ভারতে নতুন ফাঁদে ‘বাংলা ভাষা’, মুক্তির পথ কী? by ঈশিতা দস্তিদার

ভাষা বলতে সাধারণত মানুষে মানুষে যোগাযোগের একটি মাধ্যমকে বুঝি আমরা। কিন্তু এ যুগে ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যমে সীমিত নয়; বরং ভাষার ব্যবহার ক্ষমতার কাঠামো ও সামাজিক পরিচয়কে প্রভাবিত করে। নব্য উদারনীতিবাদের যুগে ভাষা রাজনীতির এমন এক জটিল আবর্তে ঘুরছে, যেখানে বাণিজ্যিকীকরণ, বিশ্বায়ন, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও ভাষার অধিকারের বিষয়গুলো সম্পর্কিত, যা আদতে ভাষার মাধ্যমে ক্ষমতা ও শ্রেণি আধিপত্যের রাজনীতিটাকেই বলবৎ করে। নির্ধারণ করে দেয় কোন ভাষাগুলো প্রভাব বিস্তার করবে, আর কোন ভাষার গুরুত্ব হারিয়ে যাবে বা সেটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।ভাষা জাতিগত ঘৃণারও হাতিয়ার হচ্ছে।

ভাষা নিয়ে এতসব তাত্ত্বিক কথা বলার কারণ, সম্প্রতি ভারতে বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের নিয়ে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর তৎপরতা এবং তার মোকাবিলায় বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের বিভক্ত হয়ে পড়ার ঘটনাগুলো।

ভাষা নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য দুই বাংলার ভাষার মধ্যে বিভাজনের রেখা টেনে বলেছেন, বাংলাদেশের বই আর পশ্চিমবঙ্গের পাঠ্যবই পড়লেই নাকি বুঝতে পারা যাবে, কোন বই সুবোধ সরকার লিখেছেন; আর কোন বই বাংলাদেশের শফিকুল ইসলাম লিখেছেন।

অথচ এটা কি সত্য নয় যে ভারতীয় বাঙালি ও বাংলাদেশের বাঙালি—উভয়ের মাতৃভাষা বাংলা। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী সব সংবিধান স্বীকৃত ভারতীয় ভাষা ভারতের রাষ্ট্রভাষা—হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়। তাহলে বাংলাভাষীদের এত বিড়ম্বনা কেন সেখানে?

ভারতবর্ষে আরএসএস–বিজেপি মিলিতভাবে ভাষা নিয়ে যে নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরির চেষ্টা করছে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে হিন্দুধর্মের (হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি) সঙ্গে হিন্দি ভাষার তথাকথিত অনিবার্যতা দেখিয়ে উত্তর ভারতীয় ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকাঠামোকে শক্তিশালী করা।

এ প্রকল্প দক্ষিণ ভারতে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের দুর্বলতায় এখানে বাংলার বিরুদ্ধে বাংলাকেই দাঁড় করানো হচ্ছে। এ কাজে বাংলা ভাষার বিবিধ আঞ্চলিক বাচনভঙ্গির (লিখিত ও কথ্য উভয়ই) ফাঁদে ফেলে ‘বাংলাদেশ’ ও ‘বিদেশি’ ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারতীয় সীমান্তে ভারতীয় নাগরিকদের একাধিক পুশ ইনের ঘটনা দেখেছি আমরা। অনেক ভারতীয় বাংলাভাষীকে জোরপূর্বক বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুশ ইন করতে ভাষাকে অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে।

যদ্দুর জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে শিল্প–কলকারখানার আকাল, কৃষিতে অলাভজনক অবস্থা, ধুঁকতে থাকা চা–বাগান, কটন, জুট মিলসহ অন্যান্য শ্রমক্ষেত্র থেকে অনেক মানুষ অন্য রাজ্যে বা অন্য দেশে যাচ্ছে কাজের খোঁজে। তাদের অনেকে কলকাতার প্রমিত শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে না, ফলে তাদের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ধরে এনে ‘বাংলাদেশি’ বলে পুশ ইন করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ভাষাকে এখানে শ্রেণি নিপীড়নের সঙ্গে মেলানো হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার উপযোগিতা কমানো হচ্ছে অনেক আগে থেকে। বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি কাজগুলো ইংরেজি ভাষার ব্যবহার সমস্যায় ফেলে বাংলাভাষী সাধারণ মানুষদের। যারা সংখ্যায় ইংরেজি জানা মানুষদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। ফলে দাপ্তরিক নানান কাজে সাধারণের সঙ্গে দপ্তরের ঔপনিবেশিক দূরত্ব আছে আজও। অনেকটা প্রভু–ভৃত্য সম্পর্কের অনুরূপ। আবার গ্রামগঞ্জে মানুষ বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে সব কাজে, সেটা চাষাবাদের কাজ হোক বা পালাপার্বণ, অমাবস্যা-পূর্ণিমার খবরাখবরের জন্যও হতে পারে। বহু কাজে বাংলা ক্যালেন্ডার তার ভরসা। ব্যবহারিক উপযোগিতার পাশাপাশি ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির এই বন্ধনে ধর্মীয় বিভেদ গৌণ হয়ে পড়ে।

