নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র কে এই জোহরান মামদানি

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরের নতুন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জোহরান মামদানি। তিনি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন। মামদানির জয়ে নিউইয়র্ক প্রথমবারের মতো একজন মুসলিম মেয়র পাচ্ছে।

এবারের ভোটে মামদানির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কুমো। মামদানির কাছে কুমোর এটাই প্রথম হার নয়। এর আগে গত জুনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে অভিজ্ঞ এই রাজনীতিককে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন জিতেছিলেন মামদানি।

মামদানির জয়কে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীল শাখার জন্য একটি সাফল্য হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এমন এক সময়ে এই জয় এল, যখন জাতীয় পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

ট্রাম্প নিজেও নিউইয়র্ক থেকে এসেছেন। তিনি সরাসরি মামদানির বিপক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি মামদানিকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, যদি মামদানি জেতেন, তবে তিনি নিউইয়র্ক নগরের নিয়ন্ত্রণ নেবেন।

গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ছয়টায় নিউইয়র্ক নগরের মেয়র নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়, শেষ হয় স্থানীয় সময় রাত ৯টায় (বাংলাদেশ সময় বুধবার সকাল ৮টা)। এর পরপরই শুরু হয় ভোট গণনা।

নিউইয়র্ক নগরের বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য লড়াইয়ে নেমেছিলেন। তবে সেপ্টেম্বরে নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান তিনি, পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী কুমোকে সমর্থন জানান। এই প্রতিযোগিতায় রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ছিলেন কার্টিস স্লিওয়া।

জোহরান মামদানি কে

জোহরান মামদানি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের আইনসভার তিনবারের নির্বাচিত সদস্য। একাধিক প্রতিযোগীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি মেয়র নির্বাচনের দৌড়ে আসেন। শুরুতে তিনি তেমন একটা গুরুত্ব পাননি। বরং শুরুতে ধারণা করা হচ্ছিল যে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী নির্বাচনে অ্যান্ড্রু কুমো সহজ জয় পেতে চলেছেন।

জোহরান মামদানির জন্ম উগান্ডায়। শিশু মামদানি বড় হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে। সাত বছর বয়সে মা–বাবার হাত ধরে তিনি নিউইয়র্কে চলে আসেন।

জোহরানের বাবার নাম মাহমুদ মামদানি। তিনি ভারতে জন্ম নেওয়া উগান্ডার শিক্ষাবিদ। তিনি নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁর মায়ের নাম মিরা নায়ার। তিনি বিখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা।

নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের আইনসভার সদস্য হওয়ার আগে জোহরান একজন কাউন্সিলর ছিলেন। এ ছাড়া তিনি একজন ‘র‍্যাপার’ও।

রাজনীতিতে মামদানির উত্থান

মাত্র এক বছর আগে নিউইয়র্কের মেয়র পদে প্রার্থী হতে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন চেয়ে আলোচনায় আসেন ৩৪ বছর বয়সী জোহরান মামদানি। যদিও শুরুতে তাঁকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলীয় প্রাইমারিগুলোয় কুমোর বিরুদ্ধে তাঁর জয় তাঁকে নিয়ে দেশে ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়।

আজ জোহরান নিউইয়র্কের নির্বাচিত মেয়র। রাজনীতিতে তাঁর গত এক বছরের পথচলাকে এককথায় দুর্দান্ত উত্থান বলা যায়। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর নিউইয়র্ককে শ্রমজীবী মানুষের জন্য আরও সাশ্রয়ী করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে গেছেন জোহরান মামদানি।

রাজনীতিতে আসার আগে জোহরান মামদানি র‍্যাপার ছিলেন। তিনি ‘মিস্টার কার্ডামম’ নামে র‍্যাপ গাইতেন।

জোহরানের প্রচার দলের সহকারী অ্যান্ড্রু এপস্টেইন বলেন, তাঁর র‍্যাপ ক্যারিয়ার নির্বাচনী প্রচারে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে।

তবে মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির পক্ষে প্রচারে সবচেয়ে ভালো কাজ করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা তাঁর একের পর এক ভিডিও। ওই সব ভিডিওতে তিনি নানা শ্রেণির ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে সেই সব ভোটারও ছিলেন, যাঁরা ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন।

