গাজার বর্বরতা নিয়ে হারেৎজ পত্রিকার মূল্যায়ন

সোমবার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে চারটি শেল আঘাত হানে। এতে ২২ জন নিহত হন। প্রথম ও দ্বিতীয় হামলার মধ্যে নয় মিনিটের ব্যবধান। সেই ফাঁকে চিকিৎসক ও সাংবাদিকরা জরুরি সিঁড়ির পাশে জড়ো হন। সেখানে প্রথম আঘাতটি হয়। টেলিভিশন ক্যামেরাও ছিল। তাই দ্বিতীয় হামলায় বহু মানুষ নিহত হওয়ার দৃশ্য বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই চিকিৎসক ও সাংবাদিক। তারা কেউই সশস্ত্র অবস্থায় ছিলেন না। এ খবর দিয়ে ইসরাইলের প্রভাবশালী হারেৎজ পত্রিকা একটি খবর প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, এই হামলার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষোভ এতটাই তীব্র হয় যে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইংরেজি ভাষায় এক্সে এসে ক্ষমা চান।

এ ঘটনা বিরল, নজিরবিহিন। নেতানিয়াহু সেদিনের ঘটনায় বলেন, ‘নাসের হাসপাতালে আজ যে দুঃখজনক ভুলটি ঘটেছে, ইসরাইল গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে।’ তবে হিব্রু অ্যাকাউন্টে তিনি এ বার্তা দেননি। অর্থাৎ তার নিজদেশের মানুষের কাছে ভাল থাকতে চেয়েছেন। তাদের সামনে তিনি দেখাতে চেয়েছেন তিনি ক্ষমা চাননি। কিন্তু সত্যের কল যে বাতাসে নড়ে। যারা সচেতন, আন্তর্জাতিক খবরাখবর রাখেন তারা ঠিকই জেনে গেছেন তার হঠকারিতা। হারেৎজ আরও লিখেছে, আগস্টে গাজায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই ইসরাইলি বিমান হামলা বা কামান নিক্ষেপে প্রাণ হারিয়েছেন। এগুলো আঘাত হেনেছে বাস্তুচ্যুতদের তাঁবু, ঘরবাড়ি কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ওপর। সেদিনই হাসপাতাল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাস্তুচ্যুতদের এক তাঁবুতে মিসাইল আঘাত হানে। নিহত হন পাঁচজন- ওদাহ ও আলিনে কাওয়ারিয়া দম্পতি এবং তাদের তিন শিশু সন্তান ঈসা, আলিয়ান ও হুসাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে তিন শিশুর দেহ পাশাপাশি পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওদাহর ভাই আহমেদ জানান, পরিবারটি ঘুমিয়ে থাকার সময় ড্রোন হামলায় মারা যায়। তিনি আরও বলেন, পরিবারটির কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল না। বাবা ওদাহ আগের এক হামলায় চোখ হারান এবং তিনি আংশিক প্যারালাইসিসে ভুগছিলেন। আহমেদ বলেন, গাজায় কোথাও নিরাপদ জায়গা নেই। তারা শুধু আমাদের একত্রিত করে মেরে ফেলে। একই দিনে নুসোইরাত শরণার্থী শিবিরে আরেকটি তাঁবুতে মিসাইল আঘাত হানে। নিহত হন শেখ ইমরান কুদাইহ, তার সন্তান জাকারিয়া, ঈসা, ইয়াহিয়া এবং ১২ বছরের নাতি আনাস।

কিন্তু সেদিনটি ছিল গাজার জন্য তুলনামূলক কম প্রাণঘাতী দিন। আগস্টে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০ জনকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মৃত্যুর তালিকায় যোগ করতে হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৭০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলায়। আনুমানিক ৩০ ভাগ মানুষ নিহত হয়েছেন খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র বা সাহায্য কনভয়ের কাছে গুলিতে। কিন্তু বেশির ভাগই প্রাণ হারিয়েছেন বিমান হামলা ও কামান নিক্ষেপে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশ্ব গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক আলোচনায় গাজার ব্যাপক ক্ষুধা নিয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে। তবে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সবচেয়ে বড় মৃত্যুর কারণ রয়ে গেছে বিমান হামলাই। হারেৎজ সাময়িকী ইসরাইলি সেনাদের কাছে জুলাইয়ের শেষ থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত ২৯টি নথিভুক্ত হামলার তালিকা পাঠায়। সেখানে ১৮০ জন নিহত হয়েছেন বলে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। ইসরাইলি সেনারা মাত্র পাঁচটির আংশিক জবাব দিয়েছে। ২৪টির ক্ষেত্রে কেবল সাধারণ বিবৃতি দিয়েছে। ২৮ জুলাই নুফাল পরিবারের ১৫ জন নিহত হন। সেনাদের দাবি ছিল টার্গেট ছিল চারজন যোদ্ধা। ১১ আগস্ট গাজার দক্ষিণাঞ্চলে সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের কথা বলে একটি আবাসিক ভবনে মিসাইল হামলা চালানো হয়। নিহত হন নয়জন, এর মধ্যে আরহিম পরিবারের ছয় শিশু রয়েছে। কয়েক দিন পর একটি স্কুলে আশ্রিত বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর ওপর হামলায় সাতজন নিহত হন। ২৫ আগস্ট নাসের হাসপাতালের দিনেই কাওয়ারিয়া পরিবার নিহত হয়। কিন্তু সেনারা এ হামলাকে অস্বীকার করছে।

অন্য হামলাগুলোর বিষয়ে সেনাদের প্রতিক্রিয়া ছিল কেবল সাধারণ বক্তব্য: তারা শুধু “সামরিক টার্গেটে” হামলা চালায় এবং বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করে। তবে অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। ৮ আগস্ট আবু হাজরাস পরিবারের মুহাম্মদ, রানা ও তাদের পাঁচ সন্তান নিহত হন। মুহাম্মদ ছিলেন ফাতাহ-ঘনিষ্ঠ পুলিশ কর্নেল এবং যোগাযোগ বিষয়ক প্রকৌশলী। পরিবারটির  হামাসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। ১৩ আগস্ট আবু হানিদেক পরিবারের সাত শিশু নিহত হয়। ৩০ আগস্ট হামাস মুখপাত্র আবু উবেইদা নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে গাজা সিটির আনসার এলাকায় রুটি সংগ্রহে দাঁড়ানো লাইনে মিসাইল আঘাত হানে। নিহত হন ১২ জন। এর মধ্যে পাঁচটি শিশু। ভিডিওতে দেখা যায়, মানুষ রক্তমাখা রুটি কুড়িয়ে নিচ্ছে। দেহগুলো ট্রাকে তোলা হচ্ছে। আর এক মা ভেঙে পড়া ভবনের সামনে সন্তানকে বিদায় জানাচ্ছেন। ইসরাইলি সেনাদের পক্ষ থেকে হামলার সুনির্দিষ্ট কারণ জানানো হয়নি।

https://mzamin.com/uploads/news/main/178916_Abul-2.webp

No comments

Powered by Blogger.