মিয়ানমার: যুবহীন একটি দেশ

২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে চলমান অস্থিরতা মিয়ানমারের যুবসমাজকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। সশস্ত্র সংঘাত, কর্মসংস্থানের অভাব, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জোরপূর্বক নিয়োগ, নিরাপত্তাহীনতা এবং অব্যবস্থাপনা-বিপুল সংখ্যক তরুণকে দেশ ত্যাগে উৎসাহিত করেছে। যার ফলে দেশটি ভবিষ্যতে তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

প্রথম ঢেউ
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর, দেশজুড়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। দাবি ছিল জান্তা সরকারকে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের বিরুদ্ধে শাসকগোষ্ঠীর নৃশংস দমন-পীড়নের জেরে শত শত মানুষ নিহত বা গুরুতর আহত হয়, যাদের বেশিরভাগই তরুণ। হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে কারাগারে আটক করা হয় এবং কিছু মানুষকে নির্যাতনের পর মৃত্যুদণ্ড দেয় জান্তা। হাজার হাজার তরুণ জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়ার জন্য তাদের বাড়িঘর ছেড়েছিল, আবার অনেকে নিরাপত্তা এবং উন্নত সুযোগের সন্ধানে দেশ ছাড়ে। ২৬ বছর বয়সী এক তরুণ, যিনি ২০২৪ সালে সেনাবাহিনীর নিয়োগ এড়াতে ইয়াঙ্গুন থেকে ব্যাংককে পাড়ি জমান। তিনি বলছেন- অভ্যুত্থানের আগে প্রচুর তরুণ ছিল। এখন আমি আমার রাস্তায় আমার বয়সী কোনো লোক দেখতে পাই না। জান্তা সরকার অভ্যুত্থান-বিরোধী সমাবেশগুলোকে  ব্লক করার জন্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেস বন্ধ করে দেয়, যার ফলে অনলাইন পরিষেবার উপর নির্ভরশীল ব্যবসাগুলো ব্যাহত হয় এবং দেশের ব্যাংকিং কার্যক্রম মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। কিছু সময়ের জন্য, মানুষ আর এটিএম থেকে নগদ টাকা তুলতে পারত না। যার ফলে ব্যাংকগুলোতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় এবং অর্থনীতি শীঘ্রই ধসে পড়ে। দেশে দুর্দশার কারণে শীঘ্রই অনেক, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা বিদেশে কাজ এবং আরও ভালো সুযোগের সন্ধানে দেশ ছাড়তে শুরু করে। দেশ ছাড়া  তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনেকে এখন জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ায় কাজ করছে। বিশেষ করে কৃষি, নির্মাণ এবং পরিষেবা শিল্পে।
অভ্যুত্থানের পরের বছরগুলোতে, প্রায় ৩৫,০০০ তরুণ কোরিয়ায় কাজ করার জন্য প্রতি বছর ঊচঝ-ঞঙচওক পরীক্ষায় অংশ নেয়। জান্তার শ্রম মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ আইন কার্যকর হওয়ার পর, এই সংখ্যা বেড়ে ১০০,০০০-এরও বেশি হয়ে যায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় অংশ কাজ করার জন্য থাইল্যান্ডে পালিয়ে গেছে। থাইল্যান্ডের শ্রম অধিকার কর্মী কো থার কিয়াওর মতে, এখন থাই সীমান্তবর্তী এলাকার প্রায় প্রতিটি স্কুলে মিয়ানমারের শিক্ষার্থী রয়েছে।
প্রতিকূল পরিবেশ
দেশে ফিরে, অনেক তরুণ শহরাঞ্চলে গোপনে  প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।  যার ফলে জান্তা প্রধান শহরগুলো- ইয়াঙ্গুন, মান্দালয় এবং নেপিদোয় বাঙ্কার ফাঁড়ি তৈরি করে এবং চেকপয়েন্ট স্থাপন করে নিরাপত্তা জোরদার করতে শুরু করে। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা পথচারীদের ব্যাগ, মানিব্যাগ, স্মার্টফোন, এমনকি তাদের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট বা কথোপকথন পরীক্ষা করে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে অথবা সন্দেহজনক কিছু পেলে তাদের গ্রেপ্তার করে। এই প্রতিকূল পরিবেশ আরও বেশি তরুণ-তরুণীকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে। গত বছর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মিয়ানমার যুব জরিপ অনুসারে, মিয়ানমারে থাকা তরুণদের প্রায় ২৫.১ শতাংশ জাপানে, ১৭.৬ শতাংশ থাইল্যান্ডে, ১৭.১ শতাংশ দক্ষিণ কোরিয়ায় এবং বাকিরা সিঙ্গাপুর,  যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ইউরোপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসন করতে চেয়েছিল। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে প্রায় ৫৩ শতাংশের অভিবাসনের সম্ভাবনা ছিল, যা মেধা পাচারের গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করেছে।
দ্বিতীয় ঢেউ
