রাশিয়ার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র কি তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘গোল্ডেন ডোম’ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দেবে

রাশিয়া ২১ অক্টোবর বুরেভেসতনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। এটি পরমাণু-শক্তিচালিত দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যা বর্তমান বিশ্বের উন্নত সব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রুশ সেনা কমান্ড ঘাঁটি পরিদর্শনের সময় চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ এই পরীক্ষার ঘোষণা দেন।

গেরাসিমভের মতে, ক্ষেপণাস্ত্রটি ১৪ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বহু ঘণ্টা আকাশে উড়েছে। নির্ধারিত উল্লম্ব ও অনুভূমিক—সব কৌশল শেষ করেছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই পাল্লাই ক্ষেপণাস্ত্রটির চূড়ান্ত সীমা নয়।

পুতিন এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘বিশ্বের আর কারও কাছে নেই, এমন অনন্য এক পণ্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, পরীক্ষার সব মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য এটিকে প্রস্তুত করতে এখনো ‘অনেক কাজ বাকি আছে।’

পুতিন বলেন, ‘আমাদের আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঠিক করতে হবে—এই নতুন ব্যবস্থাটি কোনো শ্রেণির অস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত, এর সম্ভাব্য ব্যবহার পদ্ধতি কী হতে পারে। এ ছাড়া আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে এই ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের লক্ষ্যে অবকাঠামো প্রস্তুত করতে হবে।’

এই পরীক্ষার মাধ্যমে বুরেভেসতনিক পরীক্ষামূলক প্রোটোটাইপের ক্ষেত্র থেকে পরিচালনা করার মতো একটি অস্ত্রে পরিণত হয়েছে এবং বিশ্ব মঞ্চের আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রতিরক্ষায় অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন

চলতি বছরের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উচ্চাভিলাষী ‘গোল্ডেন ডোম’ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু করেন। আধুনিক হুমকি বিশেষ করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, হাইপারসনিক অস্ত্র এবং উন্নত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য একটি বিস্তৃত জাতীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনা ছিল এটি।

গোল্ডেন ডোম যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ফাঁকগুলো পূরণ করতে এবং বিস্তৃত পরিসরের আকাশভিত্তিক বিপদ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে আশা করা হচ্ছিল।

সবচেয়ে অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও এমন হুমকির মুখে পড়তে পারে। সেটাও এই রুশ ক্ষেপণাস্ত্রকে থামাতে পারবে না। ওয়াশিংটন যখন তাদের নতুন ঢাল তৈরির পরিকল্পনায় জোর দিচ্ছে, ঠিক তখনই রাশিয়া এমন একটি অস্ত্রকে ধারণা থেকে বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এটি পৃথিবীতে বিদ্যমান অন্য কোনো অস্ত্রের মতো নয়। এটি হচ্ছে সীমাহীন পাল্লার পরমাণু-শক্তিচালিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। এটি এমন এক হুমকি, যার বিরুদ্ধে গোল্ডেন ডোমকে লড়াই করতে হবে।

বুরেভেসতনিকের মতো নতুন ধরনের এই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বিমান প্রতিরক্ষার ধারণাকে মৌলিকভাবে বদলে দিতে পারে।

তাই মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাবিদদের এমন অপ্রচলিত হুমকি নিয়ে আগে থেকে ভাবাটা স্বাভাবিক। এমটি–অ্যান্ডারসনের মতো ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স গবেষকেরা সম্প্রতি উপগ্রহের চিত্র শেয়ার করেছেন, যাতে বুরেভেসতনিক উৎক্ষেপণের জন্য ভলোগদার কাছে স্থাপনা নির্মাণের সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখা যাচ্ছে। এটি সত্য হলে, বিশ্বব্যাপী কৌশলগত স্থিতিশীলতার ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখা একটি অস্ত্রের মোতায়েন প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপ শুরু হয়েছে বলা চলে।

বুরেভেসতনিক কীভাবে কাজ করে

দৃশ্যত, বুরেভেসতনিক দেখতে একটি প্রথাগত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মতোই, যার ভাঁজ করা ডানা এটিকে সহজে সংরক্ষণে সহায়তা করে। এটি সলিড-ফুয়েল বুস্টার ব্যবহার করে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় এবং ক্রুজিং গতিতে পৌঁছানোর পর এটি একটি বায়ুমণ্ডলীয় পরমাণু-শক্তিচালিত জেট ইঞ্জিনে রূপান্তর হয়। তত্ত্বগতভাবে, এই ইঞ্জিন ছোট একটি পারমাণবিক চুল্লির মাধ্যমে বাইরের বাতাসকে উত্তপ্ত করে, যা ক্ষেপণাস্ত্রটিকে জ্বালানি ছাড়া সপ্তাহ এমনকি মাসব্যাপী আকাশে থাকতে সাহায্য করে।

সূত্রমতে, এই ক্ষেপণাস্ত্রের পরিচালন পাল্লা ২২ হাজার কিলোমিটার বলে অনুমান করা হয়েছে। বাস্তবে এটি কার্যত সীমাহীন হতে পারে। এমন একটি ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভাব্য সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে অনির্দিষ্টকালের জন্য টহল দিতে পারে। উৎক্ষেপণ করার পাওয়ার পর এটি অপ্রত্যাশিত পথ ধরে লক্ষ্যের দিকে কৌশলগতভাবে এগোতে পারে। ফলে এটিকে বাধা দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

