মুক্তিযুদ্ধের গল্প- খুকী by আন্দালিব রাশদী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
দুই মাসের ভাড়া বাকি পড়লে বাড়িওয়ালার বউ ভাড়াটের বউকে যাচ্ছেতাই বলতেই পারেন। এটা দোষের কিছু নয়। ভাড়া ১০০ টাকা হলেও একটা কথা ছিল, মাত্র ৬০। ট্যাপের পানি, দুটো ফ্যান, তিন-চারটে ১০০ ওয়াটের বাল্ব। ভাড়া ছিল ৪৫, কারেন্ট লাগিয়েই ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিল।
খুব নোংরা একটা কথা হজম করতে হলো মাকে। এমন ধিঙ্গি মেয়েটাকে ছাতার মাথা কী পড়াচ্ছ—মেয়ে কবে জজ-ব্যারিস্টার হবে তারপর ভাড়ার টাকা শোধ করবে! ধিঙ্গিটার পেছনে যে টাকা খরচ করো, সেটা বন্ধ রাখলেও এক মাসের ভাড়া শোধ করতে পারতে। বরং রাস্তায় নামিয়ে দাও, প্রতি রাতে পাঁচ-দশ টাকা তো কামাবে। এ রকম মেয়ের রেট ভালো।
এমন চাপের মুখে আমার মায়ের চোখ ছলছল করতে থাকে।
আমিই এগিয়ে গিয়ে বলি, খালাম্মা, দু-এক দিনের মধ্যে টাকা দিয়ে দেব, বাবা আমাদের গ্রামের একটা জমি বেচতে গেছেন।

আমার কথায় তিনি আরও চটে গিয়ে বললেন, পাছার নাই ছাল, কোন জমিদারের...(কথাটা ছালের সঙ্গে মিল দিয়ে বলা, কিন্তু লেখা যাবে না, সমস্যা আছে)!
তিনি দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, নামের কী বাহার। জান্নাতুল ফেরদৌস। এমন পাইলা-কালা গায়ের রঙের মেয়ে তো জাহান্নামেও খুঁজে পাওয়া যাবে না—তার নাম জান্নাতুল ফেরদৌস। আবার গানও গায়। গত মাসেই তো বলেছি, প্যাঁ-পো করার যন্ত্রটা বেচে দিলেও ভাড়ার টাকা শোধ করা যায়। নাকি ভুল বললাম?
তিনি আমাদের উঠানে একদলা থুতু ফেলে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ৩১ তারিখের মধ্যে ভাড়া শোধ না করতে পারলে তোদের সবার নেংটি খুলে রাস্তায় বের করে দেব।
তাঁর ক্ষোভ আমার প্যাঁ-পো করার যন্ত্র হারমোনিয়ামটার ওপর। তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলের পরিমল স্যারের এক কাঁধে ঝোলা সব সময়ই থাকত, পায়ে জুতো-স্যান্ডেল কেউ দেখেনি, ভারী হারমোনিয়ামটা অন্য কাঁধে নিয়ে আমাদের বাসায় এলেন। বাসা মানে ভাড়া বাসাটা—রাজাবাজার মসজিদ থেকে খানিকটা উত্তরে গিয়ে একটা পাকা কবরের পাশ দিয়ে পশ্চিমে।
পরিমল স্যার বললেন, তোর গানের গলা ভালো। এটা দিলাম। আমি যে এনেছি, আমার টাকাপয়সা লাগেনি। এক ছাত্রীর বাড়িতে দেখলাম যন্ত্রটা ধুলোতে ঢাকা পড়ে আছে। বললাম, নিই। ছাত্রীর মা বলল, আচ্ছা।
আমি সত্তরে সেকেন্ড ডিভিশনে স্কুল ফাইনাল পাস করেছি, পাঁচ শ আশি। ফিফটি এইট পার্সেন্ট। আমরা বলি হায়ার সেকেন্ড ক্লাস। স্কুলের নাম নাজনীন হাইস্কুল, আমি ছিলাম মর্নিং শিফটে।
হেসেখেলে ইডেন কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। কিন্তু ক্লাসের দেখা নেই। একটা কিছু চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চূড়ান্ত মানে—ক্ষমতা যাবে শেখ সাহেবের হাতে।
