এক কক্ষের বাড়ি থেকে ‘রাজপ্রাসাদে’ মামদানি
‘আমি আর আমার স্ত্রী এখন ভাবছি, এক শোবার ঘরের ফ্ল্যাটটা আমাদের জন্য একটু ছোট হয়ে যাচ্ছে,’ সম্প্রতি ‘দ্য নিউইয়র্কার রেডিও আওয়ার’–এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জোহরান মামদানি এ কথা বলেন। এ সময় ওই ভাড়া বাসার পানির লাইনের সমস্যার কথা বলেন।
এখন মামদানি যদি মেয়রের সরকারি বাসভবন গ্রেসি ম্যানশনে উঠতে রাজি হন, তবে আর এমন দৈনন্দিন সমস্যা তাঁকে ভোগাবে না, তা নিশ্চিন্তেই বলা যায়। তাঁর নতুন বাসা হবে অনেক প্রশস্ত ও জাঁকজমকপূর্ণ।
কুইন্সের অ্যাস্টোরিয়ায় মামদানির বর্তমান বাসা একটি সাধারণ, ভাড়া-নিয়ন্ত্রিত অ্যাপার্টমেন্ট। আর গ্রেসি ম্যানশন হলো ২২৬ বছরের পুরোনো, ১১ হাজার বর্গফুট আয়তনের এক প্রাসাদ। সেখানে ঝকঝকে আয়না, ঝাড়বাতির আলো, মেহগনি কাঠের দরজা, আপেল ও ডুমুরগাছঘেরা বিশাল লন, আর সবজিবাগান—সবই আছে।
দান্তে ডি ব্লাসিও, বাবা বিল ডি ব্লাসিও নিউইয়র্কের মেয়র হওয়ার সময় কিশোর ছিলেন। ২০১৪ সালে এই গ্রেসি ম্যানশনে পরিবারের সঙ্গে উঠেছিলেন দান্তে। বলেন, ‘আমি নিজেকে তখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ভাগ্যবান ছেলে মনে করতাম।’ আরও বলেন, ‘নিউইয়র্কে বেড়ে উঠে কোনো জায়গা পেলে সেটা হালকাভাবে নেওয়া যায় না। হঠাৎ করেই একটা লন আর একটা নাচঘর পেয়ে গেলে তো কথাই নেই।’
‘তবে এই বাড়িতে থাকা কিছুটা বিচ্ছিন্নতাও এনে দেয়,’ বলেন দান্তে। ‘নিউইয়র্কের জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতা—এর গৌরব আর অস্বস্তি। এ দুটো থেকেই আপনি দূরে চলে যান।’
গত কয়েক মাস ধরেই মামদানি বলেছেন, তিনি তাঁর বর্তমান ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে চান। কিন্তু বুধবার সকালে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি কি গ্রেসি ম্যানশনে উঠবেন? তখন তিনি নিরুত্তর থাকেন।
‘আমি এখনো জানি না, কোথায় থাকব,’ বুধবার টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন মামদানি। ‘তবে জানি, কোথায় কাজ করব—সেটা হচ্ছে সিটি হল।’
ওই দিনই পরে এক সংবাদ সম্মেলনে মামদানি মজা করে বলেন, ‘গত রাতে আমার সুপারের কাছ থেকে একটা টেক্সট পেয়েছি। তবে গ্রেসি ম্যানশনই শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ মেয়রের ঠিকানা হয়—নিরাপত্তা আর বড় জমায়েত আয়োজনের সুবিধার কারণে; তাঁরা এটা পছন্দ করুন বা না করুন।’
এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো। মামদানির বর্তমান অ্যাপার্টমেন্ট তাঁর সম্ভাব্য নতুন বাসা থেকে কতটা ভিন্ন, এসব উদাহরণ থেকে তা বোঝা যাবে।
তাপ পোহানো ও গরম পানির সুবিধা
২০১৮ সালে মামদানির কুইন্সের ফ্ল্যাটের ভাড়ার বিজ্ঞাপনে আকর্ষণীয় সুবিধার কথা বলা হয়েছিল—‘তাপ পোহানো ও গরম পানির সুবিধা ভাড়ার মধ্যেই’। এটি নিউইয়র্কের আইনে বাধ্যতামূলক সুবিধা।
