসঙ্গ মনে আসতেই তার মধ্যে বিচিত্র এক অনুভূতি হয়। কিশোরীটি সুদর্শনা; আকর্ষণ বলতে যা বোঝায়, সরোজ কখনো তা ফিল করেনি, বরং স্নেহটাই তার সংবেদনে প্রধান হয়ে উঠেছে। শরীরে নারীত্ব ফুটে ওঠার কারণে একটি মেয়েকে দৈহিকভাবে বিক্ষত হতে হবে, আঘাত ও অপমানের বোঝা জনমভর বয়ে বেড়াতে হবে- এ ব্যাপারটা সরোজ মেনে নিতে পারে না। কিন্তু বিহিত কিছু করার মতো সামাজিক শক্তিও তার নেই। এ অসহায়বোধ থেকে তার মধ্যে জন্ম নেয় ক্রোধ। সে তেড়িয়া হয়ে বাইকের স্টার্টারে কিক কষায়। স্রেফ কপালগুণে তা চালু হয়। বাহনটি ম্যানেজ করতে করতে ফের সে সুরেশ পাত্রের কথা ভাবে। কথাবার্তায় সরোজ জেনেছে যে, কিছু পাত্র মেয়ে শরীরীভাবে হয়রানির শিকার হয়েছে মূলধারার জনগোষ্ঠীর যুবকদের হাতে। পরিণতিতে কোন কোন যুবক জোর করে পাত্র মেয়েকে বিয়েও করেছে। এ বিষয়টা পাত্র ভাষায় 'সিটকই' বলে পরিচিত। সিটকই-এর শিকার মেয়েদের পাত্র সমাজে সহানুভূতির চোখে দেখা হয় না। সুরেশ বুড়ো তাকে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। দোষ তারই, সময়মতো সে ফলোআপ করেনি। কারণ সুপারভাইজারের নির্দেশে প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য তাকে যেতে হয়েছিলো কুষ্টিয়া, বরিশাল ও খুলনায় তিন-তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ট্রিপে। কোনভাবেই সুরেশ পাত্রের ফের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য সময় করে উঠতে পারছিলো না। ভাবতে ভাবতে সরোজের কেবলই মনে হতে থাকে, সুরেশ পাত্রের পরলোকপ্রাপ্তির ভেতর দিয়ে সামাজিকভাবে কিছু অন্যায় সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য হারিয়ে যাবে।
মলই পাড়ার কাছে বাঁক নিতে গিয়ে সে দেখে, গ্লাবেত বনের ঝোপটির আড়ালে বসে নকুল পাত্র কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করছেন অঙ্গার। মনে হয়, শতাব্দীকাল থেকে পাত্র পুরুষরা অঙ্গার তৈরি করে তা চায়ের দোকান প্রভৃতিতে সরবরাহ করার ব্যবসা করে আসছেন। সরোজ বাইকের স্টার্ট চালু রেখে মাটিতে পা ঠেকিয়ে তা থামায়। সে নকুলের কাছে জানতে চায়- কোথায় সুরতারিণী দিদি? জবাবে জানা যায়- তার শরীর খারাপ, জ্বর-জারি ও কফ-কাশিতে কষ্ট পাচ্ছেন, তো তিনি সরোজের তালাশে তার অফিসের দিকে গিয়েছেন। শুনতে পেয়ে প্রমাদ গুনে ফের সে তোড়ে বাইক হাঁকায়। যেতে যেতে মন থেকে নকুল পাত্রের সম্প্রতি নিগৃহীত হওয়ার বিষয়টি এড়াতে পারে না। পাত্র পুরুষদের সনাতনী ব্যবসা অঙ্গার তৈরির জন্য কাঠ কুড়াতে গিয়ে তিনি বন বিভাগের কর্মীর হাতে ধৃত হয়েছিলেন মাস খানেক আগে। ফরেস্ট গার্ডরা তাকে গাছের সাথে বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটায়। এতে তার পায়ে মারাত্মকভাবে জখম হয়। বর্তমানে নকুল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। ভিডিআই অফিসের কাছাকাছি এসে সরোজের কেবলই মনে হতে থাকে, হাল জামানার রিজার্ভ ফরেস্ট তো এক যুগে পাত্র সম্প্রদায়ের খাসভূমি ছিলো। ব্রিটিশ প্রশাসকরা জোর করে পত্তনি দিয়ে অনায্যভাবে রিজার্ভ ফরেস্ট গড়ে তোলে। তো নকুল- হলেনই বা তিনি বনতস্কর, তাই বলে তাকে বেঁধে পেটাবে? অন্যান্য আদিবাসী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মতো পাত্রদের একটি কল্যাণ সমিতি থাকলে এ বাবদে প্রতিবাদ করা যেত।
