কেন কঠোর শক্তিনির্ভর রাজনীতি তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিকে চালিত করছে by ড. সাইনেম জেংগিজ
আঙ্কারার এই সামরিকভাবে দৃঢ় অবস্থানের প্রয়োজন সীমান্তের বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত, যা মূলত জাতীয় নিরাপত্তার তাৎক্ষণিক হুমকি ও প্রতিবেশী অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার ধারণা থেকে উদ্ভূত। এই কৌশলের অন্যতম মূল দিক হলো তুর্কি সেনাদের বিদেশে মোতায়েন- জাতিসংঘ ও ন্যাটোর প্রচলিত মিশনের বাইরে আরও বিস্তৃতভাবে।
এ সপ্তাহে তুর্কি সংসদ প্রতিবেশী ইরাক ও সিরিয়ায় সামরিক অভিযানের ম্যান্ডেট আরও তিন বছরের জন্য এবং লেবাননে জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণ আরও দুই বছরের জন্য নবায়ন করেছে। ২০১৪ সাল থেকে সংসদ প্রতিবছর সীমান্ত-পার অভিযানগুলোর অনুমোদন নবায়ন করে আসছে। তবে সিরিয়ার ক্ষেত্রে এবারের অনুমোদনটি ২০১৬ সালে তুরস্কের প্রথম সীমান্তপারে সামরিক অভিযান শুরুর পর সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী।
ইরাকে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতির ইতিহাস আরও পুরোনো- ১৯৮০-এর দশক থেকেই দেশটি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) দমন অভিযান চালিয়ে আসছে, যাকে তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
সিরিয়া ও ইরাকের ম্যান্ডেট নিয়ে তুর্কি সংসদে মতভেদ দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন ন্যায় ও উন্নয়ন পার্টি (একেপি) ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পার্টি (এমএইচপি) প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়, কিন্তু রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) এবং পিপলস ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডেমোক্রেসি পার্টি (ডিইএম) এর বিরোধিতা করে। তবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণের প্রস্তাবটি তুলনামূলকভাবে সর্বসম্মত সমর্থন পায়।
দামেস্ক ও বাগদাদের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকলেও তুরস্ক এখনো আশঙ্কা করছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম থেকে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে, বিশেষ করে পিকেকে ও দায়েশ-এর কারণে। সিরিয়া সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘পিকেকে ও এর সহযোগী গোষ্ঠীগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বিভাজনমূলক কর্মসূচির কারণে সিরিয়ার কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে সংহতির কোনো পদক্ষেপ নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।’ এই ম্যান্ডেটের মেয়াদ বৃদ্ধির অর্থ হলো, সিরিয়ার নতুন সরকারকে সন্ত্রাসবিরোধী সক্ষমতা জোরদারে আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন, এবং এটি একই সঙ্গে তুরস্কের দীর্ঘমেয়াদি কঠোর শক্তি কৌশলের প্রতিফলন।
তুরস্কের এই শক্তিনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, বরং ককেশাস থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত অস্থিরতার সময়ের সঙ্গে মিল রেখে চলছে। বর্তমানে তুর্কি সেনারা অন্তত নয়টি দেশে মোতায়েন আছে। এর মধ্যে সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আজারবাইজান, কাতার ও সোমালিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ উল্লেখযোগ্য।
২০১৭ সাল থেকে আঙ্কারা তার নিজস্ব তৈরি সশস্ত্র ড্রোন বেরাকতার টিবি২ রপ্তানি শুরু করে। এই ড্রোন লিবিয়া, নাগার্নো-কারাবাখ এবং ইউক্রেনসহ বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে।