এ সুবিধাই শেষ নয়। আরও কিছু সুবিধা ছিল। ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে ছিল একটি জানালা, শোবার ঘরে দুটি আলমারি আর ভবনের ভেতরেই থাকতেন তত্ত্বাবধায়ক। নিজস্ব ওয়াশার–ড্রায়ার না থাকলেও ভবনে ছিল সাধারণ লন্ড্রি রুম।
১৯২৯ সালে নির্মিত হালকা ইটের এ নিচু ভবনে লিফট আছে, অ্যাস্টোরিয়ায় এটা বিরল। মামদানির প্রচারশিবির তাঁর ভাড়া ফ্ল্যাট নিয়ে কিছু বলতে চায়নি। অবশ্য, স্থানীয় রিয়েল এস্টেট এজেন্টরা অনুমান করছেন, জায়গাটা সর্বোচ্চ ৮০০ বর্গফুটের।
পূর্ণকালীন শেফ ও বলরুম
অন্যদিকে গ্রেসি ম্যানশনকে একসময় নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদক বর্ণনা করেছিলেন ‘লেবুর রঙের কেকের মতো প্রাসাদ’ হিসেবে। এটি কার্ল শুর্জ পার্কের ওপরে, এফডিআর ড্রাইভ (ম্যানহাটানের পূর্ব তীর ধরে চলা একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক)–এর পাশে অবস্থিত। গ্রীষ্মে বারান্দা থেকে দেখা যায় ইস্ট রিভারের মনোরম দৃশ্য।
অফিসের কাজ শেষে মেয়রদের গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে হয় এ প্রাসাদের কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত ফটক দিয়ে। সামনের দরজায় লাগানো আছে মেজুজা—ছোট একটি বাক্সে ইহুদি ধর্মগ্রন্থের কিছু বাণী–সংবলিত এক স্ক্রল। ১৯৭০–এর দশকের মেয়র আব্রাহাম বিম এটি প্রথম স্থাপন করেন।
নীল ও সোনালি রঙের কার্পেট বিছানো সিঁড়ি
নিচতলা অত্যন্ত সজ্জিত, খুবই ফেডারেল শৈলীর। মেয়রদের জন্য এখানে কোনো পরিবর্তন ঘটানোর সুযোগ নেই। ম্যানশনে একটি বিনোদনকক্ষও আছে; যার মধ্যে বিশাল চুলা। ১৯৬০-এর দশকে মেয়র জন লিন্ডসের সন্তানেরা এটি ব্যবহার করেছেন।
এ ছাড়া আছে বসার ঘর ও ডাইনিং কক্ষ। এ কক্ষের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে প্যারিসের বাগানের ছবি আঁকা ওয়ালপেপার। মেয়ররা চাইলে এখানেই খাবার খেতে পারেন, যা তৈরি করেন গ্রেসি ম্যানশনের পূর্ণকালীন রাঁধুনি। পাশে আছে ১৯৬৬ সালে খুলে দেওয়া নাচঘর।
ম্যানশনের ওপর তলায় রয়েছে পাঁচটি শোবার ঘর। আগে অনেক মেয়রই চেষ্টা করেছেন ম্যানশনের খুব আনুষ্ঠানিক এ অংশকে কিছুটা ঘরোয়া করার।
বিল ডি ব্লাসিওর পরিবার একজন সজ্জাবিদ নিয়োগ করে বাসাটি আধুনিক করেছেন এবং একটি ঘরকে হোম অফিসে রূপান্তর করেছেন। বিম পরিবার আরেকটি ঘরকে খাবার ঘরের জন্য সাজিয়ে ছিল। সেখানে তাঁর স্ত্রী মাঝেমধ্যে মধ্যরাতে নাশতা করতেন।
নিচতলার জানালার কাচে লিন্ডস, রুডলফ জুলিয়ানি ও মাইকেল আর ব্লুমবার্গের সন্তানেরা তাঁদের নাম খোদাই করেছিলেন। সাবেক মেয়র বিল ডি ব্লাসিওর স্ত্রী শির্লেন ম্যাক্রেও তাঁর নাম লিখেছেন।
বড় সুবিধা: পার্টি আয়োজনের জায়গা
মামদানির এখনকার এক শয়নকক্ষের মতো ছোট ফ্ল্যাটে কোনো পার্টি আয়োজন করা সহজ নয়। কিন্তু গ্রেসি ম্যানশন পার্টির জন্যই তৈরি।