অফিসের বারান্দায় দেখা হয় সুপারভাইজারের সঙ্গে। অবাক হয় সরোজ! তিনি না সকালে ব্রাঞ্চ অফিস পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন! তার তো এত তাড়াতাড়ি ফেরার কথা না? প্রৌঢ় ভদ্রলোকের চুল উসকোখুসকো হয়ে আছে, কলপের কালিমালিপ্ত কেশগুচ্ছের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে ছোপ ছোপ ধূসরাভা। তিনি বিদ্রূপাত্মকভাবে বলেন, 'তোমার পাত্র রিলেটিভ বসে আছেন রিসেপশন লাউঞ্জে; যাও, মেহমানদারি করো।'
বেতের চেয়ারে বসে চুপচাপ ঝিমাচ্ছিলেন সুরতারিণী। রোদে পুড়ে তার চোখমুখ এত কালো হয়েছে যে; মনে হয়, মহিলা পোড়া অঙ্গার ছেনে এসেছেন। তার কাঁধ থেকে খসে পড়েছে আঁচল, চতুর্দিকে ছড়াচ্ছে খরের ঝাঁঝালো গন্ধ। সরোজকে দেখতে পেয়ে আধপোড়া বিড়িটি মুখে দিয়ে ফস করে দেশলাইয়ের কাঠি ঘষেন। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে সরোজ বুঝতে পারে, তার দিদি ক্যাসেটটি ফেরত চাচ্ছেন। ঘটনা হলো, মাস দুয়েক আগে সরোজ অনানুষ্ঠানিকভাবে সুরতারিণীর সাক্ষাৎকার একটি ক্যাসেটে ধারণ করে। এতে টেপ করা আছে পাত্র সম্প্রদায়ের জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্য। তিনি কেন ক্যাসেটটি ফেরত চাচ্ছেন- তা জানতে গিয়ে তার তাজ্জব হওয়ার দশা হয়! সুরতারিণীর জেঠা সুরেশ পাত্র মশাইয়ের জ্যোতিষ শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি আছে। তিনি গ্রহ-নক্ষত্র বিচরিয়ে অনেক দিন আগে নাকি বলেছিলেন, তার ভাই এর কন্যার মৃত্যু হবে তার মৃত্যুর ঠিক সাত দিন পর। গ্রহ-নক্ষত্রের ফের তো খণ্ডানোর কোন উপায় নেই। এখন সমস্যা হচ্ছে- পরলোকপ্রাপ্তির পরপরই মরদেহ দাহ করার বিধান, কিন্তু দেহটি ভস্ম হলেও তার ধারণকৃত বক্তব্য থেকে যাবে পৃথিবীতে। তো সুরতারিণী দেহে প্রাণ থাকাবস্থায় ক্যাসেটটি পুড়িয়ে ফেলতে চান। অনেক কথাবার্তা বলেও সরোজ ক্যাসেটটি না পোড়ানোর ব্যাপারে সুরতারিণীকে কনভিন্স করতে পারে না।
ক্যাসেটটি থেকে জরুরি উপাত্ত ট্রান্সক্রিপ্ট করে নোটবুকে টুকে ফেলা হয়নি। তো সরোজের করোটিতে একটি ধূর্ত আইডিয়া খেলে যায়। অন্য একটি ক্যাসেটে উপাত্ত রিরেকর্ড করে সুরতারিণীকে তা ফেরত দেয়া যেতে পারে। কিন্তু অফিসে এম্পটি কোন ক্যাসেট নেই। সিলেট শহরে গিয়ে এ মুহূর্তে তা কিনে আনারও কোন উপায় নেই। কারণ সামরিক সরকারের নির্দেশে ছাত্রমিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করার প্রতিবাদে হরতাল চলছে। তাই বাইক হাঁকিয়ে শহরে গিয়ে ক্যাসেট কিনে আনা অসম্ভব।