তুরস্ক এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৪টি দেশে এই টিবি২ বিক্রি করেছে- ইউরোপ, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, লেভান্ট এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের মিত্র ও অংশীদার দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশে। এই ‘ড্রোন কূটনীতি’ আঙ্কারাকে ইউরেশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এক শক্তিশালী কৌশলগত নেটওয়ার্ক দিয়েছে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার প্রধান হালুক গোরগুন জানিয়েছেন, গত বছর তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের রপ্তানি ৭.১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে- যা এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। তিনি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগানের সঙ্গে নিয়মিত বিদেশ সফরে যান; সর্বশেষ সফর ছিল উপসাগরীয় তিন দেশ- কুয়েত, কাতার ও ওমান-ভ্রমণ।
তুরস্কের এই শক্তিনির্ভর নীতি কেবল প্রতিরক্ষার উন্নয়নের জন্যই নয়, বরং ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ প্রতিষ্ঠারও প্রচেষ্টা। পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয়ে নানা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ায় তুরস্ক নিজস্ব ক্ষমতার ওপর নির্ভরতা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।
এ সপ্তাহেই বৃটেন তুরস্ককে ২০টি টাইফুন যুদ্ধবিমান সরবরাহের জন্য সর্বোচ্চ ৮ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার জানিয়েছেন, তুরস্ক ২০৩০ সালে প্রথম ব্যাচের যুদ্ধবিমানগুলো পাবে। টাইফুন বিমান বৃটেন, জার্মানি, ইতালি ও স্পেন যৌথভাবে তৈরি করে- এবং এই চুক্তির অনুমোদন দিতে হয়েছে কনসোর্টিয়ামের অন্যান্য সদস্যদেরও। এরদোগান একে ‘বৃটেনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের নতুন প্রতীক’ বলে অভিহিত করেছেন।
এই চুক্তিটি গত দুই দশকে সবচেয়ে বড় যুদ্ধবিমান রপ্তানি চুক্তি, যা স্টারমারের আঙ্কারা সফরের সময় স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে তুরস্ক আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরাইলের সঙ্গে প্রযুক্তিগত ব্যবধান কমাতে চায়। একই সঙ্গে তুরস্ক ওমান ও কাতার থেকেও আরও কিছু টাইফুন কেনার পরিকল্পনা করছে। গত সপ্তাহে জানা যায়, তুরস্ক ওমান ও কাতার থেকে ১২টি টাইফুন কেনার প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যা তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাবে- পরবর্তীতে বৃটেন থেকে নতুন ব্যাচ আসবে।
পাশ্চাত্য ও আঞ্চলিক অনেক দেশ এখন তুরস্কের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে একের পর এক প্রতিরক্ষা শিল্প সম্পর্কিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হচ্ছে। তুর্কি প্রতিরক্ষা পণ্যের আকর্ষণ বাড়ছে, কারণ এগুলো সাধারণত রাজনৈতিক শর্ত ছাড়া আসে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর নীতিগত ওঠানামার প্রভাব থেকে তুলনামূলকভাবে মুক্ত।
ফলে তুরস্কের কঠোর শক্তিনির্ভর নীতি- যার মধ্যে সামরিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত- এখন তার সমবায়ী নিরাপত্তা নীতির অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠেছে, যা পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান হাতিয়ার।
এই কৌশলের উদ্দেশ্য বহুস্তরীয়। এর মধ্যে আছে, প্রতিবেশী অঞ্চলে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, কৌশলগত অংশীদারিত্ব জোরদার, প্রতিরক্ষা সক্ষমতা আধুনিকীকরণ, বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও দায়িত্ব বৃদ্ধি এবং প্রচলিত ও অপ্রচলিত উভয় হুমকি মোকাবিলা।
আধুনিক আন্তঃসীমান্ত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের যুগে এই নীতি এখন আর কোনো বিকল্প নয়- এটি তুরস্কের জন্য এক কৌশলগত অপরিহার্যতা।
(ড. সাইনেম জেংগিজ, একজন তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি তুরস্ক-মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তার এ লেখাটি অনলাইন আরব নিউজ থেকে অনুবাদ)

No comments