‘বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক’ ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় আসলে কী করছে

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিজেদের ‘বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক সেনাবাহিনী’ বলে দাবি করে। কিন্তু তারা প্রায় নিয়মিত যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষক ও গাজায় কাজ করা চিকিৎসকেরা।

বিশ্লেষকদের মতে, ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা, নির্যাতন ও নির্বিচার আটক করা নতুন কিছু নয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর অমানবিক আচরণ, সেনাবাহিনীতে চরম ডানপন্থী মতাদর্শের অনুপ্রবেশ এবং জবাবদিহির অভাব ইসরায়েলি সেনাদের এমন অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে যে তাঁরা কোনো কারণ ছাড়াই যা খুশি তা–ই করতে পারছেন।

আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এরেলা গ্রাসিয়ানি বলেন, ‘আমার কাছে এটা একেবারে নতুন একটি ঘটনা। আগেও পাথর ছোড়ার দায়ে সেনারা শিশুদের মারধর বা আটক করেছে। কিন্তু এবার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন।’

২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের ওপর লেখালিখি করেছেন এরেলা। সেসব লেখায় তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে সেনাদের মধ্যে নৈতিক ‘অসাড়তা’ তৈরি হয়েছিল।

এরেলা বলেন, ‘আগে অন্তত কিছু নিয়মকানুন ছিল, যদিও সব সময় তা মানা হতো না। কিন্তু এখন সেটুকুও নেই।’

যুদ্ধ যেন খেলা

গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাদের বর্বরতা নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

অনেক ইসরায়েলি সেনা বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও পোস্ট করেছেন। সেসব ভিডিওতে দেখা গেছে, সেনারা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর তল্লাশি করছেন। ঘরে থাকা নারীদের পোশাক পরছেন, এমনকি তাঁদের অন্তর্বাস নিয়ে মজা করছেন।

এমন অভিযোগও রয়েছে যে সেনারা লক্ষ্যভেদ অনুশীলনের জন্য বেসামরিক মানুষদের গুলি করেছেন। আবার কখনো কেবল একঘেয়েমি কাটানোর জন্য গুলি করেছেন।

ইসরায়েলি সেনাদের হাতে গাজায় শিশু হত্যার কিছু ঘটনার অনুসন্ধান করেছে বিবিসি। আগস্টের শুরুতে এ ধরনের ১৬০টি ঘটনা যাচাই-বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ৯৫টি শিশুকে মাথায় কিংবা বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আর এসব ঘটনায় শুধু আহত করার জন্য গুলি করা হয়েছে বলার কোনো সুযোগ নেই।

আরও অভিযোগ আছে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোতে জমায়েত হওয়া বেসামরিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করছেন ইসরায়েলি সেনারা। লক্ষ্যভেদ অনুশীলনের জন্য এসব মানুষকে ব্যবহার করছেন তাঁরা।

যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন নিক মেইনার্ড গত জুলাইয়ে তৃতীয়বারের মতো গাজা থেকে ফিরেছেন। তিনি বলেন, এসব ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রকে আসলে মৃত্যুফাঁদ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।

নিক বলেন, ফাউন্ডেশনের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে একটি পরিবারের জন্য কয়েক দিনের পর্যাপ্ত খাবার থাকে। কিন্তু কেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষায় থাকা হাজারো মানুষের জন্য থাকে না। তারা হঠাৎ অপেক্ষমাণ মানুষের জন্য ত্রাণকেন্দ্রের ফটক খুলে দেয় এবং বিশৃঙ্খলা, মারামারি, এমনকি দাঙ্গা বাধতে দেয়। পরে এই অজুহাতে ভিড়ের মধ্যে গুলি চালায়।

নাসের হাসপাতালের চিকিৎসক এবং জরুরি চিকিৎসাকর্মীদের কাছে গুলির ধরন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই হাসপাতালেই কাজ করতেন নিক মেইনার্ড। তিনি বলেন, ‘আমি ১২ বছর বয়সী একটি শিশুর অস্ত্রোপচার করছিলাম, যে পরে মারা গেছে।’

নিক বলেন, ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে শিশুটি গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। পরে এ বিষয়ে জরুরি বিভাগে আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি আমাকে বলেন, তিনি ও অন্য চিকিৎসাকর্মীরা বারবার উন্ড গ্রুপিং বা একই ধরনের ক্ষতের স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছেন।’