তো বিষয়টি আদ্যোপান্ত ভেবে সে সুরতারিণীর কাছে ক্যাসেট ফেরত দেয়ার জন্য তিন দিন সময় চেয়ে নেয়। মহিলা কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে থেকে বিড়িতে দীর্ঘ দম দিয়ে আস্তে আস্তে অফিস থেকে বেরিয়ে যান। সরোজও তার সাথে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। বিদায় দিতে গিয়ে মনে হয়, মহিলা হচ্ছেন গবেষণার পরিভাষায় একজন ইনফরম্যান্ট। তিনি যে তথ্য সরবরাহ করেছেন, তার অধিকার আছে তা ফিরিয়ে নেয়ার। তবে কি সে ক্যাসেটটি ফেরত দেবে? কিন্তু এ উপাত্তকে ভিত্তি করে সে লিখতে চাচ্ছে আরেকটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ। হামেশা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগার সমস্যা আছে তার। কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। খুক-খুকিয়ে কাশতে কাশতে সুরতারিণী সিঁড়ির কাছে থুক করে এক দলা কাশ ফেলেন। তারপর তার পাতানো দিদিটি হেঁটে যান দূরের জংগলশোভিত পল্লীর দিকে। অফিসের কামরায় ফেরার আগে নোংরা থুথুর দিকে সরোজের চোখ পড়ে। ওখানে রক্তের ছিটা দেখতে পেয়ে ভারি উদ্বেগ হয়। কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তার দারুণ অসহায় লাগে।
ঢাকাতে সরোজের কোন গতি হচ্ছিলো না, এক ধরনের ব্যর্থতাবোধ কাঁচা বাঁশে ঘুণের মতো তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। ভিডিআইতে কাজ পাওয়ায় বেকার বদনাম যেমন ঘুচেছে, তেমনি প্রতি মাসে হাতে আসছে সামান্য কিছু উপার্জন। এতে দিনযাপনে সচ্ছলতা এসেছে বটে, তবে সহকর্মীদের সংস্থাভিত্তিক সংস্কৃতিতে সে নিজেকে মিশ খাওয়াতে পারছে না। তার দুর্বলমাপের লেখক পরিচিতি ও পাঠাভ্যাস আড়াল-আবডালে উপহাসের বিষয় হয়েছে। নিশিরাতে নিরিবিলিতে বসে ধ্রুপদী সঙ্গীত শোনার হবিও হয়েছে সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্তরায়।
এনজিওর পেশাগত কাজে সে প্রচুর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু সংস্থার এজেন্ডানুযায়ী চলতে পারেনি। আদিবাসী পাত্র সম্প্রদায়ের গ্রামে উন্নয়নমূলক কাজের সূচনায় খানা-জরিপের দায়িত্ব পড়েছিলো তার ওপর। জরিপ করতে গিয়ে সে ছোট্ট নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। সিলেটের সংলগ্ন শহরতলি ছাড়িয়ে চা-বাগানগুলোর ফাঁকফোকরে টিলাশোভিত বনভূমির প্রান্ত-ছোঁয়া মাত্র কয়েকটি গ্রামে এ সম্প্রদায়ের বাস। জনসংখ্যার নিরিখে অত্যন্ত ক্ষুদ্র; তবে এদের ভাষা ও সংস্কৃতি মূলধারার হিন্দু-মুসলমানদের চেয়ে ভিন্ন। এদের সম্পর্কে বইপত্রে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য সরোজ খুঁজে পায়নি। তো এক পর্যায়ে সে নিজে থেকে তাদের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মরীতি, বিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে এসবের ভিত্তিতে লিখেছে একটি প্রবন্ধ। রচনাটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। এতে বিরাগভাজন হন কর্মক্ষেত্রে তার সুপারভাইজার। উনার অভিমত হলো, সরোজের দায়িত্ব হচ্ছে পাত্র গ্রামে এনজিওর নির্দিষ্ট কর্মসূচি বাস্তবায়িত