মৃত ভেবে ৮ ঘণ্টা হিমঘরে ফেলে রাখা মেয়েটির আঙুল নড়ছিল

গাজার রাঘাদ আল-আসারের বয়স মাত্র ১২ বছর। গত বছর তাদের বাড়িতে হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় রাঘাদের দুই বোন নিহত এবং পরিবারের বাকি সদস্যদের সবাই কমবেশি আহত হয়েছিল। রাঘাদও মারা গেছে মনে করে দুই বোনের মৃতদেহের সঙ্গে তাকে গাজার একটি মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়।

অচেতন রাঘাদকে মৃত ভেবে মর্গে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে হিমঘরে তার দেহ প্রায় আট ঘণ্টা পড়ে ছিল।

সম্প্রতি আল-জাজিরাকে নিজের সেই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে গাজার ছোট্ট মেয়েটি।

রাঘাদ আল–আসার বলে, ‘অন্যদের মতো আমরাও আমাদের বাড়িতে বসে ছিলাম। হঠাৎ গুলি, যুদ্ধবিমান, ড্রোন সব আমাদের ওপর আছড়ে পড়ে।’

রাঘাদের বেঁচে যাওয়াকে অলৌকিক বললেও কম বলা হয়। সেদিন আরেক ফিলিস্তিনি বাবা নিজের ছেলেকে খুঁজতে মর্গে এসেছিলেন। তিনি মর্গের হিমঘরে থাকা মৃতদেহগুলো একে একে দেখতে শুরু করেন। হঠাৎ দেখেন, ঠান্ডা স্ল্যাবের ওপর পড়ে থাকা এক বালিকার আঙুল একটু একটু নড়ছে।

রাঘাদ বলে, ‘আমি দুই সপ্তাহ কোমায় ছিলাম। কোমা থেকে জেগে ওঠার পর, আমার পরিবার আমাকে বলে, আমাকে মর্গের রেফ্রিজারেটরে রাখা হয়েছিল।’

গত বছরের ৮ জুনের ওই হামলায় রাঘাদের দুই বোন মারা যায়। গুরুতর আহত বড় বোনের শারীরিক অবস্থা এখন তার চেয়েও খারাপ।

রাঘাদ বলে, ‘আমার পরিবারের বাকিরা সবাই আহত হয়েছেন। দুই বোন মারা গেছে। বড় বোনের অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। সে এখন এক চোখে দেখতে পায় না, শরীর অনেকটা পুড়ে গেছে, গভীর ক্ষত রয়েছে ও পেটের পীড়াতেও আক্রান্ত।’

গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সেখানে ইসরায়েলের হামলায় এমন অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। জাতিসংঘ গাজায় জাতিহত্যা হয়েছে বলে ঘোষণা করেছে।

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলায় প্রায় ৬৪ হাজার শিশু নিহত বা পঙ্গু হয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৬৯ হাজার ১৮৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি।

‘রাঘাদ পুরোপুরি পাল্টে গেছে’

রাঘাদের বাবা মোহাম্মদ বলেন, যেদিন তাঁর বাড়িতে হামলা হয়, সেদিন তিনি কাজে ছিলেন। পরে এক স্বজন তাঁকে ফোন করে কী ঘটছে, জানায়। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে খবর এল, আমার বাড়িতে হামলা হয়েছে। আমি কাজে ছিলাম। কী ঘটেছে, জানতে আমি সোজা হাসপাতালে ছুটে যাই।’

মেয়ে রাঘাদকে হাসপাতালে খুঁজে না পেয়ে তিনি বাড়িতে যান জানিয়ে মোহাম্মদ আরও বলেন, ‘ধ্বংসস্তূপের নিচে রাঘাদ পড়ে আছে কি না, দেখতে বাড়িতে যাই। সেখানেও তার চিহ্ন খুঁজে পাইনি।’

একপর্যায়ে হাসপাতালের হিমঘর থেকে উদ্ধার হয় মেয়েটি। মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন বাবা ঠিকই। কিন্তু লক্ষ্য করেন, হামলার পর থেকে তার ছোট্ট মেয়েটি পুরোপুরি বদলে গেছে। কেন তাঁর এমনটা মনে হয়েছে সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মোহাম্মদ বলেন, ‘ওই ঘটনার পর তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা বদলে গেছে। সে অন্য মানুষ হয়ে গেছে। এখন এমনও ঘটে, হয়তো আমরা রাস্তায় হাঁটছি, সে হঠাৎ রাস্তায় অচেতন হয়ে পড়ে।’

রাঘাদ আল–জাজিরাকে বলেছে, সে এখনো দুঃস্বপ্ন দেখে এবং হামলার দিনের ঘটনা মনে করে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

ভীত কণ্ঠে শিশুটি বলে, ‘আমি সেদিনের কথা মনে করতে চাই না, আমি যুদ্ধের শব্দ শুনতে চাই না এবং ওই দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় এমন সবকিছু আমি এড়িয়ে যেতে চাই। আমি যুদ্ধবিমান ওড়া ও বোমার আওয়াজ পেলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।’

রাঘাদের পরিবারের আশা, তাকে ও তার আহত বোনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া হবে।

দুই বছরের যুদ্ধে গাজার স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েলি বর্বরতা, হামলায় শত শত চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছেন। সেখানে স্বাস্থ্য অবকাঠামো বলে আর কিছু নেই।

যদিও গত মাসে হামাস ও ইসরায়েল একটি যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হয়েছে; কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত আছে। ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়া পর ইসরায়েলের হামলায় সেখানে অন্তত ২৬০ জন নিহত হয়েছেন।

‘আমি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চাই। এটাই আমার স্বপ্ন। বিদেশে অন্যরা যেভাবে জীবন কাটায়, সেভাবে জীবন কাটানোর অধিকার প্রতিটি শিশুর আছে; তাদের মতো খেলাধুলা করার, তাদের মতো ভালো থাকার অধিকার সবার আছে’, বলেছে রাঘাদ।

আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলছে রাঘাদ আল–আসার
আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলছে রাঘাদ আল–আসার। ছবি: আল–জাজিরার ভিডিও থেকে নেওয়া

No comments

Powered by Blogger.