খালেদা জিয়ার ‘জেন্টল পাওয়ার’ by ফয়সল মাহমুদ

বাংলাদেশে খুব কম ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁদের উপস্থিতি জনমতকে আলোড়িত করতে পারে। খালেদা জিয়া তাঁদের অন্যতম। ঢাকার একটি হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বিগত কয়েকদিন ধরে যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, তা এই অশীতিপর রাষ্ট্রনেত্রীকে ঘিরে জনমানসে থাকা গভীর আবেগেরই প্রকাশ।

সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষ ফুটপাত, আঙিনা এবং সামনের সড়কগুলোতে জড়ো হয়েছেন- কারও হাত প্রার্থনায় রত, কারও কণ্ঠে নীরব উচ্চারণ- এক নারীর প্রতি শ্রদ্ধা। তিনি বহু দশক ধরে এই দেশের উত্তাল রাজনৈতিক ইতিহাসের কেন্দ্রে।

রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই হোক, জনমনে যে আবেগ উথলে উঠেছে তা আরও গভীর কিছু নির্দেশ করে: বাংলাদেশের বহু মানুষের কাছে খালেদা জিয়া আজও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার জীবন্ত প্রতীক। তাঁদের ভালোবাসা স্মৃতিতে নিবদ্ধ।
অনেকে ভুলে যান যে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ার আগেও খালেদা জিয়া ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে সাধারণ জীবনযাপনকারী একজন নাগরিক। তার স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড তাঁকে এমন এক ইতিহাসের পথে ঠেলে দেয়, যে পথে যাওয়ার কোনো প্রস্তুতিই তাঁর ছিল না।
তবু পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। গ্রেপ্তার, নজরদারি, ভয়ভীতি- সবই সহ্য করেছেন। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি হয়ে ওঠেন গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের এক অপ্রত্যাশিত প্রতীক।

তিনি আন্দোলন নেতৃত্ব দেন। তাকে বারবার আটক করা হয়। নিঃসঙ্গতায় দিন কাটান। তবু স্বৈরশাসনের কাছে মাথা নত করেননি। ১৯৯০ সালে সামরিক সরকার পতনের পেছনে তাঁর সংগঠিত গণআন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৯১ সালে তাঁর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া চিহ্নিত করে সামরিক প্রভাবাধীন দীর্ঘ যুগের পর সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনরুত্থান।

তাঁর শাসনে অগ্রাধিকার পেয়েছিল সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতা। তার মধ্যে ছিল শিক্ষার জন্য খাদ্য, গ্রামীণ সেবামূলক কর্মসূচি, কর্মসংস্থান, কাঠামোগত সংস্কার। এগুলো বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে আরও উদার অর্থনীতির দিকে নিয়ে গেছে।

সমালোচকরা তাঁকে কখনও সতর্ক রাজনীতিক বলেছেন। অনুরাগীরা বলেছেন স্থির-হাতে পরিচালনাকারী। কিন্তু নিঃসন্দেহে তিনি এক গভীরভাবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নেতৃত্বের নতুন সম্ভাবনার পথ তৈরি করেন।
দক্ষিণ এশীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর স্থান অনন্য। তিনি মুসলিম বিশ্বের প্রথম দিকের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নারী নেতাদের একজন। তিনি এমন এক নেতৃত্ব শৈলী গড়ে তুলেছেন যেখানে ব্যক্তিপূজা ছিল না। তিনি রাজবংশীয় উত্তরাধিকারী নন, নন কোনও কঠোর সম্রাজ্ঞী।

যদি তাঁর আজীবন প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব শৈলীকে কেউ কেউ মনে করেন ক্ষমতা-কেন্দ্রীকরণ ও রাজনৈতিক পরিসর দখলের রাজনীতি, তবে খালেদার শৈলী সম্পূর্ণ আলাদা- নীরব, ভারসাম্যপূর্ণ, সংযত। এ কারণে অনেকে তাঁকে অকপটে ‘জেন্টল লেডি’ বলেন। এর মানে দুর্বলতা নয়, ভদ্রতা ও শালীনতা। তাঁর উত্তরাধিকার একাধারে রাজনৈতিক স্মৃতি এবং আবেগময় সম্পদ। ’৮০ ও ’৯০ দশকের গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিনগুলো স্মরণ করলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মানুষের মনে ভেসে ওঠে। এক সময় যখন বাংলাদেশ দীর্ঘ শ্বাস নিতে পেরেছিল, তখন গণতন্ত্র শুধু আকাঙ্ক্ষা ছিল না, বাস্তব অনুভূতি ছিল। তিনি এমন এক সময় দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে সময়ে তার নেতৃত্ব আজকের তুলনায় অনেক বেশি উন্মুক্ত, বহুমাত্রিক এবং সহনশীল ছিল বলে অনেকের মনে গেঁথে আছে, যদিও তা ছিল অসম্পূর্ণ।