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে, শাসকগোষ্ঠী সেনায়  নিয়োগ আইন কার্যকর করে।  যার ফলে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সকল পুরুষ এবং ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী সকল নারীকে দুই বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে তরুণদের মধ্যে একটা বড় অংশ দেশত্যাগ করতে শুরু করে। প্রতি মাসে হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যায় এবং আরও অনেকে সশস্ত্র প্রতিরোধে যোগ দেয়। তরুণদের দেশ ত্যাগে বাধা দেওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠী ২৩ থেকে ৩১ বছর বয়সী পুরুষদের বিদেশে কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এমনকি ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ভ্রমণকারীদের বিমানবন্দরে আটকে দেয়। তবুও, হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। তীব্র সৈন্য ঘাটতি মেটাতে জান্তা এখন রাস্তাঘাট, বাস এমনকি বাড়ি থেকে সুস্থ যুবকদের অপহরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি ইয়াঙ্গুন এবং মান্দালয়ের মতো বড় শহরগুলোতেও এই ঘটনা ঘটছে। জান্তার হিসাব অনুযায়ী, গত দেড় বছরে ১৫টি ব্যাচে আনুমানিক ৭৫,০০০ জনকে সামরিক চাকরিতে নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে আনুমানিক ৬০ শতাংশকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং ৩০ শতাংশকে লটারির মাধ্যমে অথবা বেতনভুক্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিরোধে যোগদানকারী সহকর্মীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এই তরুণ সৈন্যদের সামনের সারিতে পাঠানো হয়। ইয়াঙ্গুনের একজন বাসিন্দা দ্য ইরাবতীকে জানিয়েছেন , সামরিক বাহিনীতে যোগদান এড়াতে  আমার ২১ বছর বয়সী ভাগ্নে  কাজের সন্ধানে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া চলে যায়। সামরিক বাহিনীতে যোগদান এড়াতে  তার   ২০ বছর বয়সী ওপর এক ভাগ্নেকে পড়াশোনার জন্য থাইল্যান্ড যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, প্রতিবেশী একটি পরিবারও থাইল্যান্ডে স্থানান্তরিত হয়েছে। তাদের  এক  ছেলের  সেনাবাহিনীতে যোগদানের বয়স হয়ে গিয়েছিলো।  তার পরিচিত ২২ বছর বয়সী ওপর এক যুবক কারেন রাজ্যে একটি প্রতিরোধ গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে।
শ্রমিকের ঘাটতি
ইয়াঙ্গুনের একটি পোশাক কারখানার প্রধান বলেন, যখন থেকে সেনায়  বাধ্যতামূলক যোগদান আইন কার্যকর করা হয়েছে, তখন থেকে আমার কারখানায় কোনো যুবককে দেখিনি। তারা  বিদেশে পালিয়ে গেছে।  আমরা ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী যুবকদের আকর্ষণীয় বেতন দেই, কিন্তু লোকেরা কেবল অল্প সময়ের জন্য থাকে এবং তারপর বিদেশে চলে যায়। ইয়াঙ্গুনের আরেক বাসিন্দা কো থান্ট জিন বলেন, ইয়াঙ্গুন শপিং মলে অনেক দোকান চাকরির জন্য শূন্যপদ ঘোষণা করছে। যা থেকে বিষয়টি স্পষ্ট । জিন বলছেন, নিয়োগ আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে, যে গ্যারেজে আমি আমার গাড়ি মেরামত করি সেখানেও তীব্র শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক কর্মী নিয়োগ এড়াতে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, আবার অনেকে ভালো বেতনের চাকরির জন্য চলে গেছেন। কখনও কখনও আমাকে গাড়ি মেরামত না করেই বাড়ি ফিরে যেতে হয় কারণ সেখানে কোনও মেকানিক নেই। এই বছর শ্রমিক দিবসে এক চিঠিতে জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং স্বীকার করেছেন যে, ব্যাপক অভিবাসনের কারণে দেশটি শ্রমিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। ইরাবতী অঞ্চলের লাবুত্তা টাউনশিপের একজন কৃষক বলেছেন, এই বছর আমরা অর্ধেক কর্মী হারিয়েছি, সম্ভবত বাধ্যতামূলক নিয়োগ আইন বা অন্যান্য কারণে। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে বেশিরভাগ তরুণ আর দেশে নেই। এর অর্থ কৃষিকাজে দ্বিগুণ সময় লাগছে  এবং ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। ৩১ বছর বয়সী একজন নারী  অফিস কর্মী জানাচ্ছেন, ইয়াঙ্গুনে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে সাধারণ মানুষ এখন সন্ধ্যা ৭টার পরেও ঘরে বসে থাকে। কনসক্রিপশন আইন এবং  নিরাপত্তার অভাবের কারণে। প্রতিটি পরিবার তাদের প্রিয়জনদের নিরাপদে বাসায় ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করতে থাকে। তবুও ইয়াঙ্গুনের বার এবং নাইটক্লাবগুলোতে প্রায়শই ধনী এবং বিত্তশালী ব্যক্তিদের আনাগোনা লেগে থাকে। তবে আশার কথা একটাই -ইউএনডিপি জরিপে দেখা গেছে যে ৯০ শতাংশ তরুণ যারা চলে যেতে ইচ্ছুক ছিল তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে বাসায়  ফিরে আসতে ইচ্ছুক।
সূত্র :  দ্য ইরাবতী

https://mzamin.com/uploads/news/main/177390_my....webp

No comments

Powered by Blogger.