মা বাবাকে বললেন, অবশ্য খুকীর গায়ের যে রং, কে বিয়ে করবে? আর আপনারও তো এমন কোনো রাজত্ব নেই জামাইকে অর্ধেক রাজত্বের জায়গিরদার বানিয়ে রাখবেন। ঘরে একটা বাড়তি রুমও নেই যে ঘরজামাই করবেন।
বাবা বলেন, সবুর করো, টিয়া। যার পাঁজরের হাড় দিয়ে আমার খুকী তৈরি হয়েছে, তাকে তো আসতে হবে। আদমের হাড়ে হাওয়া। আমার হাড়ে টিয়া।
আপনার পাঁজরে কয়টা হাড়? আমার বোন ময়নাকে দিলেন, আমি পেলাম। আমাকেও জিনের আছরের কথা বলে পাগল বানিয়ে বাড়িছাড়া করবেন? আধা হাত লম্বা ঝামা লোহার গজাল গনগনে আগুনে লাল করে আপনার চোখের মণি বরাবর ঢুকিয়ে দেব।
আমার মায়ের নাম ময়না, তার গায়ের রং ছিল কালো। তিনি আমার বাবা শহিদুল্লাহ মিয়ার প্রথম স্ত্রী। আমি মায়ের গায়ের রংটা পেয়েছি। আমার বয়স দুই ছোঁয়ার আগেই আমার মায়ের ওপর জিনের আছর হয়। মাথার কাপড় ফেলে গলা ছেড়ে গান ধরে। মাথায় আউলা লেগে যায়, স্বামীর গালে চড় মারে, ইমাম সাহেবের পড়া-পানি ফেলে দেয়, ব্লাউজ খুলে শাড়ি ছেড়ে দেয়। হুজুরের পরামর্শে জং ধরা শিকলে মাকে বেঁধে রাখা হয়। শিকল নিয়েও মা গান ধরে: ‘নিসাধামাপানিসারেগা/গারে পাখি গা/সোনার খাঁচা দেব, সোনার শেকল দেব সোনায় ভরিয়ে দেব গা।’
মাথাটা যখন আরও আউলে যায়, অমাবস্যার রাতে সবার অলক্ষ্যে আমার মা শিকলসহ ঘর ছাড়ে। অনেক খোঁজখবর করা হয়েছে, ভালোমন্দ কোনো সংবাদই আসেনি।
কালো মেয়ে গছিয়ে দিয়ে শহিদুল্লাহকে ঠকানো হয়েছে, এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ফরসা মেয়ে টিয়াকে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই টিয়াও তিন ছেলে এক মেয়ের মা।
স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি একবার গেয়েছিলাম লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া একটি গান: ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে/আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে/ব্যথার বাদলে যায় ছেয়ে...।’
হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন লুবনা ম্যাডাম। গান শেষ হতেই যখন ওয়ান মোর ওয়ান মোর রব উঠেছিল, তখন গেয়েছিলাম রেডিওতে শোনা গান: ‘আকাশের ওই মিটিমিটি তারার সাথে কইব কথা/নাই বা তুমি এলে...।’
পরিমল স্যারও নিশ্চয়ই আমার গান শুনেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাড়িতে হারমোনিয়াম আছে? বাজাতে পারো?
আমার দুটো জবাবই না।
পরদিনই এক কাঁধে উঠিয়ে হারমোনিয়ামটা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন।

-----২.-----
গ্রামের বাড়ি থেকে বাবা খালি হাতে ফিরে এসেছেন। জমি বেচতে পারেননি, মানুষের হাতে তেমন পয়সাকড়ি নেই। তিনি নিজেও চাকরিতে নেই তিন মাস ধরে। সাসপেন্ডেড। তাঁকেও অপেক্ষা করতে হচ্ছে কবে শেখ সাহেব টেক-ওভার করবেন, তার আগে ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বাড়িওয়ালার স্ত্রী শাসিয়ে গেলেন বাবাকে, বেশ্যা মেয়েটাকে আমার মহসিনের পেছন লেলিয়ে দিয়েছেন নাকি?