এই আলোচনার মাঝে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের কবিতার কয়েকটি লাইনও মনে পড়ছে:

বাংলা যেন কেমন-কেমন, খুউব দুর্বল প্যানপ্যানে

শুনলে বেশি গা জ্ব’লে যায়, একঘেয়ে আর ঘ্যানঘ্যনে

কীসের গরব? কীসের আশা? আর চলে না বাংলা ভাষা

কবে যেন হয় ‘বেঙ্গলি ডে’, ফেব্রুয়ারি মাসে না? জানেন দাদা,

আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।

(বাংলাটা ঠিক আসে না)

এসবই হলো আমাদের জটিল ঔপনিবেশিক মননের শহুরে বিবিধ প্রকাশ। বাংলা ভাষা ভালোভাবে লিখতে, পড়তে না পারা অনেকের কাছে গর্বের বিষয়। ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ না হওয়া যতটা অদক্ষতা ও সংকোচের, বাংলার ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। ইংরেজি না জানলে চাকরিতে অগ্রাধিকার নেই—এটা যতটা অবলীলায় বিজ্ঞাপন দেওয়া যায়, বাংলা না জানলে কোনো সমস্যা হবে বলে শোনা যায় না।

অথচ বাংলা ভাষার জন্য এ অঞ্চলের রয়েছে তিনটা মহান আন্দোলন ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। বর্তমানে বিহার-ঝাড়খন্ডে ভাগ হয়ে থাকা মানভূম জেলায় হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল বাংলাভাষীদের প্রথম ভাষা আন্দোলন। ১৯১২ সাল থেকে ওই আন্দোলন শুরু হলেও তীব্রতর হয় প্রায় ৩৬ বছর পরে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের মাঝে।

অধুনা পুরুলিয়া জেলা বা তৎকালীন মানভূম ছিল ঐতিহাসিকভাবে বাংলাভাষী অধ্যুষিত। মাতৃভাষা বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য এ সুদীর্ঘ লড়াইয়ে মানভূমের গণমানুষের আত্মনিবেদন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে টুসু সত্যাগ্রহ, টুসু গানের কথা ভুলে যাই কীভাবে!

পরবর্তী সময় বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভাষা আন্দোলন যেমন বিশ্ব ইতিহাসে ভাষার লড়াই হিসেবে মাইলফলক হয়ে থাকবে, তেমনি স্মরণীয় আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষীদের রক্তস্নাত আত্মদানও। ১৯ মে ১৯৬১, আসামজুড়ে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনকালে কাছাড়ের শিলচরে একজন নারীসহ ১১ জন বাংলাভাষী শহীদ হন। সেই লড়াইয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল আসামের বাংলা ভাষাভাষীদের অন্যতম প্রেরণা।

এসব আন্দোলন, লড়াই, রক্ত আর জীবনের বিনিময়েও বাংলা ভাষার একটা সমন্বিত চেহারা দাঁড় করানো যায়নি। বাংলাভাষী মানুষ ঔপনিবেশিকতার রাজনীতি ও হালের দক্ষিণপন্থার উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বারবার কেবল বিভক্ত হচ্ছে। কখনো ধর্মীয়ভাবে, কখনো আঞ্চলিকতার সূত্র ধরে। কখনো সীমান্তের হিসাবে। কেউ দেশে বসে ভাগাভাগিতে আছে। কেউ কেউ বিদেশে বসেও বিভেদ উসকে তুলছে।

সে কারণেই সন্দেহ হয়, করাচি, উত্তর ভারত, আসাম, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশজুড়ে বসবাসরত বাংলাভাষী মানুষেরা যার যার সীমান্তে থেকেই একটা সাংস্কৃতিক ঐক্যে পৌঁছাতে পারবে কি কোনো দিন আদৌ?

ভাষার আধিপত্য তৈরির জন্য নয়, বরং ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস রক্ষায় বাংলার পাশাপাশি আরও যেসব ভাষা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের শিকার হচ্ছে, তাদের জন্যও আশাব্যঞ্জক হতে পারে বাংলাভাষীদের ঐকতান। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার সার্বক্ষণিক উন্মাদনা পেরিয়ে তেমন ঐকতান তৈরি করবে কে?

‘বাজারে’র বিবেচনাতেও এই ঐক্য সবার জন্য সুবিধাজনক হতে পারত। বই-গান-সিনেমা ইত্যাদি সংস্কৃতিও বড় এক পণ্য একালে। ত্রিশ কোটি বাংলাভাষী ঢিলেঢালা একটা সাংস্কৃতিক যোগাযোগে থেকেও তার যাবতীয় ভাষা-সংস্কৃতির বাজারকে একটি একক চেহারা দিতে পারে, যা তার মানুষদের আত্মবিশ্বাস বাড়াত এবং অপদস্থ না হওয়ার জন্য একটা সাহসী রক্ষাকবচ হতে পারত।

* ঈশিতা দস্তিদার: নৃবিজ্ঞানী

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2025-08-21%2Futif4zhf%2FScreenshot-2025-08-21-215451.jpg?rect=52%2C0%2C536%2C357&w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শিয়ালদহে হিন্দি না বলায় ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মারধর করে হিন্দিভাষী ব্যবসায়ী ও দোকানদাররা। ছবি: সংগৃহীত

No comments

Powered by Blogger.