মামদানিকে ঠেকাতে নাগরিকত্ব বাতিলের কথা বলছেন রিপাবলিকানরা, তা কি সম্ভব
নির্বাচনের আগে থেকে মামদানিকে নিয়ে নানা কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ৩৪ বছর বয়সী এই মুসলিমকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়েছেন তিনি। তাঁর মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। এমনকি হুমকি দিয়ে এ–ও বলেছেন, মামদানি মেয়র হলে নিউইয়র্কে কেন্দ্রীয় তহবিল বন্ধ করে দেবেন।
ট্রাম্পের সুরে সুর মিলিয়ে রিপাবলিকান কয়েকজন আইনপ্রণেতা মামদানির নাগরিকত্ব গ্রহণের প্রক্রিয়া তদন্ত করে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। কয়েকজন আবার তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করার কথা বলেছেন। এই আইনপ্রণেতাদের অভিযোগ মামদানি কমিউনিস্ট এবং ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। যদিও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি তাঁরা।
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিকে মামদানির নাগরিকত্বের বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে বলেছিলেন প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান সদস্য অ্যান্ডি ওগলেস। পরে গত ২৯ অক্টোবর তিনি বলেন, ‘মামদানি যদি নাগরিকত্ব–সংক্রান্ত নথিপত্রে মিথ্যা বলে থাকেন, তাহলে তিনি নাগরিক থাকতে পারবেন না। আর অবশ্যই নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।’
মামদানিকে কমিউনিস্ট ও সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ওগলেস আরও বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়ায় সমাজতন্ত্র বা সন্ত্রাসবাদে যুক্ত থাকার কথা উল্লেখ করতে হয়। আমার সন্দেহ আছে তিনি (মামদানি) এগুলো প্রকাশ করেছিলেন কি না। আমার এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে উগান্ডায় যাওয়া প্রথম ফ্লাইটেই তাঁকে ফেরত পাঠান।’
মামদানির নাগরিকত্ব নিয়ে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন প্রতিনিধি পরিষদে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের সদস্য রেন্ডি ফাইন। ফাইন ও ওগলেস—দুজনের কাছেই তাঁদের বক্তব্যের বিষয়ে মন্তব্য চেয়েছিল মার্কিন ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট পলিটিফ্যাক্ট। তবে কোনো জবাব দেননি তাঁরা। আর মামদানি তাঁর নাগরিকত্বের আবেদনে মিথ্যা বলেছিলেন—এমন কোনো তথ্যও পায়নি ওয়েবসাইটটি।
জোহরান মামদানির জন্ম উগান্ডায়। ১৯৯৮ সালের মাত্র সাত বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। ২০১৮ সালে দেশটির নাগরিকত্ব পান। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, দেশটির নাগরিকত্ব পেতে একজন বিদেশি প্রাপ্তবয়স্ককে অবশ্যই আইন মেনে টানা পাঁচ বছর বসবাস করতে হবে। আর মার্কিন নাগরিককে বিয়ে করলে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য দেশটিতে অন্তত তিন বছর টানা বসবাস করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল শুধু দেশটির আদালত করতে পারেন। মামদানির নাগরিকত্বের আবেদন দিয়ে ওগলেস ও ফাইন যে অভিযোগ এনেছেন, তার পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখছেন না অভিবাসী আইনবিশেষজ্ঞরা। অভিবাসনবিষয়ক আইনজীবী জেরেমি ম্যাককিনলে বলেন, ‘মামদানি নাগরিক হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় অযোগ্য ছিলেন বা নথিতে কোনো কিছু লুকিয়েছেন—এমন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আমার চোখে পড়েনি।’
রিপাবলিকানদের অভিযোগ পুরোনো
গত গ্রীষ্মে মামদানি যখন ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নিউইয়র্কের মেয়র প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন থেকে তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেন রিপাবলিকানরা। গত জুনে পাম বন্ডিকে লেখা একটি চিঠিতে মামদানির নাগরিকত্ব বাতিলের জন্য বিচার বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন ওগলেস। তিনি বলেছিলেন, মামদানি হয়তো ‘নাগরিকত্ব গ্রহণের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য বিকৃত করেছিলেন বা সন্ত্রাসবাদে সমর্থনের কথা গোপন করেছিলেন।’
‘হোলি ল্যান্ড ফাইভের’ প্রতি সমর্থন জানিয়ে মামদানির লেখা একটি র্যাপ সংগীতের কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন ওগলেস। হোলি ল্যান্ড ফাইভের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে মুসলিম দাতব্য সংস্থা ‘হোলি ল্যান্ড ফাউন্ডেশনের’ পাঁচ ব্যক্তিকে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রতি সমর্থনের জন্য ২০০৮ সালে তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। যদিও ওই মামলায় উপস্থাপন করা প্রমাণ ও গুজবের ব্যবহার নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন কয়েকজন আইনজীবী।