বাড়িভাড়া বকেয়া না থাকলে আমিই কথা শুনিয়ে দিতাম। মহসিন তো মেট্রিকই পাস করেনি। অশিক্ষিত গুন্ডা। তেজগাঁও থানায় তার বিরুদ্ধে চুরি-রাহাজানির মামলাও আছে। তার চেহারাও যেমন, বাম চোখটা ট্যারা, গালে চাপাতির কোপের দাগ।
একদিন বাইরে থেকে জানালার পর্দা উঠিয়ে মহসিন বলল, গলা তো ভালোই। কুসুম গরম পানিতে খাঁটি মধু মিশাইয়া খাইবা।
আমি থ হয়ে গুন্ডাটার দিকে তাকিয়ে থাকি। এত কিছু জানে!
গুন্ডা বলে, কেউ কিছু কইলে আমারে জানাইবা, তার মায়রে বাপ, মাছ মার্কা চাক্কু দিয়া পেট ফাসাইয়া দিমু।
পরদিন জানালার পর্দা সরিয়ে আধসেরি বোতলের এক বোতল মধু টেবিলের ওপর রেখে বলে, খাঁটি মধু, সর্ষে ফুলের।
একদিন গুন্ডাটা নাজনীন স্কুলের সামনে আমাকে আটকে হাতে একটা ছোট খাম ধরিয়ে দিলে কাঁপতে থাকে আমার হাত-পা। আমি জানি ভেতরে নোংরা চিঠি আছে, ও তো আজেবাজে কথা বলে, মেয়েদের শরীরের গোপন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবিও এঁকেছে নিশ্চয়ই। ছেলেরা বদমাশই হয়।
সম্বোধনহীন একটা চিঠি:
মাকে ঠান্ডা করতে ২০০ টাকা দিলাম। তিন মাসের ১৮০ টাকা দিয়ো। ২০ টাকা তোমার। তোমার মা-বাবাকে বলবে, পরিমল স্যার দিয়েছেন। এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে তিন চামচ মধু, প্রতিদিন খাবে।
আমি বাবার হাতে পুরো ২০০-ই দিই, পরিমল স্যার দিয়েছেন। আত্মসম্মানে লাগলেও বাড়িওয়ালার স্ত্রীর চেহারা মনে করে টাকাটা হাতে নিয়ে বাবা বললেন, পরিমলবাবুকে বলিস মাস দুয়েক পর দিয়ে দেব।
পঁচিশের রাতে অবিরাম গোলাগুলি ও গনগনে আগুনে ঢাকা শহরের চেহারা বদলে গেল। মানুষ পালাচ্ছে। যুবকেরা গুলিবিদ্ধ হচ্ছে, তরুণী শিকার হচ্ছে ধর্ষণের।
মার্চের ২৭ তারিখে যখন কারফিউ শিথিল হলো, বাবা সবাইকে গ্রামে রেখে আসতে চাইলেন। আমি গো ধরি, যাব না।
আমি বলি, আমার মতো এমন কালো মেয়েকে কেউ ছুঁয়েও দেখবে না, পাকিস্তানি আর্মিও না।
আমার গোঁয়ার্তুমির কাছে বাবা পরাস্ত হলেন। গ্রামে তাঁর একটা ভিটে ছাড়া আর কিছুই নেই, জমিজমাও না। বেঁচে থাকতে হলে তো কিছুই কামাই লাগবে, গ্রামে কে খাওয়াবে?