করা। কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কহীন তথ্য সংগ্রহ সম্পর্কে তার আপত্তি। তিনি চাচ্ছেন না- সরোজ ব্যক্তিগত আগ্রহের জন্য সংস্থার সময় ব্যয় করুক। পাত্র গ্রামের কিছু পরিবারের সঙ্গে তার গড়ে উঠেছে সুন্দর সম্পর্ক; এ বিষয়টাও সুপারভাইজার পছন্দ করেননি। মাঠে অনেক বছর ধরে কাজ করা অত্যন্ত সিজনড্ ভদ্রলোক তাকে গ্রাম পর্যায়ে কেবলমাত্র পেশাদারি সম্পর্ক রক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সরোজ চরিত্রের দিক থেকে গহন-বিচারি একজন প্যাশনেট প্রকৃতির পুরুষ। যা তার ভালো লাগে, যে বিষয়ে তার মধ্যে তৈরি হয় প্যাশন, তা অবজ্ঞা করে নৈর্ব্যক্তিক আচরণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তো সে সুপারভাইজারের পরামর্শ উপেক্ষা করেছে। পরিণতিতে মাঠ পর্যায়ে দারুণ পরফরমেন্সের পরও বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট পায়নি সরোজ।
বালুকাময় পথে হোন্ডাটি ফটফটিয়ে থেমে যায়। ঠেলা-ধাক্কা করে সে বাহনটিকে নিয়ে আসে একটি পাখিয়ারা গাছের তলায়, কিন্তু স্টার্ট করতে পারে না। ভারি উদ্বেগ হয়, কলকব্জা কিছু যদি গড়বড় হয়, তাহলে যে সহকর্মীর কাছ থেকে বাইকটি ধার করে এনেছে, তার কাছে সে লজ্জা পাবে। এ বাইকের সহায়তা ছাড়া অফিস-কর্মের চাপের ভেতর এক ফাঁকে হুট করে পাত্র গ্রাম ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা মুশকিল হয়ে পড়বে।
বেশ খানিকটা সময় বাইকটি সারাই করার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে সিগ্রেট ধরায়। স্মোক করতে করতে দেখে, কাছের একটি আমগাছের তিডালার গোড়া থেকে বেরিয়ে এসেছে গোলাপিতে ছোপ ছোপ শুভ্রতা ছড়ানো আমকুড়ালির ফুল। সে ব্যাকপ্যাক থেকে ক্যামেরা বের করতে যায়। তখনই খেয়াল করে, আমকুড়ালির অর্কিড গুচ্ছটি ঘিরে উড়ে উড়ে সুচালো ঠোঁটে মধু চয়ন করছে অত্যন্ত ছোট্ট একটি মৌটুসি পাখি। দৃশ্যটি থেকে ছড়াচ্ছে এমন এক ধরনের মায়া, সে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। ক্যামেরার শাটার টিপতে তার আগ্রহ হয় না। এ অলিম্পিয়া ক্যামেরাটিও সরোজ ধার করে নিয়েছে ভিডিআইর একজন সহকর্মীর কাছ থেকে। বয়সের কারণে অলিম্পিয়া হালফিল তেমন একটা কার্যকর না। এতে ছবি ওঠে বটে, কিন্তু কীভাবে যেন ফিল্মের সর্বত্র আঁকা হয়ে যায় আলোর বেজায় উজ্জ্বল দাগ। এতে আলোকচিত্রের বিষয়বস্তুর ডিটেলস্ ঝাপসা হয়ে পড়ে।
এ ক্যামেরা দিয়ে কয়েক মাস আগে পাত্র সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বণের দারুণ কিছু দৃশ্য ধারণ করেছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আলোকচিত্রগুলো এমনভাবে ঝাপসা হয়েছে যে, এগুলো কোন লেখার সাথে ব্যবহার করার কোন উপায়ই থাকেনি। পাত্রদের পূজার রীতি-রেওয়াজ মূলধারার হিন্দুদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দু দেব-দেবীর আরাধনা তারাও করে থাকে, তবে তাদের অর্চনায় কোন মূর্তি বা বিগ্রহের ব্যবহার নেই। