গাজায় হামলার নিন্দা জানালেও ইসরায়েলের সঙ্গে কেন বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে এসব দেশ

কখনো বিমান হামলা করে, কখনো অভুক্ত রেখে, কখনো তিলে তিলে, আবার কখনো দ্রুত—সব রকমভাবে অব্যাহতভাবে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে চলেছে ইসরায়েল। এর মধ্যেই ২৮টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধের অবসানের দাবিতে একটি বিবৃতি স্বাক্ষর করেছেন।

জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংস্থা গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা জানানোর কয়েক মাস পর এখন এসব দেশ কেবল বিবৃতি দিচ্ছে। কিন্তু সংকট সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

যেসব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন, সেসব দেশের কয়েকটি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। গত সপ্তাহে ফ্রান্সও ঘোষণা দিয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বরে দেশটি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এ ঘোষণায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।

তবে সমালোচকেরা বলছেন, এসব দেশ মুখে যতই ইসরায়েলের সমালোচনা করুক না কেন, তারা এখনো ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্য করে লাভবান হচ্ছে। তারা ইসরায়েলের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি বা এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যা ইসরায়েলকে গাজায় গণহত্যামূলক যুদ্ধ বন্ধে বাধ্য করতে পারে।

এখন পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার ও নৃশংস হামলায় অন্তত ৫৯ হাজার ৮২১ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৭ জন।

জেনে নেওয়া যাক, কোন দেশগুলো ইসরায়েলকে একদিকে তাদের সামরিক আগ্রাসনের জন্য দোষারোপ করছে, অন্যদিকে তাদের সঙ্গে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

তথ্যভিত্তিক উন্মুক্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির (ওইসি) ২০২৩ সালের তথ্যানুসারে, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য—প্রতিটি দেশ ওই বছর ইসরায়েলের সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের বেশি আমদানি-রপ্তানি বা উভয় ধরনের বাণিজ্য করেছে।

এসব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কী ধরনের বাণিজ্য করে

এসব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে প্রধানত গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহন, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (চিপ), টিকা ও সুগন্ধির মতো বিভিন্ন পণ্য বাণিজ্য করে।

ইসরায়েল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব পণ্য রপ্তানি করে, সেগুলোর একটির নাম ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট। এগুলো আসলে ছোট আকারের চিপ, যা কম্পিউটার, মুঠোফোন, টেলিকম যন্ত্রপাতি, মেডিকেল ডিভাইসসহ নানা ইলেকট্রনিক পণ্যে ব্যবহৃত হয়।

এই চিপগুলোর একটি বিশাল অংশ আয়ারল্যান্ডে রপ্তানি হয়। শুধু ২০২৩ সালে দেশটিতে প্রায় ৩৫৮ কোটি ডলার মূল্যের ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট রপ্তানি করেছিল ইসরায়েল। আয়ারল্যান্ড ইসরায়েল থেকে মোট যত পণ্য আমদানি করে, তার মধ্যে এই চিপই সবচেয়ে বেশি দামে এবং বেশি পরিমাণে আমদানি করা হয়।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে ইসরায়েলে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে ইতালি।

২০২৩ সালে ইসরায়েলে মোট ৩৪৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ইতালি। এর মধ্যে গাড়ি রপ্তানি করা হয় ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলারের।

এসব দেশ কি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে আয়ারল্যান্ড ও স্পেন ২০২৪ সালে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু এরপরও তারা ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করেনি।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী আরও সাতটি দেশ ১৯৮৮ সালেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এসব দেশ হলো সাইপ্রাস, মাল্টা ও পোল্যান্ড। তারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই স্বীকৃতি দিয়েছিল।

এ ছাড়া আইসল্যান্ড ২০১১ সালে, সুইডেন ২০১৪ সালে এবং নরওয়ে ও স্লোভেনিয়া ২০২৪ সালে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফ্রান্স বলেছে, তারা আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে স্বীকৃতি দেবে।

কোন কোন দেশ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, সাইপ্রাস, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, জাপান, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য।

সবগুলো দেশই এখনো ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

ইসরায়েল বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় কী বলেছে

স্বাভাবিকভাবেই ইসরায়েল বিবৃতিটি প্রত্যাখ্যান করেছে।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওরেন মারমোরস্টেইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, ‘ইসরায়েল এই বিবৃতিকে বাস্তবতা বিবর্জিত বলে মনে করে। এটি হামাসকে ভুল বার্তা দিচ্ছে।

ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য করা দেশগুলো আর কী করছে

ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য এক জরুরি বৈঠকে গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সব বন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছে। তারা গাজায় ইসরায়েলের অবরোধের ফলে সৃষ্ট খাদ্যসংকট নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এসব চাপের ফলে ইসরায়েল কি বদলেছে

গাজায় ফিলিস্তিনিদের অনাহারের বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিকভাবে খুব আলোচিত। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের মতো ইসরায়েলপন্থীরাও এখন এ বিষয়ে কথা বলছেন।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরায়েল আল-মাওয়াসি, দেইর আল-বালা ও গাজা শহরে ‘মানবিক উদ্দেশ্যে’ প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গাজায় ‘কৌশলগত বিরতি’ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটি গত রোববার থেকে কার্যকর হয়েছে।

তবে এই বিরতির মধ্যেও রোববার সকালে ইসরায়েলি বাহিনী অন্তত ৪৩ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রোববার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অনাহার ও অপুষ্টিতে আরও ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে দুজন শিশু।

এ নিয়ে গাজায় অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৩৩ জনে, যার মধ্যে ৮৭টি শিশু।

গাজা উপত্যকার কেন্দ্রীয় অংশে অবস্থিত বুরেইজ শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি হামলার পর পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে একটি শিশু
গাজা উপত্যকার কেন্দ্রীয় অংশে অবস্থিত বুরেইজ শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি হামলার পর পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে একটি শিশু। ফাইল ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.