গুন্ডাটা বাবাকে শোনায় আশার বাণী: কার কত বড় বুকের পাটা, মহসিনের বাড়িতে এসে মেয়েমানুষের গায়ে হাত দেয়! হাত কাইটা পেটের ভেতর ঢুকাইয়া দিমু।
২৮ মার্চ মতিঝিলের আল্লাওয়ালা বিল্ডিংয়ে ভীরু পায়ে নিজের অফিসে ঢুকে বাবা শোনেন অবাঙালি বস গতকালই তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন, বকেয়া বেতন দেওয়ার আদেশ হয়েছে।
থমথমে ঢাকা শহরে খালি পায়ে হাঁটা পরিমলবাবুকে সামনে পেয়ে বাবা বললেন, মে মাসে আপনার টাকাটা শোধ করে দেব।
বিদঘুটে শব্দ করে তিনি বললেন, কিসের টাকা?
কথা না বাড়িয়ে বাবা বাড়ি ফিরে এলেন।

-----৩.-----
জানালার পর্দা তুলে ট্যারা মহসিন একবার বলল, সময় খারাপ। সময় ভালো হইলে এই গানটা গাইবা, বুঝলা—এই গানটা আমার। একটা চিরকুট ছুড়ে দিয়ে গুন্ডাটা চলে যায়।
আমি ভাঁজ খুলে একটি পুরো গানই পাই। গানের মুখটা এমন: ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও/বলো কি বা তাতে যায় আসে/প্রিয়ার কি রূপ সেই জানে/ওগো যে কখনো ভালোবাসে।’
আমার শরীরের সব প্রাণশক্তি শুষে নেয় ওই ট্যারা মহসিন গুন্ডা। আমি ‘না’ বলতে পারি না, মাথা তুলে পারি না দাঁড়াতে, তার ইশারার দাসানুদাস হয়ে পড়ি।
শেষ পর্যন্ত গুন্ডাটার সঙ্গে আমি এক রিকশায়। সোজা লালবাগ—কাজি অফিস।
কাজি সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কত টাকার কাবিন সাব্যস্ত?
বিড়বিড় করে বললাম, আমি কাবিনের টাকা চাই না।
আহাম্মক আওরাত! অন্তত ১০ হাজার টাকা তো বলবে।
মহসিন বলল, কিসের ১০ হাজার? লিখখ্যা দেন এক লক্ষ এক টাকা।
এর নামই না মর্দ, আলহামদুলিল্লাহ।
ফেরার পথে হুড ওঠানো রিকশায় আমার হাত ধরে রাখে গুন্ডাটা। বাসা থেকে খানিকটা দূরে যখন রিকশা থেকে নামি, আমার হাতে একমুঠো টাকা গুঁজে দেয় মহসিন। মিষ্টি করে শুদ্ধ ভাষায় বলে, এখন থেকে তোমার ভরণপোষণের সব দায়িত্ব আমার।
কায়েদে আজমের ছবিওয়ালা বড় নোট। এক দুই তিন...আঠারো। এত টাকা!
হাবিব ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট করে ফেল।
টাকা লাগবে না। দরকার হলে আমি চেয়েই নেব।
আবারও মহসিনের গলা, দেশের অবস্থা তো দেখছই, কে কোথায় ছিটকে পড়বে কেউ জানে না। তোমার অ্যাকাউন্টে আমিও কিছু টাকা রাখব। সামনে খরচ বাড়বে না—বাচ্চাকাচ্চার পেছনে অনেক খরচ।
আমি মুচকি হাসি, স্ত্রীর হাত ধরে রিকশায় কিছুক্ষণ বসে থাকলেই কারও স্ত্রী প্রেগন্যান্ট হয় নাকি। আমি গার্হস্থ্যবিজ্ঞানও পড়েছি, অনেক কিছুই আমি জানি। গুন্ডাপান্ডারা কি মেয়েদের কিডন্যাপ করে শুধু হাত ধরে বসে থাকে নাকি?
আমি জিজ্ঞেস করি, টাকা পেলেন কোথায়?