রাশিয়ার শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের মতে, ২১ অক্টোবরের পরীক্ষায় ক্ষেপণাস্ত্রটি কয়েক ঘণ্টা ধরে আকাশে ছিল, ১৪ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত উল্লম্ব ও অনুভূমিক কৌশলগুলো সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।

কার্যকরভাবে বুরেভেসতনিককে ‘ডুমসডে অস্ত্র’ অর্থাৎ পরমাণু যুদ্ধের ক্ষেত্রে নিশ্চিত পাল্টা আঘাত হানার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করার মতো ডিজাইন করা হয়েছে।

প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি

পরমাণু-শক্তিচালিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবীর যেকোনো স্থানে যেকোনো দিক থেকে আঘাত হানতে সক্ষম। এটি স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবহার করে উড্ডয়নের পথ হালনাগাদ করতে পারে, বাধা এড়াতে পারে, এমনকি মাঝ-আকাশে নতুন লক্ষ্যবস্তুর তথ্যও গ্রহণ করতে পারে।

১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে অর্জন করা প্রযুক্তিগত সাফল্যের ফল হচ্ছে নিরাপদে চালানোর ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু-শক্তিচালিত ইঞ্জিন। সেই সময় রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা সফলভাবে ছোট পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করেছিলেন। এসব অগ্রগতি কেবল বুরেভেসতনিকের জন্যই নয়, বরং ডুবো ড্রোনের মতো অন্যান্য প্রকল্পের পথও প্রশস্ত করেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু-শক্তিচালিত বিমানের ধারণা নিয়ে গবেষণা করেছিল। বি–৩৬ এবং টিইউ–৯৫–এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে ব্যাপক গবেষণা সত্ত্বেও প্রকৌশলগত কঠিন চ্যালেঞ্জ, অত্যাধিক খরচ এবং বিকিরণ সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগের কারণে দুই দেশই শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাতিল করে।

রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধের প্রকৌশলীরা যা স্বপ্ন দেখতেন, আজ আরও উন্নত চুল্লি প্রযুক্তির সাহায্যে সেই সাফল্য অর্জন করতে চলেছে।

বুরেভেসতনিক কি প্রস্তুত

সর্বশেষ পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ছিল, বুরেভেসতনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রোটোটাইপ পর্যায় অতিক্রম করতে পারবে কি না। এখন ১৪ হাজার কিলোমিটারের সফল উড্ডয়ন রেকর্ড করা হয়েছে। ‘পরীক্ষায় সব লক্ষ্য অর্জিত’ হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বিবৃতি দিয়েছেন। তাই এখন প্রশ্নটি ‘যদি’ থেকে সরে ‘কবে’ এটি কার্যক্ষম হবে—সেই দিকে চলে এসেছে।

একই সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সতর্ক করে বলেছেন, সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করার আগে এখনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—এই ক্ষেপণাস্ত্রের শ্রেণি নির্ধারণ, ব্যবহারের ধারণা পরিমার্জন করা এবং মোতায়েনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা।

কয়েকটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়া ২০২৬ সালের প্রথম দিকেই বুরেভেসতনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন শুরু করতে পারে। সম্ভবত বিপুল সংখ্যায়। এই ক্ষেপণাস্ত্রের প্রায় সীমাহীন পাল্লার কারণে এগুলো আর্টিক, সাইবেরিয়া বা প্রশান্ত মহাসাগরের মতো বিশাল এলাকায় টহল দিতে পারবে। একই সঙ্গে প্রচলিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কাছে অদৃশ্য থাকতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডেন ডোম প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ হবে এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত এবং ট্র্যাক করা। এ জন্য সম্ভবত মার্কিন নৌবাহিনীর সঙ্গে নজিরবিহীন সমন্বয় এবং মহাকাশভিত্তিক ট্র্যাকিং ব্যবস্থার সম্পূর্ণ ব্যবহার প্রয়োজন হবে।

মহাকাশ: ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার শেষ সীমানা

সব মিলিয়ে বুরেভেসতনিকের মতো একটি অস্ত্রকে পরাজিত করতে হলে সম্পূর্ণরূপে সমন্বিত মহাকাশভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা লাগবে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ট্র্যাকিং, উৎক্ষেপণ অঞ্চলগুলো দ্রুত শনাক্তকরণ এবং প্রতিহত করার জন্য বর্তমান ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি সক্ষমতা অপরিহার্য হয়ে উঠবে। এমনকি এজিস-সজ্জিত জাহাজের মতো উন্নত নৌসম্পদও বিরাট এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

আপাতত, এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার কোনো সহজ সমাধান নেই। ওয়াশিংটন যখন প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত তখন ডুবো পারমাণবিক ড্রোনের মতো পরবর্তী-প্রজন্মের অস্ত্রের বিবেচনায় মস্কো বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ এই প্রতিযোগিতায় রাশিয়া সম্ভবত ইতিমধ্যেই কৌশলগত খেলার ছক বদলে দিয়েছে এবং এমন এক ‘চেকমেট’ বানিয়ে ফেলেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডেন ডোম হয়তো ঠেকাতে পারবে না।

ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার প্রতীকী ছবি
ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার প্রতীকী ছবি

No comments

Powered by Blogger.