৫০ বছরে ‘ওয়ার অন ড্রাগস’ থেকে কী পেলো যুক্তরাষ্ট্র?

আল জাজিরার বিশ্লেষণঃ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় আগে, ১৯৭১ সালের গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন মাদককে জনগণের প্রধান শত্রু ঘোষণা করে অভিযান শুরু করেছিলেন। যা পরবর্তীতে ‘ওয়ার অন ড্রাগস’ নামে পরিচিতি পায়। তার লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে মাদকমুক্ত করা, পাচারচক্র ধ্বংস করা এবং দেশকে নিরাপদ করে তোলা। কিন্তু পাঁচ দশক পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতা হয়েছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

যুক্তরাষ্ট্রে এই অভিযান কঠোর পুলিশি ব্যবস্থা ও শাস্তিমূলক আইনকে শক্তিশালী করেছে। ফলে দেশটি আজ বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ কারাবন্দী হারের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের হিসাবে, মাদকবিরোধী যুদ্ধে ব্যয় হয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। কিন্তু মাদকের চাহিদা বা প্রাপ্যতার ওপর এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েনি। বরং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ওভারডোজ সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে ফেন্টানিলের মতো সিন্থেটিক ড্রাগ প্রতি বছর এক লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ নিচ্ছে।
১৯৬০ এর দশকের শেষ দিকে ভিয়েতনাম ফেরত সৈন্যদের মধ্যে হেরোইন ব্যবহারের বৃদ্ধি, তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণ এবং সুউচ্চ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সময় নিক্সন কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন। পরবর্তীতে তার সহকারী জন আর্লিচম্যান স্বীকার করেন, প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে কৃষ্ণাঙ্গ ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকারীদের টার্গেট করতে মাদককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

নিক্সনের পর রোনাল্ড রিগানের আমলে এই যুদ্ধ আরও তীব্র হয়। ১৯৮০-এর দশকে কঠোর সাজা, বিশেষ করে ‘ক্র্যাক’ বনাম পাউডার কোকেনের সাজার বৈষম্য, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কারাবন্দীর হার কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিল ক্লিনটনের ১৯৯৪ সালের অপরাধবিরোধী আইন পরিস্থিতিকে আরও কঠোর করে, থ্রি-স্ট্রাইক নীতি জীবনব্যাপী কারাবাসকে সহজ করে তোলে। ২০১০-এর সময় পর্যন্ত এই নীতি মূলত অপরিবর্তিত থাকে। পরে কানাবিস বৈধকরণ ও ওপিওয়েড সংকট দেখিয়ে দেয় যে কঠোর শাস্তি আসক্তি কমাতে পারে না।

বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন অভ্যন্তরীণ নীতিতে আগের পথেই হাঁটছে, তবে লাতিন আমেরিকার প্রতি আগ্রাসী অবস্থান আরও দৃশ্যমান। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছে ডজনখানেক নৌকায় বোমা মেরেছে। নার্কো-ট্রাফিকিং (মাদক পাচার) বন্ধ করার নামে এসব হামলা চালিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও এসব নৌকা মাদক বহন করছিল এমন কোনো প্রকাশ্য প্রমাণ ওয়াশিংটন উপস্থাপন করতে পারেনি। সমালোচকরা বলছেন, এটি মূলত ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে সরানোর রাজনৈতিক অজুহাত।
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০০০-এর দশক পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ১.৬ মিলিয়ন পর্যন্ত মাদকসংক্রান্ত গ্রেপ্তার হতো। এর বেশিরভাগই অল্প পরিমাণ মাদক বহনের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের কারাবন্দী সংখ্যা ১৯৭০-এর দশকে ৩ লাখ থেকে চার দশকে বেড়ে ২০ লাখেরও বেশি হয়। এই পদক্ষেপের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর। মার্কিন জনগোষ্ঠীর ১৫ শতাংশের কম হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণাঙ্গদের এক-চতুর্থাংশের বেশি মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় ৩.৭ গুণ বেশি হারে ক্যানাবিস-বহন সম্পর্কিত গ্রেপ্তারের শিকার হন।

রিগানের কঠোর সাজা আইন পাস হওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের হার বেড়েছিল, যা ১৯৯১ পর্যন্ত বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় অব কানসাসের ইতিহাসবিদ ডেভিড ফারবার বলেন, ওয়ার অন ড্রাগস আসলে আমেরিকার গরিবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল, সমাধান নয়।
মাদকবিরোধী যুদ্ধ কীভাবে লাতিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ল
মাদকবিরোধী যুদ্ধ শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও তার সীমান্তেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৯৮০-এর দশকে, ওয়াশিংটন মাদক পাচারকে উৎসমুখেই দমন করার জন্য লাতিন আমেরিকা জুড়ে সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে অর্থায়ন এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।

ল্যাটিন আমেরিকা ওয়ার্কিং গ্রুপের মতে, ২০০০ সাল থেকে ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’ নামে পরিচিত কর্মসূচির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র কলম্বিয়ায় কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন বিনিয়োগ করেছিল, যার বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনী এবং কোকেইনের ক্ষেত ধ্বংস করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।  কলম্বিয়ান মানবাধিকার সংস্থা এবং দেশটির সত্য কমিশনের মতে, যদিও রাষ্ট্র কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দুর্বল করতে সফল হয়েছিল, কিন্তু কোকেইন চাষ শেষ পর্যন্ত রেকর্ড স্তরে ফিরে এসেছিল এবং সাধারণ নাগরিকদেরকে এর চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। এই সংঘাতের ফলে ১৯৮৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আনুমানিক ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল।

মেক্সিকোতে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র মাদক নির্মুল অভিযান চালায়। ফলে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক হাঙ্গামা হয়। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস অনুসারে, তখন থেকে ৪ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং আরও হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। স্থানীয় ছোট ছোট দলগুলো চাঁদাবাজি, জ্বালানি চুরি এবং মানব পাচারের মতো কাজে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে পুলিশ বাহিনী এবং স্থানীয় সরকারগুলোর মধ্যে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে।

জাতিসংঘ মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) মতে, এই অভিযানগুলো মাদক পাচারের পথ অন্য দিকে সরিয়ে দেয়। যার প্রধান পথ হয়ে ওঠে মধ্য আমেরিকার দেশগুলো।
এখনও যুক্তরাষ্ট্র কথিত পাচারকারীদের লক্ষ্য করে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্যারিবিয়ান সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে কথিত মাদক পাচারের জাহাজে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত ২১টি সামরিক হামলায় ৮৩ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

(সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত)

mzamin

No comments

Powered by Blogger.