গাজায় ‘গণহত্যার’ প্রমাণ তুলে ধরার কারণেই কি সাংবাদিক আল-শরিফকে হত্যা করল ইসরায়েল
গত রোববার রাতে ইসরায়েল আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান ফটকের কাছে সাংবাদিকদের থাকার জন্য ব্যবহৃত একটি তাঁবুতে ড্রোন হামলা চালায়। হামলায় আল–জাজিরার পাঁচ সংবাদকর্মীসহ সাতজন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মোহাম্মদ আল-খালদি নামে আরেকজন স্থানীয় ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিকও রয়েছেন।
নিহত সাংবাদিকেরা ২২ মাস ধরে গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং সেখানকার বাসিন্দাদের ওপর যুদ্ধের কী প্রভাব পড়ছে, তার প্রামাণ্য দলিল সংগ্রহ করছিলেন। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের সম্ভাব্য গণহত্যার প্রমাণ সংগ্রহ করতে গিয়েই এই সাংবাদিকদের প্রাণ হারাতে হয়েছে।
রোববার রাতের ওই হামলার পর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাবাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, আনাস আল-শরিফকে নিশানা করেই তারা ওই হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, হামাসের একটি সন্ত্রাসী সেলের প্রধান ছিলেন আল-শরিফ।
ইসরায়েলের ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার কয়েক মিনিট আগে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ‘এক্স’–এ একটি পোস্ট দিয়েছিলেন আল-শরিফ। সর্বশেষ ওই পোস্টে তিনি বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে বলেছিলেন, গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার পরিকল্পনা অবরুদ্ধ এ অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠ সম্পূর্ণ রুদ্ধ করার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
শরিফ লেখেন, ‘এই উন্মত্ততা যদি না থামে, গাজা পরিণত হবে ধ্বংসস্তূপে, এখানকার মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে, তাঁদের মুখগুলো মুছে যাবে আর ইতিহাস আপনাদের মনে রাখবে সেই নির্বাক সাক্ষী হিসেবে, যাঁরা এই গণহত্যা বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত বেছে নিয়েছেন।’
২০২৪ সালের মার্চে আল-শিফা হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার সময় মোহাম্মদ কুরেইকেহর মা নিহত হন। তিনি তাঁর মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। কুরেইকেহ দুই সপ্তাহ খোঁজাখুঁজির পর হাসপাতালের একটি সিঁড়িতে পড়ে থাকা অবস্থায় মায়ের মৃতদেহ খুঁজে পান, তত দিনে সেটিতে পচন ধরে গিয়েছিল।
পরে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে কুরেইকেহ জানতে পারেন যে তাঁর মাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
ব্যক্তিগত শোক ও অসহনীয় পরিস্থিতি সত্ত্বেও আল-শরিফ ও কুরেইকেহ গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছিলেন। বিশ্বজুড়ে ক্রমেই এ যুদ্ধ গণহত্যা বলে বিবেচিত হওয়ার দাবি বাড়ছে।
ত্যাগ ও সাহস
গাজার বাকি সব ফিলিস্তিনির মতো আল-শরিফ ও কুরেইকেহ ইসরায়েলি দখলদারির মধ্যেই জন্ম নিয়েছিলেন এবং বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁরা জীবনের বেশির ভাগ সময় দেখেছেন, ইসরায়েল গাজার স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথ সম্পূর্ণ অবরোধ করে রেখেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভাষায়, গাজা কার্যত খোলা আকাশের নিচে এক উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে।
এই অবরোধ ফিলিস্তিনিদের জীবিকা, যাতায়াত, পারিবারিক সম্পর্কসহ জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করেছে। আল-শরিফ ও কুরেইকেহ ইসরায়েলের নির্মম দখলের অধীনে তাঁদের জনগণের জীবনসংগ্রামের গল্প বিশ্বকে জানাতে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
আল-শরিফ গাজার আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া স্টাডিজে লেখাপড়া করেছিলেন এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া ইসরায়েলি সামরিক অভিযান নিয়ে নিজের প্রতিবেদনের জন্য তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। তিনি সেখানে যুদ্ধের মানবিক ও অসামরিক প্রভাব নিয়ে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছিলেন।
গাজার ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ইয়াসের আল-বান্না বলেন, যখন ইসরায়েল ২২ লাখ ফিলিস্তিনিকে গাজার দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল, তখনো আল-শরিফ ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান ও কার্যক্রম নথিভুক্ত করতে গাজার উত্তরাঞ্চলে রয়ে যান।
আল-জাজিরাকে আল-বান্না আরও বলেন, (সে সময়ে উত্তরাঞ্চলে) ইসরায়েলি হামলার কারণে তাঁর জীবন ঝুঁকিতে ছিল। তবু তিনি ইসরায়েলের প্রতিটি হামলার পর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতেন, ইসরায়েলের অপরাধের মুখোশ উন্মোচন করার জন্য।
