সি চিন পিংয়ের কাছে লড়াইয়ে পরিষ্কারভাবে হেরে যাচ্ছেন ট্রাম্প by সাইমন টিসডাল
কিন্তু এ মাসের শেষ দিকে অসীম ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সহজে বশ না মানার পাত্র চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। একুশ শতকে প্রভাব বিস্তারের দৌড়ে সি অনেকটাই এগিয়ে, আর সেটা সম্ভব হচ্ছে প্রতি পদে ট্রাম্পের ভুলের কারণে।
সম্প্রসারণবাদী চীনের কমিউনিস্ট সরকারের চরিত্র ও উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বিতর্ক চলছে দেখে অবাক হতে হয়। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা; হংকং, জিনজিয়াং ও তিব্বতে মানুষের মৌলিক অধিকার দমন; প্রতিবেশী দেশগুলোকে যুদ্ধের হুমকি দেওয়া আর দুনিয়াজুড়ে সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি চালানো— চীন সম্পর্কে এমন একটা উপসংহারে পৌঁছনো যায়।
সম্প্রতি চীন বিরল খনিজ ও চুম্বকের ওপর কড়া রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ জারি করেছে। এ খাতে চীনের প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির উদ্দেশ্যে এটা খুব ইচ্ছাকৃতভাবে নেওয়া ক্ষতিকর পদক্ষেপ।
বিরল খনিজ এ চুম্বকের মতো উপকরণ মোবাইল ফোন, গাড়িসহ আধুনিক ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরির অপরিহার্য উপাদান। নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব গুরুতর। বিরল খনিজ ও চুম্বক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, পারমাণবিক সাবমেরিন, ড্রোন এবং অন্যান্য আধুনিক অস্ত্র তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। চীনের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এগুলো কোনো সামরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বিভিন্ন দেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ এই ধাতুর বিকল্প উৎস খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আগামী মাসে যদি এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়, তাহলে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের অস্ত্র সরবরাহ এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
চীন বিদেশি কোম্পানি ও বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপরও একই ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৯ সাল থেকে একই ধরনের এখতিয়ার দাবি করে আসছে। এখন বেইজিং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তার নিজের কৌশলে খেলছে। এর মানে হচ্ছে, রাজনৈতিক স্বার্থে বাণিজ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
নতুন পদক্ষেপের ঘোষণা শুনে ট্রাম্প প্রথমে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি চীনের ওপর শতভাগ শুল্ক আরোপের হুমকি দেন এবং সি চিন পিংয়ের সঙ্গে পরিকল্পিত বৈঠক বাতিলের কথাও বলেন। কিন্তু বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে শেষ পর্যন্ত তিনি পিছু হটেন। তবু দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ চলছেই, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দার শঙ্কা বাড়াচ্ছে।
যথারীতি এ ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের কোনো পরিকল্পনা নেই। ট্রাম্প নিজেই জানেন না তিনি কী করছেন। সি চিন পিং কিন্তু এমন নেতা নন। তিনি প্রমাণ করছেন যে ট্রাম্প যদি পূর্ণমাত্রার বাণিজ্যযুদ্ধের পথে হাঁটেন, তবু তিনি হোয়াইট হাউসের হামবড়া ভাবের মানুষদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে মোকাবিলা করতে পারেন।
বিরল খনিজ ও চুম্বকের ওপর চীনের কঠোর বিধিনিষেধ হতে পারে দর–কষাকষির ক্ষেত্রে একটি কৌশল, অথবা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কৌশলের ফসল। তবে এটি সম্ভবত কল্পনাজনিত আশাবাদ। বিশ্লেষকেরা চিহ্নিত করছেন যে চীনের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তনের আভাস দেখা যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ধৈর্য ধরার পর সি চিন পিং এখন আক্রমণাত্মক অবস্থানে যাচ্ছেন।
এই পরিবর্তনের কারণ কী? বেইজিংয়ের শাসকেরা এই উপলব্ধি করছেন যে ট্রাম্পের বেপরোয়া ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি পুরোনো ও নতুন সব বন্ধুদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি করেছে। ট্রাম্পের নীতি বিশ্বে একটি শূন্যস্থান সৃষ্টি করছে, যেটা চীন পূরণ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব ও প্রাধান্য দ্রুত কমছে। ইউরোপ ও এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জোটে সমস্যা সৃষ্টি হওয়া, রাশিয়া ও ইসরায়েলের মতো কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে না পারা, অন্য দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ও সফট পাওয়ারের ক্ষমতা কমে যাওয়া, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনকে অবজ্ঞা করা—এসবই সেই পতনের প্রতিফলন।
চীন যেন একেবারে ফাঁকা গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সি চিন পিং, বেসামাল ট্রাম্পের মধ্যকার একটি বিব্রতকর অসম ম্যাচ এটি। ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারক, যাঁদের মস্তিষ্ক ধীরে চলে, তাঁরা এখন পর্যন্ত বিষয়টি বুঝতে পারছেন না। গত সপ্তাহে ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের হাতে চীনের চেয়ে অনেক বেশি কার্ড আছে।
কিন্তু ভ্যান্স কি বাস্তবতাটা বোঝেন? উদাহরণস্বরূপ, স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ সেন্টারের তথ্য বলছে, ‘চীন (দেশটির কাছে সীমাহীন বিরল খনিজ আছে) দ্রুত যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করছে এবং আধুনিক অস্ত্র তৈরি করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের গতির চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় গুণ দ্রুত?’ ভ্যান্স কি বোঝেন যে যুক্তরাষ্ট্রই এই শুল্কযুদ্ধে হেরে যাচ্ছে, যেটা তারা শুরু করেছে? ফরেন পলিসিতে জেমস পামেলা লিখেছেন, ‘এ বছর ট্রাম্প বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার পর চীনা রপ্তানিকারকেরা নতুন বাজার খুঁজে নিতে যথেষ্ট সফল হয়েছেন। গত মাসে চীনের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি গত বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ কমেছে, কিন্তু মোট রপ্তানি ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এর বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকেরা তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চীনের সয়াবিন বাজার হারিয়েছেন। সম্ভবত এটি স্থায়ীভাবে। চীনের সয়াবিন বাজার এখন ব্রাজিলিয়ান উৎপাদকদের হাতে চলে গেছে। উৎসবের মৌসুম আসার আগে এবার আমেরিকান ভোক্তাদের বাড়তি মূল্য গুনতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ খেলনা এবং ক্রিসমাস পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ চীনের তৈরি।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, সি চিন পিং আসলে বিশ্ব শাসন করতে চান না এবং বিশ্বও তাঁর কর্তৃত্ববাদী শাসন চায় না। তাঁরা বলছেন, সি চিন পিংয়ের অগ্রাধিকার ও চীনের মৌলিক স্বার্থে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সেগুলো হলো দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব, কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন।
কিন্তু এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা সি চিন পিং এতটা সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপ নিচ্ছেন যে তাঁকে শুধু এই তত্ত্বের খাপে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। বর্তমান প্রবণতা হচ্ছে, চীন ও আমেরিকার মধ্যে প্রাধান্যের লড়াই অনিবার্যভাবে আরও তীব্র হবে। ট্রাম্প ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কেননা, তিনি যতটা শক্তিশালী, তার থেকে অনেক বেশি পতিত ব্যক্তি। চীনের সঙ্গে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হারের সম্ভাবনা বেশি।
* সাইমন টিসডাল, দ্য গার্ডিয়ানের কলাম লেখক
- দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
| বেইজিংয়ে সামরিক মহড়ায় সি চিন পিং। ছবি : রয়টার্স |
No comments