যুদ্ধবিরতির পর গাজায় কমপক্ষে ১৫০০ ভবন ধ্বংস করেছে ইসরাইল
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের গাজা শান্তিচুক্তির ২০ দফা পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, সব ধরনের সামরিক অভিযান, যেমন বিমান ও কামান হামলা, স্থগিত থাকবে। ট্রাম্প পরবর্তীতে বারবার ঘোষণা দিয়েছেন যে যুদ্ধ শেষ। তবে বিবিসির স্যাটেলাইট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গাজায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর হাতে ভবন ধ্বংস এখনো ব্যাপকভাবে চলছে। বিবিসি লিখেছে, আমরা রাডার চিত্র বিশ্লেষণের জন্য একটি ‘চেঞ্জ ডিটেকশন অ্যালগরিদম’ ব্যবহার করেছি। এটা হলো যুদ্ধবিরতির আগে ও পরে তোলা ছবিগুলোর পার্থক্য নির্ণয় করার একটি পদ্ধতি। এভাবে সম্ভাব্য ধ্বংসের চিহ্ন শনাক্ত করা যায়। তারপর হাতে গুনে দৃশ্যমান ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন গণনা করা হয়। বিশ্লেষণ করা হয় ‘ইয়েলো লাইন’-এর পেছনের অঞ্চলগুলো- যা গাজার উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিক বরাবর চলে গেছে। অক্টোবরের যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী ইসরাইল তাদের বাহিনী এই রেখা পর্যন্ত প্রত্যাহারের কথা বলেছে।
অনেক ভবন, যেমন খান ইউনুসের পূর্বাঞ্চলের আবাসান আল-কবিরা এলাকায়, ধ্বংস হওয়ার আগে অক্ষত অবস্থায় ছিল। স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, ভবনগুলোর কাঠামো অক্ষত, আশেপাশে ধ্বংসাবশেষ বা ভাঙনের কোনো চিহ্ন নেই। সেখানে বাগানবাড়ি, গাছপালা, এমনকি ছোট ফলের বাগানও ছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় (অক্টোবর ২০২৩) তোলা স্যাটেলাইট ছবির সঙ্গে যুদ্ধবিরতির সময়কার ছবির তুলনা করলে দেখা যায়, অনেক ভবন ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। আবাসান আল-কবিরার বাসিন্দা লানা খলিল যুদ্ধের আগে কাছাকাছি এল-মাওয়াসিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, তার বাড়ি ছিল ‘একটি স্বর্গ’, ‘খামার ও সবজিতে ভরা’। এখন সেই এলাকা পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ইসরাইলি সেনারা আমাদের কিছুই রাখেনি। সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা এল-মাওয়াসির তাঁবু থেকেই ধ্বংসের শব্দ শুনতে পেতাম। আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে।
আরেকটি এলাকা, রাফাহ শহরের পূর্বে আল-বায়ুক অঞ্চলেও একই চিত্র দেখা গেছে। যুদ্ধবিরতির আগে অক্ষত থাকা অনেক ভবন পরে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। নভেম্বরের শুরুতে তোলা আকাশচিত্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকার ওপর ধুলো ও ধোঁয়ার মেঘ উঠতে দেখা গেছে। গাজা শহরেও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। বিশেষত পূর্বাঞ্চলের শুজাইয়া এলাকায় এবং জাবালিয়া শিবিরের প্রান্তে ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালের আশেপাশে। ইসরাইলের কৌশলগত বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় নিরাপত্তা নীতির সাবেক প্রধান ইটান শামির বলেন, আইডিএফের এসব কর্মকাণ্ড যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন নয়। কারণ ইয়েলো লাইনের পেছনের অঞ্চলগুলো যুদ্ধবিরতির আওতায় পড়ে না।
যুদ্ধবিরতির পর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ধ্বংসযজ্ঞের ভিডিও ও এক্সক্যাভেটর দিয়ে ভবন ভাঙার দৃশ্যও যাচাই করে দেখা গেছে- সবই ইয়েলো লাইনের পেছনের এলাকা। আইডিএফ তাদের কর্মকাণ্ডের পক্ষে জানিয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী গাজার সব সন্ত্রাসী অবকাঠামো, যেমন টানেল, ধ্বংস করতে হবে। ইসরাইল হুমকি, লঙ্ঘন ও সন্ত্রাসী অবকাঠামোর প্রতিক্রিয়ায় কাজ করছে। ১৮ অক্টোবর ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল ক্যাটজ এক্সে লিখেছেন, গাজাকে নিরস্ত্রীকরণ মানে সন্ত্রাসী টানেল ও অবকাঠামো ধ্বংস করা- এটাই ইসরাইলের নিরাপত্তা নীতির স্পষ্ট অংশ।
হোয়াইট হাউস থেকে প্রকাশিত ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার ১৩ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে, সব সামরিক, সন্ত্রাসী ও আক্রমণাত্মক অবকাঠামো, টানেল ও অস্ত্র উৎপাদন স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা হবে এবং পুনর্নির্মাণ করা হবে না। তবে এটাও বলা হয়েছে, এই নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানে হবে। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই)-এর সিনিয়র ফেলো ড. এইচ এ হেলিয়ার বলেন, এটি নিঃসন্দেহে যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন। কিন্তু ওয়াশিংটন এটি স্বীকার করতে রাজি নয়। তারা শুধু বলছে যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর আছে- যদিও বাস্তবে তা কার্যকর নয়। অন্যদিকে শামিরের দাবি, আইডিএফ যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করছে না। তার মতে, হামাস তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যা খুশি করছে, আর ইসরাইল তার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তাই করছে।

No comments