এ সাংবাদিক আরও বলেন, গত বছর থেকে তিনি কুরেইকেহর সঙ্গে একটি শক্তিশালী পেশাদারি সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
এ সময়ে আল-বান্না গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ও কুরেইকেহ উত্তরাঞ্চলে কাজ করতেন। তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন ও তথ্য বিনিময় করতেন, যেন ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের ফলে গাজায় যে মানবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে আরও বিশদ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা যায়।
কুরেইকেহ সম্পর্কে আল-বান্না আরও বলেন, ‘তিনি আমাকে বা যে কাউকে সাহায্য করতে কখনো একমুহূর্ত দেরি করতেন না। কুরেইকেহ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে, তিনি সব সময় ধৈর্যশীল ও শান্ত স্বভাবের ছিলেন।’
সহকর্মী ও বন্ধু
২০২৪ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল দাবি করেছিল, ফিলিস্তিনি যে ছয়জন সাংবাদিক হামাসের একটি সেলের সঙ্গে সংযুক্ত, তাঁদের একজন আল-শরিফ। ইসরায়েলের এই ভিত্তিহীন দাবি বারবার অস্বীকার করেছে আল-জাজিরা।
আল-শরিফ তখন থেকেই জানতেন যে তাঁর জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসহ (সিপিজে) কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন বলেছে, ইসরায়েল প্রায়ই ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের প্রমাণ ছাড়াই ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে।
জুলাইয়ে সিপিজেকে আল-শরিফ বলেছিলেন, ‘এই সবকিছু ঘটছে, কারণ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি দখলদারি নিয়ে আমার প্রতিবেদন তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং বিশ্বে তাদের যে ভাবমূর্তি রয়েছে, তা শেষ করে দিচ্ছে। তারা আমাকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে, কারণ দখলদারেরা আমাকে নৈতিকভাবে হত্যা করতে চায়।’
ইসরায়েলি হুমকির কারণে গাজায় কেউ কেউ আল-শরিফকে সাক্ষাৎকার দিতে দ্বিধায় থাকতেন। তাঁদের ভয় ছিল যে ইসরায়েল যেকোনো সময় আল-শরিফের ওপর হামলা চালিয়ে তাঁকে ও তাঁর আশপাশের সবাইকে হত্যা করতে পারে।
সাক্ষাৎকার দিতে দ্বিধান্বিত হলেও বেশির ভাগ মানুষ আল-শরিফের সাহসের প্রশংসা করেছেন এবং ঝড়ের কেন্দ্রে (মূল যুদ্ধক্ষেত্রে) থেকে যুদ্ধের খবর মানুষের সামনে তুলে ধরার সাহস দেখানোর জন্য তাঁকে সমর্থন করে গেছেন।
আল-বান্না বলেন, কুরেইকেহ ঝুঁকির কথা জানতেন। তবু তিনি আল-শরিফের সঙ্গে কাজ চালিয়ে গেছেন। তাঁদের দুজনের সম্পর্ক খুব দৃঢ় ছিল।
শরিফ–কুরেইকেহ দুজনই জানতেন যে ইসরায়েলের বোমায় যেকোনো সময় তাঁরা প্রাণ হারাতে পারেন। এমনকি আল-শরিফকে যাঁরা চিনতেন, তাঁদের বেশির ভাগই এ ঝুঁকির বিষয়টি তাঁদের জানা ছিল বলে স্বীকার করেন।
আল-বান্না বলেন, ‘গাজার সাংবাদিকেরা আল-শরিফের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন। একসঙ্গে বাঁচব, নাহয় একসঙ্গে মরব, এই সত্যকে আমরা স্বীকার করে নিয়েছিলাম।’
মশাল হাতে নেওয়া
কাতারের দোহার আল-জাজিরা স্টুডিও থেকে তাঁদের সহকর্মী তামের আলমিশাল বলেন, মৃত্যুর আগে নিরবচ্ছিন্নভাবে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আল-শরিফ ও কুরেইকেহ দুজনই মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের ফোন বন্ধ করার সুযোগ বলতে গেলে পেতেনই না। কারণ, ইসরায়েল এত এত মানুষকে হত্যা করছিল যে তাঁরা প্রতিমুহূর্তে সজাগ থেকে নিজেদের মানুষদের হত্যাযজ্ঞের খবর জানাতেন।
আলমিশাল বলেন, ‘এটাকেই সাংবাদিকতা বলে। তাঁরা সাংবাদিকতার আদর্শ। আনাসের মৃত্যুর পর আমি একটি অঙ্গীকার করছি, আমরা দায়িত্বশীলতা ও পূর্ণ পেশাদারত্বের সঙ্গে তাঁদের বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া অব্যাহত রাখব।’
গাজার সব সাংবাদিক এ মনোভাব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরা একাকী ইসরায়েলের গণহত্যা খবর বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বভার বহন করে যাচ্ছেন।
৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে এবং গাজায় প্রায় ২৭০ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীকে হত্যা করেছে।
গাজার ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সালেহ জাফর (২৮) তাঁর সহকর্মীদের স্মৃতিকে জীবিত রাখার প্রতিজ্ঞা করছেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল সংবাদমাধ্যমকে তাদের লক্ষ্যবস্তু করছে, যাতে বিশ্ব গাজায় তাদের অপরাধ বিষয়ে কিছু জানতে না পারে।
কিন্তু ইসরায়েল কোনো দিন তাঁদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিতে পারবে না বলে শপথ করে সালেহ জাফর বলেন, ‘তারা আমাদের সবাইকে নীরব করতে পারবে না। গাজায় আনাসের মতো আরও ১০ লাখ কণ্ঠ আছে, মোহাম্মদের মতো ১০ লাখ কণ্ঠ আছে। ইসরায়েলের সন্ত্রাস ও হুমকির মুখেও আমরা আমাদের কণ্ঠস্বর ও ভিডিও প্রচার অব্যাহত রাখব।’
| ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ। ছবি: শরীফের এক্স থেকে নেওয়া |
No comments