মেয়র এরিক অ্যাডামস চলতি বছর এ ম্যানশনে আরব, ইকুয়েডোরিয়ান ও গায়ানা-আমেরিকানদের সম্মান জানিয়ে অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন। এ ছাড়া ফ্লিট উইক, উইমেন্স হিস্ট্রি মান্থ ও নওরোজ উদ্যাপনে পার্টিও করেছিলেন।
অ্যাডামসের ছেলে, র্যাপার জর্ডান কোলম্যানও একবার ছুটির সময় পার্টি করেছিলেন এবং তাঁর নতুন অ্যালবামের গান পরিবেশন করেন।
দান্তে ডি ব্লাসিও মামদানিকে পরামর্শ দিয়েছেন, তিনি বাড়িটিকে মিউজিয়ামের মতো না দেখে সত্যিই যেন ব্যবহার করেন।
‘অ্যাস্টোরিয়া’ বনাম ‘আপার ইস্ট সাইড’
নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে মামদানির প্রতিনিধিত্ব করা এলাকা অ্যাস্টোরিয়া দীর্ঘদিন ধরে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে শান্ত আবাসিক ব্লক, ওয়াটারফ্রন্ট পার্ক ও ভালো পাবলিক স্কুলের সুবিধা আছে। আশপাশের এলাকাতে থাকেন গ্রিস, মিসর ও মরক্কোর অভিবাসীরা। রয়েছে বড় লাতিনো জনগোষ্ঠীও। অ্যাস্টোরিয়া নিউইয়র্ক শহরের একটি সুন্দর, কিন্তু খুব বেশি বিলাসী নয়, এমন এলাকা।
এরপর আসে গ্রেসি ম্যানশনের এলাকা আপার ইস্ট সাইডের কথা। দীর্ঘদিন ধরে এটি নিউইয়র্কের ধনী ও অভিজাত এলাকার অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এখানে বিশ্বের কিছু প্রসিদ্ধ জাদুঘর আছে। এ এলাকা শান্ত, মাঝেমধ্যে গ্রীষ্মের সাপ্তাহিক ছুটিতে প্রায় খালি হয়ে যায়। তখন অনেক বাসিন্দা হাম্পটনস বা ন্যানটাকেট চলে যান।
এ এলাকায় চিজবার্গার বা স্প্যাগেটি পোমোডোরো পাওয়া সহজ। কিন্তু সেই ধরনের খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন; যা মামদানির নিজ এলাকা অ্যাস্টোরিয়ার রেস্টুরেন্টগুলোতে পাওয়া যায়।
নিরাপত্তাই আগে
মামদানির বর্তমান অ্যাপার্টমেন্টে কোনো পাহারাদার বা বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। গ্রেসি ম্যানশনের আসল সুবিধা হতে পারে উঁচু বেড়া, ক্যামেরা ও বাইরে অবস্থান করা পুলিশের দল।
এ কারণে ডি ব্লাসিওর পরিবার শেষ পর্যন্ত এ ম্যানশনেই উঠেছিলেন এবং সাবেক এ মেয়র মামদানিকে একই কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
অবশ্য বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের এক হুমকি শনাক্ত করেছেন এ ম্যানশনে। ‘ওখানে ভূত আছে, বন্ধুরা,’ দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বছরে এক সাংবাদিককে বলেছিলেন তিনি।
এদিকে মাইকেল আর ব্লুমবার্গ পুরোপুরি গ্রেসি ম্যানশন এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এর পরিবর্তে তিনি কাছাকাছি টাউনহাউস পছন্দ করেছিলেন, যা আরেকটু ভালো।
![]() |
| জোহরান মামদানির সম্ভাব্য নতুন বাসস্থান ‘গ্রেসি ম্যানশন’ ছবি: গ্রেসি ম্যানশনের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া |

No comments