রহস্যময় ‘ইনফিনিটি গ্যালাক্সি’ আবিষ্কার: বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন by আরিফুল ইসলাম

নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের (জেডব্লিউএসটি) ডেটা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর গবেষকরা তার সংরক্ষিত ডেটার মধ্যে অজানা মহাজাগতিক রহস্যের খোঁজে নেমে কসমস-ওয়েব সার্ভের ছবি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অস্ট্রোনমি এন্ড ফিজিক্সের প্রফেসর পিটার ভ্যান ডকুম এবং কোপেনহেগেন ইউনিভার্সিটির গ্যাব্রিয়েল ব্র্যামার একটি অদ্ভুত আকৃতির বস্তু আবিষ্কার করেছেন, যাকে তারা নাম (ডাক) দিয়েছেন ‘ইনফিনিটি গ্যালাক্সি’।

গত ১৫ জুলাই নাসার গডডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের ওয়েব মিশন ‍টিম কর্তৃক ব্লগে পাবলিশকৃত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, এই গ্যালাক্সিটির আকৃতি অস্বাভাবিক টাইপের। গ্যালাক্সিটির দুইটি কম্প্যাক্ট লাল নিউক্লিয়াস ও প্রতিটির চারপাশে একটি করে রিং রয়েছে যা একসাথে মিলিয়ে ইংরেজি '∞' বা ইনফিনিটির চিহ্নের মতো দেখায়।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই দুটি ডিস্ক, গ্যালাক্সির মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকেই এর সৃষ্টি হয়েছে। ফলো-আপ অবজারভেশন থেকে বিজ্ঞানীদ্বয় জেনেছেন, এই ইনফিনিটি গ্যালাক্সিটির কেন্দ্রে রয়েছে একটি সক্রিয় সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল!

তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো—এই ব্ল্যাক হোলটি গ্যালাক্সির কোনো একটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে নয়, বরং দু’টি নিউক্লিয়াসের মাঝখানে এক বিশাল গ্যাসময় অঞ্চলে অবস্থান করছে। এই গবেষকদের মতে, এটি একটি গ্যাস মেঘ সরাসরি ধসে গিয়ে ব্ল্যাক হোল তৈরি হওয়ার ঘটনা হতে পারে—যা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল কীভাবে গঠিত হয় সেই প্রশ্নে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

ড. পিটার ভ্যান ডকম নাসাকে বলেছেন, ‘এই গ্যালাক্সি সম্পর্কে সব কিছুই অস্বাভাবিক। এর আকৃতি যেমন, তেমনি এর কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলটিও খুব সক্রিয়। সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলো, ব্ল্যাক হোলটি কোনো নিউক্লিয়াসে নয়, বরং ঠিক মাঝখানে। তখন আমাদের প্রশ্ন জাগে—এটি এখানে এল কীভাবে?’ তিনি ব্যাখ্যা করে আরো বলেন, ‘ব্ল্যাক হোলটি যদি সত্যিই মাঝখানে গঠিত হয়ে থাকে, তাহলে আমরা হয়তো প্রথমবারের মতো একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের জন্মপ্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছি।’

নাসা জানিয়েছে, সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল কীভাবে সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে দুটি মূল তত্ত্ব রয়েছে—তার মধ্যে একটি ‘লাইট সিড’ এবং অপরটি ‘হেভি সিড’। লাইট সিড তত্ত্ব অনুসারে, তারার মৃত্যুতে যে ব্ল্যাক হোল তৈরি হয় যা সাধারণত ১ হাজার সূর্যের ওজনের সমান, সেগুলো ধীরে ধীরে একত্রিত হয়ে বিশাল ব্ল্যাক হোল তৈরি করে। তবে এতে সময় লাগে অনেক, অথচ ওয়েব এমন অনেক বিশাল ব্ল্যাক হোল খুঁজে পেয়েছে মহাবিশ্বের একেবারে প্রাথমিক সময়ে—যার ব্যাখ্যায় আবার ‘লাইট সিড’ যথেষ্ট নয়।

এদিকে হেভি সিড তত্ত্ব অনুযায়ী, এক বিশাল গ্যাসীয় মেঘ সরাসরি ধসে গিয়ে এক ধাক্কায় এক মিলিয়ন সূর্যের সমান ওজনের ব্ল্যাক হোল তৈরি করতে পারে। এটা দ্রুত হয়, কিন্তু সমস্যা হলো—গ্যাসিও মেঘ সাধারণত ধসে তারকা তৈরি করলেও ব্ল্যাক হোল তৈরি করে না। নাসার ঐ প্রতিবেদন থেকে আরো জানা গেছে, তবে এই ধরনের ধসকে তারকা উৎপাদন থেকে বিরত রাখা কঠিন।

নাসা আরো জানিয়েছে, তবে ইনফিনিটি গ্যালাক্সির ডেটা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, দু’টি ডিস্ক গ্যালাক্সির সংঘর্ষের ফলে গ্যাস চাপে সংকুচিত হয়ে একটি ঘন গাঁঠ তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে ব্ল্যাক হোলে রূপ নেয়।

