ইরানের ভুলে আজারবাইজান যেভাবে ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে পড়ল
রাফসানজানি লিখেছেন, ‘বারবার করে বলা তাঁর (আলিয়েভ) একটি মন্তব্য ছিল যে আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ইরানের উচিত আজারবাইজানে তার উপস্থিতি বাড়ানো। মাঝেমধ্যে তিনি এ–ও বলতেন, আজারবাইজান একসময় ইরানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমাদের (ইরান) সেখানে এসে এটিকে (আজারবাইজান) রক্ষা করতে ও নিয়ন্ত্রণ নিতে অনুরোধ করতেন।’ তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইরান যদি আজারবাইজানকে তার প্রভাববলয়ে নিয়ে আসে, তবে তা পুরো ককেশাসে রাশিয়ার আধিপত্যকে নাড়িয়ে দেবে।
৩২ বছর পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আজারবাইজানের কর্মকর্তারা এখন আর বাকুর বিষয়ে তেহরানের সম্পৃক্ততা চান না।
এখন ইরানের রাজনৈতিক নেতারাও এই ছোট প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নেবে তা নিয়ে অনিশ্চিত। আজারবাইজান ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু গোলস্তান (১৮১৩) এবং তুর্কমেনচায় (১৮২৮) চুক্তির মাধ্যমে রুশ সাম্রাজ্যের কাছে হস্তান্তরের আগে এটি একসময় ইরানের অংশ ছিল।
গত দশকে দুটি দেশের (ইরান ও আজারবাইজান) মধ্যে ক্ষমতার গতিশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আজারবাইজানের অনেকে ও দেশটির গণমাধ্যম এখন ইরানেরই কিছু অংশকে আজারবাইজানের সঙ্গে সংযুক্ত করার দাবি তুলছে।
এদিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধ তেহরান ও বাকুর রাজনৈতিক বিভেদকে আরও গভীরতার দিকে নিয়ে গেছে। তেহরানে আজারবাইজানের ইসরায়েলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সামরিক ও গোয়েন্দা সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
ইসরায়েলি ড্রোন কোথা থেকে এল?
ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই ইরানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কাছে বসবাসকারীরা আজারবাইজানের দিক থেকে ইসরায়েলি ড্রোন প্রবেশের খবর দেন। পরবর্তী সময়ে ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমও এই খবর নিশ্চিত করে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে যে তেহরান, তাবরিজ, উরমিয়াসহ বিভিন্ন শহরে ইসরায়েলের হামলায় ব্যবহৃত ড্রোনগুলো আজারবাইজান থেকে ইরানে প্রবেশ করেছিল।
বিষয়টি তখন এতটাই আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে যে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানায় যে তারা বিষয়টি দেখছে। তবে কয়েক দিন পর ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন যে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন যে ইসরায়েল আজারবাইজানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে হামলা চালায়নি।
যদিও এটি ইরানের অনেককে আশ্বস্ত করতে পারেনি। সংবাদমাধ্যম বা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কেউই আজারবাইজানের এ বক্তব্যকে গ্রহণ করেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেহরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন অধ্যাপক বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রেসিডেন্ট উভয়ই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন তার মানে ইরান এটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।
ওই বিশেষজ্ঞের মতে, ইরান যদি আজারবাইজান সীমান্ত থেকে ইসরায়েলের যুক্ত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত না হতো, বিষয়টি এতটা উচ্চপর্যায়ে গুরুত্বসহকারে নেওয়া হতো না।
তিনি আরও যুক্তি দেন যে আলিয়েভের আশ্বাস সম্পর্কে পেজেশকিয়ানের মন্তব্য ককেশাস অঞ্চলে ইরানের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা তুলে ধরে। অধ্যাপক বলেন, ‘পেজেশকিয়ান যা বলেছেন, তা কেবল কূটনৈতিক ভাষা। বাস্তবে শেষ কারাবাখ যুদ্ধের পর থেকে ইরান আজারবাইজানের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করবে তা জানে না। এর পর থেকে আজারবাইজান একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বা অন্তত নিরপেক্ষ দেশ থেকে বরং একটি শান্ত কিন্তু গুরুতর হুমকির দেশে পরিণত হয়েছে।’
তিনি বাকু ও তেল আবিবের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আরও প্রমাণ হিসেবে আজারবাইজানীয় ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন।
ইরানের দোরগোড়ায় ইসরায়েল
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আজারবাইজান প্রথমে ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের কাছাকাছি আসে। পরবর্তী সময়ে দেশটি ইসরায়েলের সঙ্গেও তার সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আজারবাইজান ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে এবং দেশটি উন্নত মানের ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা সরঞ্জাম আমদানি করছে। কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইসরায়েল আজারবাইজানের সামরিক অস্ত্রের প্রায় ৭০ শতাংশ সরবরাহ করেছে।
এখন আজারবাইজান নতুন সিরীয় সরকারের সঙ্গেও কাজ করছে। বাশার আল-আসাদের পতনের পর নতুন সিরীয় সরকার ইরান থেকে সরে এসেছে।
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ককেশাস অঞ্চলে কোনো স্পষ্ট কৌশল না থাকায় ইরান এখন দেখছে যে তেল আবিব তার সীমান্তের দিকে আরও কাছাকাছি আসছে।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন যে ইসরায়েল, সিরিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে একটি নতুন আঞ্চলিক জোট দ্রুতই তুরস্কের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ইরানের দোরগোড়ায় নিয়ে আসতে পারে। একমাত্র বাধা হলো আর্মেনিয়া ও ইরানের মধ্যকার ৪৩ কিলোমিটার স্থলপথ, যার মাধ্যমে আজারবাইজান তার ছিটমহল এলাকা নাখচিভানের সঙ্গে যুক্ত।
২০২০ সালের ৪৪ দিনের কারাবাখ যুদ্ধ থেকে আজারবাইজান ও তুরস্ক উভয়েরই প্রধান দাবি হলো মেগরি বা জাঙ্গেজুর করিডর নামে গিরিপথটা নিয়ন্ত্রণ করা। যদি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে আবার যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে ইরান আশঙ্কা করছে যে এই করিডরটি আজারবাইজানের হাতে চলে যেতে পারে। এ করিডরটি নাখচিভানকে আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
ওই বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন যে আজারবাইজান শুধু ইসরায়েলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হচ্ছে না, বরং এটি ইসরায়েলের সামরিক কৌশলগুলোও অনুকরণ করছে। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আজারবাইজান সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র যুদ্ধকে বেছে নিচ্ছে। এটি তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে সহায়তা করছে। তাই আর্মেনিয়ার সঙ্গে আজারবাইজানের আরেকটি যুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে ইরানের উচিত তার উত্তর-পশ্চিম থেকে সম্ভাব্য সামরিক চাপের জন্য প্রস্তুত থাকা। এমনকি এখনো আমরা আজারবাইজান থেকে ইরানের ভূখণ্ডের কিছু অংশের দাবি নিয়ে জোরালো আওয়াজ শুনছি।’
ইরানের অঞ্চলগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার দাবি
ইরানের তুর্কিভাষী অঞ্চলগুলোকে আজারবাইজানিরা নিজেদের দাবি করার বিষয়টি ইরানি অধ্যাপক উল্লেখ করছিলেন। প্যান-তুর্কিরা এ অঞ্চলগুলোকে ‘দক্ষিণ আজারবাইজান’ হিসেবে উল্লেখ করে। এর মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম আজারবাইজান, আরদাবিল, জাঞ্জান প্রদেশ এবং এমনকি ইরানের কুর্দি অঞ্চলের কিছু অংশও অন্তর্ভুক্ত। বৃহত্তর কুর্দিস্তান ও বৃহত্তর আর্মেনিয়ার সমর্থকেরাও এই একই এলাকার কিছু অংশের দাবি করে।
ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধের পর আজারবাইজানের সংবাদমাধ্যম আরাজনিউজ এক্সে (টুইটার) এ বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহিত করার জন্য একটি প্রচারণা চালায়। ফারসি ও তুর্কি ভাষায় এই প্রচারণায় ইরানের তাবরিজ, আজারবাইজানের বাকু ও তুরস্কের আঙ্কারার তুর্কিদের মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়েছিল।
আজারবাইজানের আরেকটি সংবাদমাধ্যম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে ‘আজেরিদের প্রধান শত্রু’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আজারবাইজানের স্বাধীনতার পরের বছরগুলোতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করা একজন অবসরপ্রাপ্ত ইরানি কূটনীতিক বলেছেন, প্রথম কারাবাখ যুদ্ধের (১৯৮৮-৯৪) পরপরই এই কৌশলগুলো নেওয়া শুরু করেছিল আজারবাইজান।