জোহরান মামদানির ডিজিটাল প্রচারণা ছিল যুগান্তকারী। ইংরেজির পাশাপাশি তিনি উর্দু, বাংলা, স্প্যানিশ ও আরবি ভাষায় ভোটারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছেন, স্লোগান দিয়েছেন, নানা প্রচারণামূলক ভিডিও প্রকাশ করেছেন।

জোহরানের পরিচয়, তিনি একজন অভিবাসী এবং দক্ষিণ এশীয়। তিনি তাঁর নির্বাচনী প্রচারে এই দুই পরিচয়কেই কাজে লাগিয়েছেন।

অবশ্য সিটি হলের জন্য প্রার্থিতা ঘোষণার অনেক আগে থেকেই তিনি এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন।

জোহরান প্রথম ২০২১ সালে দেশজুড়ে খবরের শিরোনাম হন। সেবার তিনি অতিরিক্ত ঋণের বোঝা থেকে মুক্তির দাবিতে নিউইয়র্ক নগরের ট্যাক্সিচালকদের ১৫ দিনের অনশনে যোগ দিয়েছিলেন।

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিচালকদের সঙ্গে মামদানির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। ট্যাক্সিচালকদের বেশির ভাগই অভিবাসী এবং তাঁদের অনেকেই দক্ষিণ এশীয়।

প্রচারের শেষ দিনগুলোয় জোহরান মধ্যরাতে লাগোর্ডিয়া বিমানবন্দরের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে যান এবং পালা পরিবর্তনের সময় ট্যাক্সিচালকদের সঙ্গে দেখা করেন।

সেখানে জোহরান বলেন, রাতের শিফট ছাড়া, সকাল আসে না।

শেষ কয়েক দিনের নির্বাচন

নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী নিউইয়র্কের ভোটারদের ‘অলিগার্ক বা ধনী শ্রেণি বনাম গণতন্ত্রের’ মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলেছিলেন। বিশেষ করে সপ্তাহান্তে আগাম ভোট শুরু হওয়ার আগে শহরজুড়ে ছুটে বেড়িয়েছেন জোহরান, সর্বত্র তাঁর উপস্থিতি দেখা গেছে।

জোহরান সকালে গির্জায় গেছেন, দুপুরে রেডিও শোতে। মূল শহরের বাইরের এলাকাগুলোর সুপারমার্কেটে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন, ইনফ্লুয়েন্সারদের লাইভ স্ট্রিমে হাজির হয়েছেন, ইউনিয়ন স্কয়ারে ফ্রিস্টাইল র‍্যাপ ব্যাটলে অংশ নিয়েছেন এবং নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিন শনিবার রাতে তিনি নাইট ক্লাবে গিয়ে প্রচার চালিয়েছেন। সেই রাতে তিনি ব্রুকলিনের ছয়টি নাইট ক্লাবের সব কটিতে গেছেন।

পরদিন রোববার আগাম ভোট গ্রহণ শুরু হয়। এবার নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচনে রেকর্ড পরিমাণ আগাম ভোট পড়েছে। নগরের মোট ভোটার ৪৭ লাখ। তার মধ্যে প্রায় ৭ লাখ ৩৫ হাজার আগাম ভোট পড়েছে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো নির্বাচনে নিউইয়র্ক শহরে এটিই সবচেয়ে বেশি আগাম ভোট পড়ার ঘটনা।

ইতিহাস সৃষ্টি করা মেয়র

আগামী বছরের ১ জানুয়ারি নিউইয়র্কের মেয়র হিসেবে শপথ নেবেন জোহরান। তিনি এমন একটি শহরের দায়িত্ব নিতে চলেছেন, যেটির চরিত্র বেশ জটিল। এখানে প্রায় ৮৫ লাখ মানুষ বসবাস করেন, রয়েছে বিশাল আকারের প্রশাসন, ৩ লাখ পৌরকর্মী এবং এই শহর পরিচালনার বাজেট সাড়ে ১১ হাজার কোটি ডলারের বেশি।

