রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের অনুপস্থিতি কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে
লাভরভ তাঁর পদে আছেন কি না, তা নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরে জোর জল্পনা চলছে। কারণ, গত বুধবার রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠক থেকেই দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘পূর্ণমাত্রায় পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার সম্ভাবনার’ ঘোষণা দেন।
গত শুক্রবার লাভরভের অনুপস্থিতি ঘিরে চলা জল্পনাকে কিছুটা শান্ত করতে চেষ্টা করেছেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এসব প্রতিবেদনের কোনো সত্যতা নেই। লাভরভ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
কিন্তু লাভরভকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়া গুঞ্জন খবর হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য রাশিয়ার ক্ষমতার ক্রেমলিনের ভেতরের রাজনীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বোঝাটা জরুরি। বুধবার রাশিয়ার বাণিজ্য-সংক্রান্ত দৈনিক কোমার্স্যান্ট ‘বিষয়টি সম্পর্কে জানে এমন কয়েকটি সূত্রের’ বরাতে জানায়, উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক থেকে লাভরভ ‘সমঝোতার’ ভিত্তিতে অনুপস্থিত ছিলেন।
পর্যবেক্ষকেরা আরও বলেন, রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে একমাত্র লাভরভই বুধবারের বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, চলতি মাসের শেষের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠেয় জি–২০ শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বেও লাভরভ থাকছেন না। গত মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) পুতিন এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে রাশিয়ার প্রেসিডেনশিয়াল এক্সিকিউটিভ অফিসের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ম্যাক্সিম ওরেশকিনকে জি–২০ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিয়োগ দিয়েছেন।
এসব কিছুর কারণে অনেকের প্রশ্ন, পুতিনের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণেই কি লাভরভকে সরিয়ে দেওয়া হলো? এটা কি রাশিয়ার সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্ভাব্য পুনর্গঠনের ইঙ্গিত?
লাভরভের অনুপস্থিতির খবরটি আসার আগে সম্প্রতি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। কয়েক সপ্তাহ আগে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের কথা ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে তা ভেস্তে যায়।
এই বৈঠক আয়োজনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লাভরভ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে লাভরভের ফোনালাপের পর বৈঠকটি স্থগিত হয়ে যায়।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইউক্রেন বিষয়ে নিজেদের সর্বোচ্চ দাবির সঙ্গে কোনো আপস করতে রাজি হচ্ছেন না রুশরা। তাই বৈঠকটি হয়নি। বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা আসার পর রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করে ওয়াশিংটন।
কথা হচ্ছে, কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে মস্কোয় কোনো চাপা ক্ষোভ তৈরি হলেও তা তো প্রকাশ্যে আসার কথা নয়। কারণ, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন এই ধরনের অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা নিজেদের মধ্যে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।
লাভরভ এখনো দায়িত্বে আছেন কি না, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভার কাছে তা জানতে চেয়েছিল সিএনএন। বুধবারের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকার কথা নিশ্চিত করে জাখারোভা বলেন, এমনটি ‘হতেই পারে’। তবে লাভরভ এখনো পদে আছেন।
লাভরভ দুই দশকের বেশি সময় ধরে রাশিয়ার কূটনৈতিক মহলের সবচেয়ে পরিচিত মুখ। এর আগে তিনি জাতিসংঘে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের দায়িত্ব পালনকালে এখন পর্যন্ত পশ্চিমাদের সঙ্গে মস্কোর উল্লেখযোগ্য যেসব সংকট দেখা দিয়েছে, সেসবের প্রায় সব কটিতে একনিষ্ঠভাবে তাঁর পাশে ছিলেন লাভরভ।
এসব সংকটের মধ্যে ২০০৮ সালে রাশিয়া-জর্জিয়া সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল এবং ২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদের পক্ষ নিয়ে অংশগ্রহ অন্যতম। তা ছাড়া ২০২২ সালে ইউক্রেন হামলাকেও সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করে আসছেন লাভরভ।
৭৫ বছর বয়সী লাভরভ একটি সাহসী ও সংঘাতময় কূটনীতির ধারা গড়ে তুলেছেন। তাঁর এই ধারা পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রায় সময় খাপ খায়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠকে লাভরভ যে সোয়েটার পরে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংক্ষিপ্ত নাম সাইরিলিক ভাষায় লেখা ছিল। প্রসঙ্গত, সাইরিলিক লিপি হলো একটি অক্ষর পদ্ধতি, যা মূলত স্লাভিক বিভিন্ন ভাষা, বিশেষ করে রুশ, ইউক্রেনীয় এবং বেলারুশিয়ানের জন্য ব্যবহার করা হয়।
সংকট সত্ত্বেও পুতিনকে নানা সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল আনতে দেখা গেছে। দীর্ঘদিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকারী সের্গেই শোইগুকে গত বছর অন্য পদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যুদ্ধে আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়ায় তাঁকে সরানো হয়। তবে সরাসরি বরখাস্ত না করে শোইগুকে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি করা হয়েছে। তাই লাভরভকেও অন্য কোনো পদে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে।
| দুই দশকের বেশি সময় ধরে রাশিয়ার কূটনীতির সবচেয়ে পরিচিত মুখ সের্গেই লাভরভ। ফাইল ছবি: এএফপি |
No comments