উন্ড গ্রুপিং বলতে বোঝানো হচ্ছে, কোনো একদিন বহু মানুষ শরীরের একই স্থানে একই ধরনের ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে এলেন। আবার পরদিন আরও বেশ কিছু মানুষ এলেন শরীরের অন্য অংশে একই ধরনের ক্ষত নিয়ে।

নিক মেইনার্ডের ধারণা, এর অর্থ হলো ইসরায়েলি স্নাইপাররা হয়তো খেলার ছলে, নয়তো নিজেদের নিশানা আরও শাণিত করার জন্য সাধারণ নাগরিকদের ব্যবহার করছেন। এ কথা তিনি আগেও স্কাই নিউজকে বলেছিলেন।

দায়বদ্ধতা নেই, নেই নিয়ন্ত্রণ

২০২৪ সালের জুলাইয়ে ইসরায়েলি সাময়িকী ‍+৯৭২-এর এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচার গুলি চালাতে সেনাদের প্রায় কোনো বিধিনিষেধই ছিল না।

গাজায় মাসের পর মাস দায়িত্ব পালন করা এক ইসরায়েলি সেনা ‍+৯৭২ সাময়িকীকে বলেন, ‘পুরোপুরি স্বাধীনতা ছিল। এমনকি যদি কোনো রকম হুমকি আছে বলে মনে হয়, তবে ব্যাখ্যার দরকার নেই—তুমি সরাসরি গুলি চালাতে পারো। আকাশে নয়; বরং তাদের শরীরের মূল অংশে গুলি চালানোর অনুমতি আছে।’

নাম গোপন রাখার শর্তে ওই সেনা আরও বলেন, সবাইকে গুলি করার অনুমতি আছে—হোক সে মেয়েশিশু কিংবা বৃদ্ধা।

অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্সের (এওএভি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে গাজা ও পশ্চিম তীরে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সেনাবাহিনী যে ৫২টি ঘটনার তদন্ত শুরু করেছিল, তার ৮৮ শতাংশই থমকে গেছে বা দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

এওএভি জানায়, এই ৫২টি ঘটনায় ১ হাজার ৩০৩ মানুষ নিহত ও ১ হাজার ৮৮০ জন আহত হন। এ ছাড়া আরও দুজন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অথচ এত অভিযোগের মধ্যে মাত্র একজন দোষীকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এমনকি কোনো ঘটনার ভিডিও প্রমাণ থাকলেও জনমতের চাপ এবং মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শেষ পর্যন্ত দায়মুক্তি দেওয়া হতো। যেমন ইসরায়েলি এস্দি তাইমান নামে একটি কারাগারে এক ফিলিস্তিনি বন্দীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ভিডিও প্রমাণ থাকার পরও দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ নতুন নয়। ১৯৬৭ সালেই নাবলুস কারাগারে বন্দীদের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতনের নথিপত্র প্রকাশ করেছিল রেড ক্রিসেন্ট।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাদের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি অমানবিক ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি আরও তীব্র হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, ইসরায়েলি সেনারা এখন ফিলিস্তিনিদের মানুষই মনে করেন না।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে নিয়ে লেখা ‘অ্যান আর্মি লাইক নো আদার’ বইয়ের লেখক হাইম ব্রেসশিথ বলেন, এটি ঠিক এমন যেন একটা তুষারের গোলা পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, যার কোনো শেষ নেই।

হাইম বলেন, বছর বছর সহিংসতা আরও বাড়ছে। সাধারণ মানুষকে নিশানা হিসেবে ব্যবহার করাটা এখন ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে স্বাভাবিক একটা বিষয়।

ইসরায়েলের পদাতিক বাহিনী সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই লেখক বলেন, এটা নতুন একধরনের খেলা, রক্তের খেলা। আর এমন খেলা সব সময় নিচ থেকে শুরু হয়।

হাইম বলেন, এটা বিকৃত, খুনে স্বভাব আর ভীষণ অসুস্থ মানসিকতার প্রকাশ।

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল সেনাবাহিনীর অভিযান
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল সেনাবাহিনীর অভিযান। ফাইল ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.