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বহরগুল গ্রামের এক মহিলা- সুরতারিণীর সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। চার সন্তানের জননী বিধবা সুরতারিণী সরোজকে ভাই ডাকেন। গ্রামে গেলে তিনি তাকে তার দাওয়ায় বসিয়ে শসা খেতে দেন। সরোজও তার জন্য কখনো-সখনো নিয়ে যায় গ্লুকোজ বিস্কিটের প্যাকেট। পাত্ররা জংগলের অনেক পত্রলতা ও শিকড়-বাকড়ের রস জারিত করে তৈরি করে 'খর' নামে পরিচিত পানীয়। সুরতারিণী তার ঘরের পেছনে মাটির তলায় শিয়ালের গর্তের মতো সুড়ঙ্গ খুঁড়ে খর প্রক্রিয়াজাত করেন। মাঝেমধ্যে সরোজের ভাগেও জোটে যৎসামান্য ঝাঁঝালো পানীয়। বস্তুটি পান করে সে একবার অফিস ফিরলে, উৎকট গন্ধে তার সুপারভাইজার জোড়া ভুরু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।
সুরতারিণী তাকে পূজার দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। মাস চারেক আগে চৈত্র মাসের অপরাহেপ্ত সরোজ বহরগুলে ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলো। অই দিন সুরতারিণী খর পানে দারুণভাবে মাতেলা ছিলেন। তিনি ক্রমাগত নাসির বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে পাতানো ভাই সরোজকে নিয়ে গিয়েছিলেন পাকুড় গাছের তলায় পূজার থানে। পাত্রদের পূজা-পার্বণে পূজারি ব্রাহ্মণের কোন চল নেই। সুরতারিণীর জেঠা, বহরগুলের বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বি সুরেশ পাত্র পূজা পরিচালনা করছিলেন। লাঠি ভর দেয়া থুরথুরে মানুষটি প্রচুর পানে এমনভাবে বিভোর হয়েছিলেন যে, তিনি ক্যামেরা ব্যবহারে কোন আপত্তি তোলেননি। গাছের গোড়ায় ভারি স্নিগ্ধ চেহারার এক পাত্র-কিশোরী কুলায় করে নিয়ে এসেছিলো পান, সুপারি, নারিকেল, গুড়, কলা প্রভৃতি দিয়ে সাজানো উপাচার।
মেয়েটির নাম রত্নামণি। সে হাসি হাসি মুখে উপাচারের ডালাটি হাতে ছবির জন্য ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়েছিলো। পূজাতে এক জোড়া কবুতর ও গজার মাছ বলি দেয়া হয়। রত্নামণি আধলা ইট দিয়ে বানানো খোলা চুলায় রান্না করে ভোগ। গ্রামবাসীর সাথে সরোজেরও জুটেছিলো কলাপাতায় প্রসাদ। এ ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর বহরগুলে এসে সে ঝাপসা হয়ে ওঠা ফটোগ্রাফের একটি প্রিন্ট মেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো। তাতে রত্নামণি এমন খুশি হয় যে, সে কেবলই সরোজকে জোড়-হাতে প্রণাম জানাতে থাকে।
আজ সুরতারিণীর তালাশে সরোজ বহরগুলে গিয়েছিলো। কিন্তু তিনি বাড়িতে ছিলেন না। প্রতিবেশীদের সাথে বাতচিত করে সে জানতে পারে, সকালবেলা সুরতারিণী গ্রামের দুটো ছেলের কান কাঁটা দিয়ে ফুঁড়ে দেন। কৈশোর অতিক্রান্ত পাত্র ছেলেদের মধ্যে কান ফোঁড়ার রেওয়াজ আছে। এ আচার সম্পাদন করতে গিয়ে সুরতারিণী নাকি পান করেছেন প্রচুর পরিমাণে খর। তারপর হেঁটে গেছেন পিচঢালা রাজসড়কের দিকে। সরোজ ভেবেছিলো, সুরতারিণীকে নিয়ে সে যাবে সুরেশ পাত্রের কাছে। তিনি 'সিটকই' বলে সমাজে পরিচিত, জোর করে পাত্র যুবতীদের অনভিপ্রেতভাবে বিবাহ করা সম্পর্কে কিছু তথ্য দিতে রাজি হয়েছিলেন। তো সুরতারিণীকে না পেয়ে সে একাই চলে গিয়েছিলো সুরেশ পাত্রের ঘরে।