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, ‘একবার বাকু যখন বুঝতে পারল যে তারা ইরানকে আর্মেনিয়ার সঙ্গে সামরিক সংঘাতে টানতে পারবে না, তখন তারা দ্রুত ইরানের শত্রু ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে পড়ল। এ নিয়ে উদ্বেগ ছিল কিন্তু আজারবাইজানকে সামরিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দিক থেকে কোনো বড় খেলোয়াড় হিসেবে দেখা হয়নি, তাই ইরান তখন আজারবাইজানের প্রতি কোনো স্পষ্ট নীতি গ্রহণ করেনি।’
‘সক্রিয় নিরপেক্ষতা’ নীতি
আজারবাইজান ইসরায়েলের সঙ্গে শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক তৈরি করেছে এবং তেল ও গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে তার অর্থনীতিকে চাঙা করেছে। তবে সাবেক ওই ইরানি কূটনীতিকের মতে, আজারবাইজানের প্রতি ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়নি।
আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার সংঘাতে ইরান ‘সক্রিয় নিরপেক্ষতা’ নীতি গ্রহণ করেছিল, যা এখন বুমেরাং হয়েছে বলে মনে করছেন ওই কূটনীতিক। [সক্রিয় নিরপেক্ষতা হচ্ছে কোনো সংঘাত বা বিরোধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করেই এক পক্ষকে সমর্থন প্রদানের নীতি]
তাঁর মতে, এই তথাকথিত নিরপেক্ষতার মূল্য দিচ্ছে ইরান। এটি হয়তো প্রথমে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল, কিন্তু আজারবাইজান ইসরায়েলের কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে এটি ইরানের ক্ষতি করেছে। বাস্তবে এটি নিরপেক্ষতা ছিল না, এটি ছিল নিষ্ক্রিয়তা।’
ইরান সরকারের দাবি, জাঙ্গেজুর করিডরের বিরোধিতা ছিল আর্মেনিয়ার মাধ্যমে ইউরোপে বাণিজ্যের পথ বজায় রাখার জন্য। এ বিষয়টিকেও ওই কূটনীতিক নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ, ২০২৩ সালের বাণিজ্যবিষয়ক তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ইরান আর্মেনিয়ায় মাত্র ৪১২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং মাত্র ৪৫ মিলিয়ন ডলার আমদানি করেছে।
ইরানের এই কৌশলগত অবস্থান গ্রহণের জন্য দুটি গভীর কারণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি—প্রথমত, এ অঞ্চলে রাশিয়ার স্বার্থের সঙ্গে অটল থাকার তার দীর্ঘদিনের নীতি; দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের তার সীমান্তের খুব কাছাকাছি আসার ভয়।
ওই কূটনীতিক বলেন, ‘ইরানের নেতারা আজারবাইজান থেকে কোনো নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করার আশা করেননি। তাঁরা আরব দেশগুলোতে তাঁদের প্রভাব বিস্তারে মনোযোগ দিয়েছিলেন।’
যদিও তিনি সাম্প্রতিক হামলায় ইসরায়েল আজারবাইজানের আকাশসীমা ব্যবহার করেছে কি না, তা নিশ্চিত করতে অস্বীকার করেছেন, তবে ওই কূটনীতিক বলেছেন যে আজারবাইজানের ইসরায়েল-নির্মিত ড্রোন, নজরদারি প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের প্রভাব এখন কত দূর ছড়িয়েছে তা এখন স্পষ্ট।
তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে ইরানের আজারবাইজানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এটি পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে এবং তেহরানের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টির জন্য ইসরায়েলের জন্য আরেকটি সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে।
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, ‘ইসরায়েল আজারবাইজানের ভূখণ্ড থেকে হামলা চালিয়েছিল কি না তা বড় কথা নয়, আসল সমস্যা হলো ইরান জানে যে তার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এখন দুর্বল। এখন প্রশ্ন হলো, ইরানের উচ্চপদস্থ নীতিনির্ধারকেরা নতুন করে ভাববেন নাকি ‘সক্রিয় নিরপেক্ষতার’ ব্যর্থ নীতির পথেই হাঁটবেন।’
*মিডল ইস্ট আইয়ের বিশ্লেষণ। ইংরেজি থেকে অনুবাদ
![]() |
| নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চলে আজারবাইজানীয় সেনাদের সামনে ভাষণ দিচ্ছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ। ২০২৩ সালের নভেম্বরে। ছবি: এএফপি |

No comments