পরিমল স্যার দিয়েছেন।
ধ্যাত! আমি খুকী, তবে কচি খুকী নই।
ট্যারা মহসিন সেদিন লালবাগ কাজি অফিসে যাওয়ার পথে আমার হাতে একটা ভারী আংটিও দিয়েছিল। বলেছে, পরার দরকার নেই, কোথাও লুকিয়ে রেখো। আরও অলংকার আছে, পরে পাবে।

-----৪.-----
তেজগাঁও থানার পুলিশ মধ্যরাতে বাড়িওয়ালার বাসাটা ঘিরে ফেলল। কাজ হলো না, সে রাতে মহসিন বাড়িতেই ফেরেনি। শুনলাম অবাঙালি মালিকের প্লাটিনাম জুয়েলার্স লুট হয়েছে। সেই লুটতরাজে মহসিনও ছিল।
আংটিটা তাহলে প্লাটিনাম জুয়েলার্স থেকে লুট করা।
মহসিনকে পায়নি পুলিশ, তন্ন তন্ন করে খুঁজে পায়নি একরত্তি স্বর্ণালংকারও। পরে বাড়িওয়ালাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করেছে।
নিরুদ্দিষ্ট মহসিন গুন্ডার একটি চিঠি, লেখা হয়েছে ১৯৭১-এর ১১ মে। আর আমার হাতে চিঠিটি এসে পৌঁছেছে ২২ জুন, ১৯৭১। ডাকেই এসেছে।
আজ বর্ডার পার হচ্ছি। মুক্তিতে যোগ দেব। পুলিশের বাচ্চারা বাড়িতে এক তোলা অলংকারও খুঁজে পাবে না। ফিরে এসে তোমাকে দেব। একটা ভুল করে ফেলেছি—আসার আগে যেভাবে হোক তোমার কাছে আমার একটা বাচ্চার বীজ রেখে আসলে পারতাম। ফিরে এসে দেখতাম বাচ্চাটা খিলখিল করে হাসছে। হাবিব ব্যাংকে তোমার অ্যাকাউন্টে আরও তেরো শ টাকা জমা রেখে এসেছি। পরের চিঠিতে ঠিকানা জানাব।
এটুকুই। ভালোবাসা জেনো, আমার চুমু রইল—এ রকম একটা কথাও নেই। কাকে লিখছে, কে লিখছে, চিঠি পড়ে বোঝার উপায় নেই। কেবল খামের ওপর জান্নাতুল ফেরদৌস খুকী। পোস্ট অফিসের সিল এমনই লেপ্টে গেছে যে বোঝার উপায় নেই কোত্থেকে পোস্ট করা।
সেদিন রাতেই রাজাবাজারে ঢোকে আর্মি। আমবাগানে একটা তাঁবুও ফেলে। পরদিন বাবা সব ব্যবস্থা করে তবেই বাসায় এসেছেন। সন্ধ্যার দিকে একটা পুরোনো উইলি জিপে চাপাচাপি করে বসি আমরা। সঙ্গে আরও একটি পরিবার। রাস্তায় মিলিটারি টহল। রাত ১০টা নাগাদ পার হই ডেমরা ফেরি, তারপর কিছুটা হেঁটে, কিছুটা রিকশায়, কিছুটা পথ নৌকায়—প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর গ্রামের বাড়িতে।
আমি আমার মহসিন গুন্ডার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। শুরু হয় আমাদের এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে ছোটাছুটি। কখনো শুনতে পাই, মিলিটারি আসছে, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, গুলি করে মেরেছে, বেইজ্জতি করেছে। রাতের বেলা রেডিওতে শুনি: ভোমা ভোমা খান সেনারা মুক্তিবাহিনীর গাব্বুর মাইরে যেখানে-সেখানে প্যান্ট নষ্ট করে ফেলাইতাছে।
মহসিন গুন্ডা কী লিখেছিল? চিঠিটা আমি আনতে ভুল করিনি। ছি ছি ছি। এ কথাটা তো চুমোর চেয়েও বেশি লজ্জার। আমার কাছে মহসিন গুন্ডা একটা বাচ্চার বীজ রেখে যেতে চেয়েছে। কেমন করে?