সরোজ ভাবতেও পারেনি, সুরেশ পাত্রের স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়ে এত দ্রুত তিনি মরণাপন্ন হয়ে উঠবেন! ঘরের দাওয়ায় বাতাবি লেবু গাছের ছায়াতলে তাকে চাটাইতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার গলা দিয়ে বেরুচ্ছে ঘড়-ঘড়ে আওয়াজ। কোন ডাক্তার-কবিরাজের ব্যবস্থা নেই। পাশে বসে রত্নামণি বাটি থেকে কেরাইয়া পাতার রস ত্যানা দিয়ে তুলে লেপে দিচ্ছে মরণাপন্ন বৃদ্ধের কপালে। তাকে দেখতে পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয় রত্নামণি। তার হলুদাভ আভা ছড়ানো ত্বক যেন জ্বলে-পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। রাহুগ্রাসে বিলুপ্ত হওয়া জ্যোৎস্নার মতো মেয়েটির অবয়ব থেকে মুছে গেছে স্নিগ্ধ শ্রী।
রত্নামণির হাতে ঝাপসা ফটোগ্রাফটি তুলে দেয়ার ঠিক চার দিন পর মেয়েটি কলসি কাঁখে পানি আনতে যায়। সেনানিবাসের সংলগ্ন হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের জংলা ভূমিতে হামেশা সৈনিকদের মহড়া চলে। যতটা জানা যায়, জল নিয়ে ফেরার পথে দু'জন সৈনিক বিন্নাঝোপের আড়ালে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ভায়োলেন্টভাবে ধর্ষণ করে। এতে তার জননেন্দ্রিয় জখম হয় মারাত্মকভাবে। ভিডিআইর এক মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে এ তথ্য পেয়ে সরোজ চেষ্টা করেছিলো রত্নামণির নাম উল্লেখ না করে স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদটি ছাপানোর। কিন্তু দেশে চলছে জেনারেল এরশাদের কড়া মার্শাল-ল। যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া কোন পত্রিকা এ ধরনের সংবাদ ছাপতে রাজি হয় না।
রত্নামণির প্রসঙ্গ মনে আসতেই তার মধ্যে বিচিত্র এক অনুভূতি হয়। কিশোরীটি সুদর্শনা; আকর্ষণ বলতে যা বোঝায়, সরোজ কখনো তা ফিল করেনি, বরং স্নেহটাই তার সংবেদনে প্রধান হয়ে উঠেছে। শরীরে নারীত্ব ফুটে ওঠার কারণে একটি মেয়েকে দৈহিকভাবে বিক্ষত হতে হবে, আঘাত ও অপমানের বোঝা জনমভর বয়ে বেড়াতে হবে- এ ব্যাপারটা সরোজ মেনে নিতে পারে না। কিন্তু বিহিত কিছু করার মতো সামাজিক শক্তিও তার নেই। এ অসহায়বোধ থেকে তার মধ্যে জন্ম নেয় ক্রোধ। সে তেড়িয়া হয়ে বাইকের স্টার্টারে কিক কষায়। স্রেফ কপালগুণে তা চালু হয়। বাহনটি ম্যানেজ করতে করতে ফের সে সুরেশ পাত্রের কথা ভাবে। কথাবার্তায় সরোজ জেনেছে যে, কিছু পাত্র মেয়ে শরীরীভাবে হয়রানির শিকার হয়েছে মূলধারার জনগোষ্ঠীর যুবকদের হাতে। পরিণতিতে কোন কোন যুবক জোর করে পাত্র মেয়েকে বিয়েও করেছে। এ বিষয়টা পাত্র ভাষায় 'সিটকই' বলে পরিচিত। সিটকই-এর শিকার মেয়েদের পাত্র সমাজে সহানুভূতির চোখে দেখা হয় না। সুরেশ বুড়ো তাকে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। দোষ তারই, সময়মতো সে ফলোআপ করেনি। কারণ সুপারভাইজারের নির্দেশে প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য তাকে যেতে হয়েছিলো কুষ্টিয়া, বরিশাল ও খুলনায় তিন-তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ট্রিপে। কোনভাবেই সুরেশ পাত্রের ফের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য সময় করে উঠতে পারছিলো না। ভাবতে ভাবতে সরোজের কেবলই মনে হতে থাকে, সুরেশ পাত্রের পরলোকপ্রাপ্তির ভেতর দিয়ে সামাজিকভাবে কিছু অন্যায় সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য হারিয়ে যাবে।
মলই পাড়ার কাছে বাঁক নিতে গিয়ে সে দেখে, গ্লাবেত বনের ঝোপটির আড়ালে বসে নকুল পাত্র কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করছেন অঙ্গার। মনে হয়, শতাব্দীকাল থেকে পাত্র পুরুষরা অঙ্গার তৈরি করে তা চায়ের দোকান প্রভৃতিতে সরবরাহ করার ব্যবসা করে আসছেন। সরোজ বাইকের স্টার্ট চালু রেখে মাটিতে পা ঠেকিয়ে তা থামায়। সে নকুলের কাছে জানতে চায়- কোথায় সুরতারিণী দিদি? জবাবে জানা যায়- তার শরীর খারাপ, জ্বর-জারি ও কফ-কাশিতে কষ্ট পাচ্ছেন, তো তিনি সরোজের তালাশে তার অফিসের দিকে গিয়েছেন। শুনতে পেয়ে প্রমাদ গুনে ফের সে তোড়ে বাইক হাঁকায়। যেতে যেতে মন থেকে নকুল পাত্রের সম্প্রতি নিগৃহীত হওয়ার বিষয়টি এড়াতে পারে না। পাত্র পুরুষদের সনাতনী ব্যবসা অঙ্গার তৈরির জন্য কাঠ কুড়াতে গিয়ে তিনি বন বিভাগের কর্মীর হাতে ধৃত হয়েছিলেন মাস খানেক আগে। ফরেস্ট গার্ডরা তাকে গাছের সাথে বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটায়। এতে তার পায়ে মারাত্মকভাবে জখম হয়। বর্তমানে নকুল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। ভিডিআই অফিসের কাছাকাছি এসে সরোজের কেবলই মনে হতে থাকে, হাল জামানার রিজার্ভ ফরেস্ট তো এক যুগে পাত্র সম্প্রদায়ের খাসভূমি ছিলো। ব্রিটিশ প্রশাসকরা জোর করে পত্তনি দিয়ে অনায্যভাবে রিজার্ভ ফরেস্ট গড়ে তোলে। তো নকুল- হলেনই বা তিনি বনতস্কর, তাই বলে তাকে বেঁধে পেটাবে? অন্যান্য আদিবাসী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মতো পাত্রদের একটি কল্যাণ সমিতি থাকলে এ বাবদে প্রতিবাদ করা যেত।
অফিসের বারান্দায় দেখা হয় সুপারভাইজারের সঙ্গে। অবাক হয় সরোজ! তিনি না সকালে ব্রাঞ্চ অফিস পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন! তার তো এত তাড়াতাড়ি ফেরার কথা না? প্রৌঢ় ভদ্রলোকের চুল উসকোখুসকো হয়ে আছে, কলপের কালিমালিপ্ত কেশগুচ্ছের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে ছোপ ছোপ ধূসরাভা। তিনি বিদ্রূপাত্মকভাবে বলেন, 'তোমার পাত্র রিলেটিভ বসে আছেন রিসেপশন লাউঞ্জে; যাও, মেহমানদারি করো।'