তারা (বিজ্ঞানীরা) দেখতে পেয়েছেন—দু’টি নিউক্লিয়াসের মাঝখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ আয়নিত হাইড্রোজেন গ্যাস, যা ব্ল্যাক হোলের চারপাশে বিস্তৃত। ব্ল্যাক হোলটি সক্রিয়ভাবে পদার্থ শোষণ করছে, যার প্রমাণ মিলেছে নাসার চন্দ্রা এক্স-রে ও ভেরি লার্জ অ্যারে রেডিও টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া এক্স-রে ও রেডিও তরঙ্গ থেকে। তাছাড়া ব্ল্যাক হোলটি যদি বাইরে থেকে এসে পড়ে, তাহলে তার গতি (ভেলোসিটি) আশেপাশের গ্যাসের গতির সঙ্গে মিলবে না। কিন্তু দেখা গেছে, ব্ল্যাক হোল এবং আশপাশের গ্যাসের গতি প্রায় অভিন্ন যা পের্ সেকেন্ডে প্রায় ৫০ কিমি মধ্যে।

গত ১৫ জুলাইয়ের নাসার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পর্যবেক্ষণের জন্য তারা ডিরেক্টর'স ডিসক্রিশনারি টাইম পেয়ে ওয়েব দিয়ে ফলো-আপ স্টাডি করেন। সেখানে তারা আরও চমৎকার তথ্য পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে, আয়নিত গ্যাসের বিস্তৃতি (ব্যাস) নিশ্চিত হয়েছে। ব্ল্যাক হোলটি গ্যাসের গতির ঠিক মাঝখানে অবস্থান করছে, যা প্রমাণ করে এটি ওই গ্যাস থেকেই গঠিত। এবং অবাক করা বিষয় হচ্ছে, উভয় নিউক্লিয়াসেও সক্রিয় ব্ল্যাক হোল রয়েছে! অর্থাৎ, এই একটি গ্যালাক্সি সিস্টেমে রয়েছে তিনটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল!

উক্ত প্রতিবেদনে থেকে আরো জানা গেছে, আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে, এটা সরাসরি পতিত ব্ল্যাক হোল। কিন্তু আমরা বলতে পারি, এটি একটি সদ্য জন্ম নেওয়া ব্ল্যাক হোল হওয়ার সম্ভাবনাকে জোরালোভাবে সমর্থন করছে, এবং অন্যান্য সম্ভাবনাকে দুর্বল করছে। তবে আমরা আরও এটি আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ চালিয়ে যাবো। এবং এই আবিষ্কার শুধু একটি মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচনই নয়, বরং ব্ল্যাক হোল সৃষ্টির একটি নতুন প্রক্রিয়ার সম্ভবনাকে সামনে এনেছে—যা আমাদের মহাবিশ্ব বোঝার ধারাকে আমূল বদলে দিতে পারে বলে নাসাকে জানিয়েছে, ইয়েল ইউনিভার্সিটির অস্ট্রোনমি অ্যান্ড ফিজিক্সের প্রফেসর, ভ্যান ডকুম।

রেফারেন্স:
১) van Dokkum, P., Brammer, G., et al. (2025). A candidate direct-collapse black hole discovered with JWST in a dual-ring galaxy system. The Astrophysical Journal Letters.
২) NASA. (2025, July 15). NASA’s Webb finds possible “direct collapse” black hole. NASA Science. https://science.nasa.gov/blogs/webb/2025/07/15/nasas-webb-finds-possible-direct-collapse-black-hole/
৩) AAS Nova. (2025, July 15). A candidate direct-collapse black hole in the Infinity Galaxy. American Astronomical Society. https://aasnova.org/2025/07/15/a-candidate-direct-collapse-black-hole-in-the-infinity-galaxy/
৪) Howell, E. (2025, July 16). The JWST might have found the first direct-collapse black hole. Universe Today. https://www.universetoday.com/165320/the-jwst-might-have-found-the-first-direct-collapse-black-hole/
৫) Pultar, L. (2025, July 17). James Webb just found a black hole that breaks the rules—and now physicists are tearing each other apart over what it means. Rude Baguette. https://www.rudebaguette.com/en/2025/07/james-webb-just-found-a-black-hole-that-breaks-the-rules/
৬) Time Magazine. (2025, July 18). Astronomers discover an uncommon way for black holes to form. Time. https://time.com/7303593/astronomers-discover-uncommon-black-hole/
৭) Barrow, K. S. S., Aykutalp, A., & Wise, J. H. (2018). Direct-collapse black hole formation in metal-poor gas-rich galaxies. Monthly Notices of the Royal Astronomical Society, 480(1), 60–74. https://doi.org/10.1093/mnras/sty1706
৮) Wikipedia contributors. (n.d.). Direct collapse black hole. Wikipedia. Retrieved July 30, 2025, from https://en.wikipedia.org/wiki/Direct_collapse_black_hole
৯) https://science.nasa.gov/blogs/webb/2025/07/15/nasas-webb-finds-possible-direct-collapse-black-hole/

mzamin

No comments

Powered by Blogger.