জোহরান শুধু নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়রই নন, তিনি প্রথম দক্ষিণ এশীয়, যিনি এ দায়িত্ব পালন করতে চলেছেন। তিনি নিউইয়র্কের আধুনিক ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ মেয়র হতে চলেছেন।

জোহরানের স্ত্রী একজন সিরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন শিল্পী, নাম রমা দুওয়াজি। কয়েক দিন আগেই তাঁরা বিয়ে করেন। তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় উগান্ডায়।

রমা দুওয়াজির জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে। পরে লেখাপড়ার জন্য তিনি নিউইয়র্ক শহরে চলে আসেন। রমার বয়স ২৮ বছর। তিনি জেন-জি প্রজন্মের প্রথম নারী, যিনি নিউইয়র্কের ফার্স্ট লেডি হতে চলেছেন।

সাধারণত স্বামীর নির্বাচনী প্রচারণার সময় স্ত্রীকে আশপাশে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু রমাকে সেভাবে দেখা যায়নি। তিনি মামদানির প্রশাসনে কোনো ভূমিকা পালন করবেন কি না, সেটাও এখনো স্পষ্ট নয়।

তৃণমূল পর্যায়ে তরুণ ভোটারদের কাছে গিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন জোহরান মামদানি। এই ছবিটি অক্টোবরে তোলা
তৃণমূল পর্যায়ে তরুণ ভোটারদের কাছে গিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন জোহরান মামদানি। এই ছবিটি অক্টোবরে তোলা। ছবি: রয়টার্স

নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে সর্বশেষ হিসাবে কোন প্রার্থী কত ভোট পেলেন

নিউইয়র্ক শহরের গতকাল মঙ্গলবারের মেয়র নির্বাচনে প্রায় ২০ লাখ ভোটার ভোট দিয়েছেন, যা ৫৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে স্থানীয় সময় আজ বুধবার সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত প্রায় ৯১ শতাংশ ভোট গণনা শেষ হয়েছে।

এর মধ্যে সর্বশেষ হিসাবে ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি। তাঁর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ১০ লাখ ৩৬ হাজার ৫১।

জোহরান মামদানির নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমো পেয়েছেন ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট। তাঁর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৮ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯৫। ৭ দশমিক ১ শতাংশ ভোট নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া। তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ১৩৭ ভোট।

নিউইয়র্কের ১১১তম মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মামদানি কয়েকটি রেকর্ড গড়েছেন। তিনিই নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র। ১০০ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে নিউইয়র্কের সবচেয়ে কম বয়সী মেয়রও তিনি। তাঁর বয়স ৩৪ বছর।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের খরা চলছিল। বলা যায়, জোহরান তা ঘুচিয়ে দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালের পর নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে এবারই প্রথমবারের মতো প্রায় ২০ লাখ ভোট সংগ্রহের রেকর্ড হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম পলিটিকো জানায়, দ্য নিউইয়র্ক সিটি বোর্ড অব ইলেকশনসের তথ্যমতে, মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় ৬টা পর্যন্ত ১৭ লাখ ৪৮ হাজার ৬৯৮টি ভোট রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল স্থানীয় সময় রাত ৯টা পর্যন্ত ভোট দেওয়ার সুযোগ ছিল। এ ছাড়া এবার ডাকযোগে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার মানুষ ভোট দিয়েছেন।

নিউইয়র্কের ১৯৬৯ সালে মেয়র নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন প্রায় ২৪ লাখ ৬০ হাজার ভোটার। তখন জন লিন্ডসে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে তাঁর প্রথম মেয়াদে ভোট পড়েছিল আরও বেশি, প্রায় ২৬ লাখ ৫০ হাজার।

লক্ষণীয় বিষয়, এবার মোট যত ভোট পড়েছে, তার অর্ধেকের বেশি পেয়েছেন জোহরান। এ ছাড়া এবার নিউইয়র্কের চার বছর আগের মেয়র নির্বাচনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেশি ভোটার ভোট দিয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক জনবহুল শহরটিতে গত মেয়র নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ১১ লাখের মতো।

No comments

Powered by Blogger.