বেতের চেয়ারে বসে চুপচাপ ঝিমাচ্ছিলেন সুরতারিণী। রোদে পুড়ে তার চোখমুখ এত কালো হয়েছে যে; মনে হয়, মহিলা পোড়া অঙ্গার ছেনে এসেছেন। তার কাঁধ থেকে খসে পড়েছে আঁচল, চতুর্দিকে ছড়াচ্ছে খরের ঝাঁঝালো গন্ধ। সরোজকে দেখতে পেয়ে আধপোড়া বিড়িটি মুখে দিয়ে ফস করে দেশলাইয়ের কাঠি ঘষেন। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে সরোজ বুঝতে পারে, তার দিদি ক্যাসেটটি ফেরত চাচ্ছেন। ঘটনা হলো, মাস দুয়েক আগে সরোজ অনানুষ্ঠানিকভাবে সুরতারিণীর সাক্ষাৎকার একটি ক্যাসেটে ধারণ করে। এতে টেপ করা আছে পাত্র সম্প্রদায়ের জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্য। তিনি কেন ক্যাসেটটি ফেরত চাচ্ছেন- তা জানতে গিয়ে তার তাজ্জব হওয়ার দশা হয়! সুরতারিণীর জেঠা সুরেশ পাত্র মশাইয়ের জ্যোতিষ শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি আছে। তিনি গ্রহ-নক্ষত্র বিচরিয়ে অনেক দিন আগে নাকি বলেছিলেন, তার ভাই এর কন্যার মৃত্যু হবে তার মৃত্যুর ঠিক সাত দিন পর। গ্রহ-নক্ষত্রের ফের তো খণ্ডানোর কোন উপায় নেই। এখন সমস্যা হচ্ছে- পরলোকপ্রাপ্তির পরপরই মরদেহ দাহ করার বিধান, কিন্তু দেহটি ভস্ম হলেও তার ধারণকৃত বক্তব্য থেকে যাবে পৃথিবীতে। তো সুরতারিণী দেহে প্রাণ থাকাবস্থায় ক্যাসেটটি পুড়িয়ে ফেলতে চান। অনেক কথাবার্তা বলেও সরোজ ক্যাসেটটি না পোড়ানোর ব্যাপারে সুরতারিণীকে কনভিন্স করতে পারে না।
ক্যাসেটটি থেকে জরুরি উপাত্ত ট্রান্সক্রিপ্ট করে নোটবুকে টুকে ফেলা হয়নি। তো সরোজের করোটিতে একটি ধূর্ত আইডিয়া খেলে যায়। অন্য একটি ক্যাসেটে উপাত্ত রিরেকর্ড করে সুরতারিণীকে তা ফেরত দেয়া যেতে পারে। কিন্তু অফিসে এম্পটি কোন ক্যাসেট নেই। সিলেট শহরে গিয়ে এ মুহূর্তে তা কিনে আনারও কোন উপায় নেই। কারণ সামরিক সরকারের নির্দেশে ছাত্রমিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করার প্রতিবাদে হরতাল চলছে। তাই বাইক হাঁকিয়ে শহরে গিয়ে ক্যাসেট কিনে আনা অসম্ভব।
তো বিষয়টি আদ্যোপান্ত ভেবে সে সুরতারিণীর কাছে ক্যাসেট ফেরত দেয়ার জন্য তিন দিন সময় চেয়ে নেয়। মহিলা কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে থেকে বিড়িতে দীর্ঘ দম দিয়ে আস্তে আস্তে অফিস থেকে বেরিয়ে যান। সরোজও তার সাথে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। বিদায় দিতে গিয়ে মনে হয়, মহিলা হচ্ছেন গবেষণার পরিভাষায় একজন ইনফরম্যান্ট। তিনি যে তথ্য সরবরাহ করেছেন, তার অধিকার আছে তা ফিরিয়ে নেয়ার। তবে কি সে ক্যাসেটটি ফেরত দেবে? কিন্তু এ উপাত্তকে ভিত্তি করে সে লিখতে চাচ্ছে আরেকটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ। হামেশা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগার সমস্যা আছে তার। কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। খুক-খুকিয়ে কাশতে কাশতে সুরতারিণী সিঁড়ির কাছে থুক করে এক দলা কাশ ফেলেন। তারপর তার পাতানো দিদিটি হেঁটে যান দূরের জংগলশোভিত পল্লীর দিকে। অফিসের কামরায় ফেরার আগে নোংরা থুথুর দিকে সরোজের চোখ পড়ে। ওখানে রক্তের ছিটা দেখতে পেয়ে ভারি উদ্বেগ হয়। কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তার দারুণ অসহায় লাগে।
No comments