বারবার এই একটি পঙ্ক্তি পড়তে পড়তে আমি আবিষ্কার করি, আমার পিরিয়ড বন্ধ হয়ে গেছে, বমি ধরে রাখতে পারছি না, সবার কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছি আমি। আমার পেট ফুলে উঠছে, গুন্ডার বাচ্চা আমার পেটে হাত-পা ছুড়ছে, দ্রুত বেরিয়ে আসতে চাইছে।
সীমান্তে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ। শব্দ এতই ভয়ংকর যে মনে হয় আকাশ ভেঙে পড়ছে। আমি নিজেকে বোঝাই, বাচ্চা এত দ্রুত বেড়ে ওঠে না। সময় লাগে, অন্তত নয় মাস।
আমি মেনে নিই—আচ্ছা, ঠিক আছে। নয় মাসই।
পেটের ভেতর গুন্ডার বাচ্চা পুষতে পুষতে দেশটা স্বাধীন হয়ে গেল। আমার আর দেরি সইছে না। বাচ্চাটা এখনই হোক, নতুবা সে তো ফিরে এসে খিলখিল করে হাসতে থাকা বাচ্চার দেখা পাবে না।
আমার নিজের ভেতরের একজন ডাক্তার বলে, খুকী, এখনই না। তাহলে বেবিটা প্রিম্যাচিউর হবে।

------৫.------
ডিসেম্বরের ২১ তারিখ আমরা ঢাকা শহরে ফিরে আসি। বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসছে। আমাদের বাসা লুট হয়েছে। পরিমল স্যারের হারমোনিয়ামটা নেই। গত অক্টোবরে বাড়িওয়ালাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, নভেম্বরের তিন তারিখে তাঁর মৃতদেহ ফিরিয়ে দেওয়ার সময় বলে গেছে, তোমাদের ভাগ্য ভালো তাই ফিরিয়ে দিলাম।
২১, ২২, ২৩...৩১ ডিসেম্বর পেরিয়ে গেল। মহসিন গুন্ডার ফেরার নাম নেই। বাহাত্তরের প্রথম দিকে গুন্ডার মা আচম্বিতে আমাকে আক্রমণ করে বসলেন, চুল ধরে টেনে মেঝেতে ফেলে দিলেন, বল হারামজাদি, মহসিন কোথায়?
দুই হাতে আমার পেট চেপে ধরি। আমাকে যা ইচ্ছে করুক, আমার গুন্ডার বাচ্চাটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
হঠাৎ তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। এরপর একদিন এক মুক্তি এসে জানিয়ে গেল, কসবার যুদ্ধে মহসিন নিহত। কেল্লাপাথরে অনেককে সমাহিত করা সম্ভব হলেও মহসিনের লাশটি রয়ে যায় আর্মির দখলে। মহসিনসহ আরও দুজন নিষ্প্রাণ তরুণকে সালদা নদীতে ফেলে দেয় তারা।
সে রাতে গর্ভের সন্তানকে দেখি আমি—ওই গুন্ডাটার মতোই দেখতে, গালে লম্বা একটা দাগ, বাঁ চোখটা একটু ট্যারা। পেটের ভেতর বাচ্চার এখন কয় মাস? স্ফীত পেট নিয়ে চলতে আমার কষ্ট হয়। বাচ্চা ক্রমেই বেড়ে উঠছে। আমি চিৎকার করে কাঁদছি, আমার গর্ভের পানি ভেঙে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ডেলিভারি করাও। কেউ আমার কথা শোনে না। বছরের পর বছর একটা বাচ্চা পেটের ভেতর বয়ে বেড়াই আমি। আমার বাচ্চা আর খালাস হয় না।

-----৬.-----
কিন্তু খুকী প্রেগন্যান্ট কখন হলো?
ওই যে লালবাগ কাজি অফিসের পথে, রিকশায়।
ধ্যাত, ও তো শুধু হাত ধরে বসেছিল।
তা হোক, গুন্ডাপান্ডাদের বিশ্বাস নেই।

No comments

Powered by Blogger.