মুক্ত দেশ না হয়েও চীন কীভাবে উদ্ভাবনে এগিয়ে by জেনিফার লিন্ড
আমার লেখা অটোক্র্যাসি ২.০ বইয়ে দেখানো হয়েছে, চীনের নেতারা এই ‘রাজাসুলভ দোটানা’ কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজে নিয়েছেন। আমি এই মডেলকে বলেছি ‘স্মার্ট স্বৈরতন্ত্র’। এটি হলো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের নতুন কৌশলের সঙ্গে নির্বাচিত অর্থনৈতিক খোলামেলা ভাবের মিশ্রণ—যার অনুপ্রেরণা এসেছে প্রযুক্তিশাসিত সিঙ্গাপুর থেকে।
চীন ভারী দমন–পীড়নে না গিয়ে বিভিন্ন সূক্ষ্ম তথ্যনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি চালু করেছে। গবেষক টনি জিরুই ইয়াং বলেন, এই কৌশল মানুষকে সেন্সরশিপের সঙ্গে অভ্যস্ত করেছে। লাঠি-গুলি ব্যবহার না করে চীন ডিজিটাল নজরদারি (যেমন এআই, মুখ চেনার প্রযুক্তি ও বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ) ব্যবহার করে যাতে আগেভাগেই অসন্তোষ চিহ্নিত করা যায়।
অন্যদিকে সরকার অর্থনীতির কিছু অংশ (বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি খাত) খুলে দিয়েছে এবং উদ্ভাবন বাড়াতে বড় বিনিয়োগ করেছে। গবেষণা-উন্নয়ন ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। গত দশকে চীনে উচ্চশিক্ষার মান দ্রুত বেড়েছে এবং বিশাল প্রযুক্তিকর্মী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে।
এখন চীন অনেকটা ঊনবিংশ শতকের আমেরিকার মতো। আগে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে যেত। এখন তারা দেশে থেকেই ভালো শিক্ষা পাচ্ছে। চীন এখন বিশ্বে সর্বাধিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশল পিএইচডি তৈরি করে। ২০২৩ সালে যে ওপেন-সোর্স এআই মডেল ডিপসিক বিশ্বকে চমকে দেয়, তার অধিকাংশ প্রকৌশলী চীনেই প্রশিক্ষিত।
চীনা কোম্পানিগুলো এখন কয়েকটি উচ্চ প্রযুক্তি খাতে বিশ্বনেতা। বিশ্বের ৮০ শতাংশ সৌর প্যানেল উৎপাদন ক্ষমতা চীনের হাতে। বৈদ্যুতিক গাড়ি ও ব্যাটারিশিল্পেও তারা শীর্ষে। ২০২৩ সালে চীন জাপানকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ি রপ্তানিকারক হয়। আর ড্রোনশিল্পে ডিজিআই একাই ৭০ শতাংশ বৈশ্বিক বাজার দখলে রেখেছে।
চীন এখনো একদলীয় রাষ্ট্র, যেখানে ভিন্নমত দমন করা হয়। তবু উদ্ভাবনে তারা জাপান, জার্মানি, ফ্রান্সকে পেছনে ফেলে গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে দশম হয়েছে। যদিও ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’-এর সব লক্ষ্য পূরণ হয়নি, তবু চীন প্রযুক্তির সামনের সারিতে চলে এসেছে। তবে কিছু পর্যবেক্ষক এখনো সন্দিহান। তাঁরা মনে করেন, সি চিন পিংয়ের অধীন বাড়তি দমন–পীড়ন উদ্ভাবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ২০২০ সালে প্রযুক্তি খাতে দমন চালিয়ে অনেক সম্পদ নষ্ট হয়েছিল; কিন্তু ‘স্মার্ট স্বৈরতন্ত্র’-এর লক্ষ্য সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি নয়। তার মূল লক্ষ্য হলো শাসন টিকিয়ে রাখা। তাই কখনো কঠোরতা বাড়ে, আবার কখনো শিথিল করা হয়। সেদিক থেকে দেখলে বোঝা যাবে, ২০২৩ সালের পর চীন প্রযুক্তি খাতে কিছুটা ছাড়ও দিয়েছে।
চীনের আরও বড় কিছু চ্যালেঞ্জ আছে; যেমন বৃদ্ধ জনসংখ্যা, কম এবং ধীর উৎপাদনশীলতা, বিশাল ঋণ এবং রিয়েল এস্টেট সংকট। এগুলো সত্যিই প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দিয়েছে; তবু চীন ইতিমধ্যে প্রযুক্তি সুপারপাওয়ার হয়ে উঠেছে এবং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য বদলে দিয়েছে, যাকে অনেকেই অসম্ভব ভাবত।
তবে এসবের মানে এই নয় যে স্বৈরশাসন গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো উদ্ভাবন করতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশগুলো এখনো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বমানের কোম্পানি এবং আন্তর্জাতিক উদ্ভাবনী নেটওয়ার্ক ধরে রেখেছে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনও প্রথম তৈরি করেছিল গণতন্ত্রসমৃদ্ধ দেশগুলো। তারা এখনো চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম।
কিন্তু পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো আর চীনের উদ্ভাবনী শক্তিকে হালকাভাবে নিতে পারে না। প্রযুক্তিতে শক্তিশালী হয়ে চীন তাইওয়ানের জন্য বড় সামরিক হুমকি এবং পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের চ্যালেঞ্জ। তা ছাড়া চীনের এ সাফল্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ‘স্মার্ট স্বৈরতন্ত্র’ চালানো দেশগুলোকেও উৎসাহ দিচ্ছে। চীন অন্য একনায়কতন্ত্রকেও নজরদারি প্রযুক্তি ও দমন কৌশল দিয়ে সহায়তা করছে।
সি চিন পিং বলেছেন, ‘চীনের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতিকে কেউ থামাতে পারবে না!’ এটা সত্য হবে কি না, ভবিষ্যতে জানা যাবে; কিন্তু এক বিষয় নিশ্চিত, সেটি হলো পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো আর ধরে নিতে পারে না যে তারা এমনি এমনি এগিয়ে থাকবে।
* জেনিফার লিন্ড, ডার্টমাউথ কলেজের গভর্নমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং চ্যাটাম হাউসের সহযোগী ফেলো
- স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
![]() |
| সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীন উদ্ভাবনে বিস্ময়কর উন্নতি করেছে। ছবি: রয়টার্স |

No comments