মামদানি একজন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী। তিনি ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকা নামের একটি সংগঠনের সদস্যও। ওগলেস ও ফাইন বলেছেন, নাগরিত্বের আবেদনপত্রে মামদানি এই সদস্যপদের কথা উল্লেখ করেননি। সংগঠনটিকে কমিউনিস্ট তকমা দিয়ে তাঁরা আরও বলেন, এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল করা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণের যে আবেদনপত্র রয়েছে, তাতে জানতে চাওয়া হয় আবেদনকারী কোনো কমিউনিস্ট বা স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কি না। তবে ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকা কোনো কমিউনিস্ট দল নয়। এমন কথাই বলছেন আইনজীবী জেরেমি ম্যাককিনলে ও এমোরি ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ হারভি ক্লের।
পলিটিফ্যাক্টকে হারভি ক্লের বলেন, সমাজতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব হয়েছে। কমিউনিস্টরা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং তাঁদের বিশ্বাস হলো উৎপাদনব্যবস্থার ওপর রাষ্ট্রের মালিকানা রয়েছে। কমিউনিস্টদের এই বিশ্বাস সাধারণত প্রত্যাখ্যান করেন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা। আর ম্যাককিনলে বলেন, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকার সদস্য পদ নাগরিকত্বের জন্য কোনো বাধা নয়।
খাটানো হচ্ছে ভিন্ন কৌশল
সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মামদানির মেয়র হওয়ার পথে বাধা দিতে অন্য একটি কৌশল খাটাচ্ছে দ্য নিউইয়র্ক ইয়ং রিপাবলিকান ক্লাব নামের একটি সংগঠন। তারা উল্লেখ করছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর কথা। এতে বলা হয়েছে, দেশের ‘শত্রুদের সহায়তা–সহানুভূতি দিলে’ এবং ‘বিদ্রোহে যুক্ত’ থাকলে কেউ সরকারি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
রিপাবলিকানপন্থী ওই ক্লাবটির দাবি, ‘হামাসপন্থী’ সংগঠনগুলোকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদের প্রতি ‘সহায়তা ও সহানুভূতি’ দেখিয়েছেন মামদানি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী নিয়ন্ত্রণ ও সীমান্ত সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সংস্থা ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) সদস্যদের প্রতিহত করার কথা বলে অপরাধী চক্রগুলোকে সমর্থন জানিয়েছেন তিনি।
এই কৌশল মামদানির মেয়র হওয়া ঠেকানোর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা। মামদানি মেয়র হওয়ার যোগ্য নন, তা ঘোষণার জন্য প্রাথমিকভাবে মার্কিন কংগ্রেসের দুই কক্ষ—প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে দুই–তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে। কংগ্রেসে বিষয়টি অনুমোদন হলেও এর বিরুদ্ধে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা যাবে।
তবে অভিবাসনবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা পলিটিফ্যাক্টকে বলছেন, সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে যুদ্ধ চলাকালে শত্রুদের সহায়তা এবং বিদ্রোহের কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে বলা হয়নি। তাই মামদানি আইসিই সদস্যদের প্রতিহত করা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা চতুর্দশ সংশোধনীর বিরুদ্ধে যায় না।
যেভাবে নাগরিকত্ব বাতিল করা যায়
নাগরিকত্বের আবেদনপত্রে জালিয়াতির অভিযোগে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে অথবা দেওয়ানি মামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারেন বিচার বিভাগ। দুই মামলার ক্ষেত্রে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে আবেদনকারী নাগরিকত্বের আবেদনপত্রে মিথ্যা বলেছেন অথবা তাঁর বক্তব্য আবেদনপত্রের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক কাসান্দ্রা বার্ক রবার্টসন বলেন, মামদানির নাগরিকত্ব বাতিলের কোনো মামলা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে বড় সমস্যাটা হলো এমন মামলা করা হলে, সক্ষমতা কম—এমন অনেক মানুষই সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে ভয় পেতে পারেন।
নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে বিরল হলেও ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে তা প্রায়ই ঘটছে বলে উল্লেখ করেছেন নিউইয়র্কের হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ইরিনা মান্ত্রা। তাই শেষ পর্যন্ত যদি মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসকারী (পারমানেন্ট রেসিডেন্ট) হিসেবে থাকতে পারবেন। ফলে তিনি আর নিউইয়র্কের মেয়র হতে পারবেন না।
![]() |
| জোহরান মামদানি। ফাইল ছবি: রয়টার্স |

No comments