এ কারণেই হাসপাতালে তাঁর শয্যার পাশে মানুষের ভিড় শুধু একজন অসুস্থ রাজনৈতিক নেত্রীকে নিয়ে উদ্বেগ নয়- এটি প্রতিফলন করছে এক বৃহত্তর আকাঙ্ক্ষার: প্রতিহিংসাহীন, কম দমনমূলক, কম অসহিষ্ণু এক রাজনীতির প্রতি আকুলতা।

খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে ঘিরে মানুষের প্রতিক্রিয়া একটি নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি- তাঁর অবদান স্মরণ করা এবং হয়তো সেই শালীন রাজনীতির জন্য গভীর আকুলতা।
অনেকে যারা তাঁকে ভোট দেননি, তাঁরা পর্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলেন। যাঁরা একসময় বিরোধিতা করেছেন, তাঁরাও আজ আরোগ্য কামনা করেন। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেটি বহু সময় আড়াল করে রাখে- এই পরিস্থিতি তা আবারও প্রকাশ করেছে: নেতারা কখনও কখনও জাতির সমষ্টিগত স্মৃতির ধারক হয়ে ওঠেন- এমনকি তাঁদের বিরোধীদের কাছেও।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো এই যে, সমর্থনের এসব প্রকাশে বিষাক্ততা নেই। বাংলাদেশ বহু বছর ধরে গভীর রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যে বাস করছে- হাসিনা-খালেদা দ্বন্দ্বে দুই শিবিরে দেশ বিভক্ত হয়ে থেকেছে।

কিন্তু তাঁর অসুস্থতা সেই কঠোর বিভাজনকে সাময়িকভাবে নরম করেছে। মনে করিয়ে দিয়েছে- প্রসিকিউটরের মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার বা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বারা অবমানিত হওয়ার অনেক আগেই তিনি এমন এক নারী- যিনি ব্যক্তিগত ক্ষতি, রাজনৈতিক ঝড়-তুফান, জনসমালোচনা- সব সহ্য করেছেন শান্তভাবে।

তাঁর মানবিকতাই তাঁর রাজনৈতিক ছাপকে বিশেষ করে তুলেছে। তিনি কখনও কঠোর স্বৈরশাসক ছিলেন না। ছিলেন না জ্বালাময়ী বক্তা। মঞ্চকে তিনি নাট্যমঞ্চে পরিণত করেননি। তিনি শাসন করেছেন এক মাতৃসুলভ শান্ত মর্যাদায়- যা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে সাড়া জাগিয়েছে।

হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষমাণ মানুষ মতাদর্শ নিয়ে কথা বলেন না। তাঁরা কথা বলেন মর্যাদা নিয়ে। শিষ্টাচার নিয়ে কথা বলেন। তাঁরা তাঁকে মনে করেন এমন একজন, যিনি রাজনীতির অমানবিক পরিমণ্ডলেও মানবিকতার প্রতীক হয়ে আছেন।

তিনি এই সংকট থেকে বেঁচে ফিরুন বা না ফিরুন, তাঁর প্রভাব নিঃশেষ হবে না। বাংলাদেশ তাঁকে শুধু একজন রাজনৈতিক কৌশলী হিসেবে মনে রাখবে না- মনে রাখবে নাগরিক আকাঙ্ক্ষার ধারক হিসেবে- যাঁর নেতৃত্ব ছিল বিনয়ে আবৃত।
অনেকের কাছে তাঁর উপস্থিতি এক ভিন্ন নেতৃত্বধারণার প্রতীক- যেটি কম প্রতিশোধপরায়ণ, কম হিসাবি। তাই আজও, দুর্বল শরীর নিয়েও তিনি মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনে।

সম্ভবত এটাই এক রাজনৈতিক জীবনের শেষ মূল্যায়ন- কত পদ পেয়েছেন তা নয়, কতদিন ক্ষমতায় থেকেছেন তাও নয়, বরং তিনি জাতির স্মৃতিতে কত গভীর আবেগ রেখে আছেন সেটাই তার মূল্যায়ন।

* ফয়সল মাহমুদ, নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার। অনলাইন এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ

mzamin

No comments

Powered by Blogger.