গাজায় সাংবাদিক হত্যায় বিশ্বজুড়ে নিন্দা

সমস্ত আইনকানুনকে উপেক্ষা করে গাজায় আগ্রাসী হামলায় আল জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল শরীফ ও তার চার সহকর্মীর মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। রোববার নিহতদের জানাজা সম্পন্ন হয়। এরপর শত শত শোকসন্তপ্ত মানুষ তাদের মৃতদেহ কাঁধে তুলে গাজা সিটির রাস্তায় নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ খবর দিয়েছে লন্ডনের অনলাইন গার্ডিয়ান। এভাবে সাংবাদিকদের হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। এর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক পরিচালক সারা কুদাহ বলেন, বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়া সাংবাদিকদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেওয়ার ইসরাইলি প্রবণতা তাদের উদ্দেশ্য ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস আনাস আল শরীফ হত্যাকে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর স্বীকারোক্তিমূলক হত্যা বলে এর নিন্দা জানিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে।

বৃটিশ লেবার পার্টির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের এক মুখপাত্র বলেন, গাজায় সাংবাদিকদের উপর বারবার হামলায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সংঘাত কভার করা সাংবাদিকরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে সুরক্ষিত। জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস এই হামলাকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে।
সোমবার আনাস আল শরীফের জানাজায় বন্ধু, সহকর্মী ও স্বজনরা তার মৃতদেহকে আলিঙ্গন করে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। অন্য সাংবাদিকরা কাঁদতে কাঁদতে জানাজা ও সমাধিস্থল থেকে প্রতিবেদন করেছেন, কেউ ছবি তুলেছেন, কেউ সরাসরি সম্প্রচার করেছেন।

ফিলিস্তিন টিভি ও আরব চ্যানেলের সংবাদদাতা ইসলাম আল-জা’আনুন বলেন, এটি সাংবাদিকতার জগতে এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। আল জাজিরার উপস্থাপক বিলাল আবু খলিফা জানান, আনাস আল শরীফ তাকে চার দিন আগে বলেছেন তিনি বিপদে আছেন। কিন্তু গাজা ছাড়বেন না। তিনি বলেছেন, আমি জানি আমি হত্যার তালিকায় আছি। কিন্তু সত্য প্রকাশ করেই যাব। আল জাজিরা আনাস আল শরীফের মৃত্যুর পর তার ৬ এপ্রিলের লেখা শেষ বার্তা প্রকাশ করেছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, আমি কখনও সত্য বিকৃত করিনি বা গোপন করিনি। আল্লাহ সাক্ষী থাকবেন তাদের বিরুদ্ধে যারা নীরব থেকেছে, আমাদের হত্যাকে মেনে নিয়েছে, আর আমাদের গণহত্যা ঠেকাতে কিছুই করেনি।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরাইল আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে যুদ্ধের কভারেজের দায়িত্ব মূলত ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের ওপর। তাদের অনেকেই নিহত হয়েছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। অনেকের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরাইলি হামলায় ২৩৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সিপিজে জানিয়েছে, কমপক্ষে ১৮৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। ওয়াটসন স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধ এবং আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ- সব মিলিয়েও যত সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি। এতে বলা হয়, আল জাজিরার অন্যতম সুপরিচিত মুখ আনাস আল-শরীফ রবিবার রাতে গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে সাংবাদিকদের জন্য নির্মিত একটি তাঁবুর ভেতরে অবস্থান করছিলেন। সেখানে ইসরাইলের হামলায় মোট সাতজন নিহত হন। এর মধ্যে আছেন আল জাজিরার প্রতিবেদক মোহাম্মদ কুরাইকে এবং ক্যামেরা অপারেটর ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নুফাল ও মোয়ামেন আলিওয়া। হামলার সময় পাশের তাঁবুতে ছিলেন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ওয়াদি আবু আল-সাউদ। তিনি জানান রাত ১১টা ২২ মিনিটে বিস্ফোরণটি ঘটে। আমি ফোন বের করতেই বিস্ফোরণ হলো। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম মানুষ আগুনে পুড়ছে। আমি তাদের আগুন নেভানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু আনাস এবং অন্যরা ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

হামলার পরের দৃশ্যের ভিডিওতে দেখা যায়, সাউদ নিহতদের মৃতদেহ বহন করছেন। তিনি জানান, এখন থেকে তিনি আর সংবাদ কভার করবেন না। কারণ ‘সত্যের মৃত্যু হয়েছে, কভারেজ শেষ।’ ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এই হামলার দায় স্বীকার করে দাবি করেছে। তাদের দাবি আনাস আল-শরীফ হামাসের একটি সেলের নেতা। আল জাজিরা এবং আনাস আল শরীফ পূর্বেই এ অভিযোগ ‘অমূলক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। এটি প্রথমবার যে ইসরাইল কোনো সাংবাদিক নিহত হওয়ার পর এত দ্রুত দায় স্বীকার করল।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.