আলহামরা: স্পেনে মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন by মো. রাশেদুল আলম
ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিক কথা—
গ্রানাডা শহর থেকে দূরে একটি মালভূমিতে নির্মিত আলহামরা তখন গ্রানাডার গভর্নর মুহাম্মেদ ইবনে আল আহমার, তিনিই আলহামরা নির্মাণের প্রদর্শক ও নাসরিদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। প্রধানত ১২৩৮ থেকে ১৩৫৮ সালের মধ্যে, ইবনে আল-আহমার ও তাঁর উত্তরসূরিদের শাসনামলে নির্মিত হয় আলহামরা। অভ্যন্তরের চমৎকার অলংকরণগুলো নির্মাণ করেন প্রথম ইউসুফ (মৃত্যু ১৩৫৪)। ১৪৯২ সালে মুরদের পরাজয়ের পর, অভ্যন্তরটির বেশির ভাগ অংশ বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং মূল্যবান আসবাব ধ্বংস বা অপসারণ করা হয়। স্পেনের শাসক চার্লস পঞ্চম (১৫১৬-৫৬) একটি ইতালীয় প্রাসাদ নির্মাণের জন্য আলহামরার কিছু অংশ খুলে নিয়ে যান। ১৮১২ সালে আলহামরার কয়েকটি টাওয়ার ফরাসি বাহিনী উড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাকি ভবনগুলো অল্পের জন্য রক্ষা পায়। ১৮২১ সালের ভূমিকম্পে কমপ্লেক্সের আরও ক্ষতি সাধিত হয়।
আলহামরা বিরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আলয়ে অবস্থিত। যে মালভূমিতে এটি নির্মিত, সেটি গ্রানাডার মুরিশ মুসলিমদের পুরোনো শহর। মালভূমির গোড়ায় দারো নদী উত্তরে গভীর খাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। প্রাসাদের বাইরের উদ্যানটি মুররা গোলাপ, কমলা ও চিরহরিৎ বৃক্ষ রোপণ করে সাজিয়েছিল। উদ্যানের নিচের প্রবেশদ্বার, বাংলায় বলা যায় ডালিমের গেট, ১৬ শতকে তৈরি বিশাল বিজয়ের খিলান। ১৫৫৪ সালে তৈরি করা হয়েছিল, আলহামরার প্রধান প্রবেশদ্বার। আরও একটি বর্গাকার টাওয়ার ঘোড়ার নালের মতো খিলানপথ, যা মুররা বিচারের স্থান বা আদালত হিসেবে ব্যবহার করত।
অভ্যন্তরে সিংহাসন কক্ষ বা ‘হল অব দ্য অ্যাম্বাসেডরস’ আলহামরার বৃহত্তম কক্ষ। কক্ষটি ৩৭ ফুট এবং শীর্ষে একটি গম্বুজ, যার কেন্দ্র ৭৫ ফুট উচ্চ। বিশাল অভ্যর্থনাকক্ষ এবং সুলতানের সিংহাসনটি প্রবেশদ্বারের বিপরীতে স্থাপন করা হয়েছিল। গ্রানাডার শেষ সুলতান বোবদিল এই কক্ষে একটি ভোজসভায় আমন্ত্রিত অতিথিদের গণহারে হত্যা করেছিলেন। সিলিংটি নীল, বাদামি, লাল এবং সোনায় চমৎকারভাবে সজ্জিত। হলের মাঝখানে একটি ফোয়ারা এবং পুরো কক্ষটি উপদেশমূলক বাক্য ও কোরআনের সুরায় উৎকীর্ণ মুরিশ স্ট্যালাকটাইটের কাজের একটি অসামান্য উদাহরণ। এ ছাড়া আলহামরায় রয়েছে তিনটি প্যালেস, প্যালেস অব লায়ন্স, পোর্টাল প্যালেস ও কোমারেস প্যালেস। রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা, হল অব দ্য কিংস, কোর্ট অব লং পন্ডস, কোর্ট অব মিরলেস ইত্যাদি।
স্পেনে মুসলিম সভ্যতা ও স্থাপনাগুলো দেখার ইচ্ছা ছিলো স্কুলজীবন থেকেই। বিশেষ করে আলহামরা। বছর কয়েক আগে মুসলিম সভ্যতায় উদ্ভাসিত ঐতিহাসিক টলেডো দেখে এসেছি। টলেডোকে বলা হয় ‘স্পেনের আত্মা’। পবিত্র জেরুজালেম নগরীর পরই টলেডোর স্থান, যেখানে খ্রিষ্টান, ইহুদি ও মুসলিম সম্প্রদায় পাশাপাশি বাস করে টলেডোকে ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে গেছেন। ভোর ছয়টায় স্টকহোম থেকে উড়াল দিয়ে আন্দালুসিয়ার প্রধানতম বিমানবন্দর মালাগায় এসে যখন নামলাম, তখন সকাল সাড়ে ১০টা বেজে গেছে। সঙ্গে খুব একটা লাগেজ নেই, শুধু দুজনার দুটি ব্যাগ। দ্রুত ইমিগ্রেশন পার হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেই আমাদের গাইডের সঙ্গে দেখা হলো। ৪০–৪২ বছর বয়েসের সুঠাম দেহি এক নারী আনিকা এলওইং। আনিকা জন্মগতভাবে সুইডিশ তবে ২৩ বছর ধরে স্পেনেই বসবাস, তাই সুইডিশ ও স্প্যানিশ—দুটি ভাষাতেই দক্ষ। স্পেনে ভাষাগত অসুবিধে ব্যাপক। স্প্যানিশরা স্প্যানিশ ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় বলে না বোঝেও না, ইংরেজি তো নয়ই। স্কুল–কলেজে সরকারিভাবে স্প্যানিশ ভাষাটিই শিক্ষা দেওয়া হয়, ইংরেজি নয়। ইংরেজি শিখতে হলে প্রাইভেট শিখতে হয় আর তা ব্যয়বহুল বলে স্প্যানিশরা এড়িয়ে গেছে। রাস্তাঘাটের দিকনির্দেশনাগুলোও স্প্যানিশ ভাষায়, বোঝার উপায় নেই তাই আনিকাই আমাদের ভরসা।
মালাগা থেকে দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা ট্যুরিস্ট বাস যাত্রার পর এলাম ঐতিহাসিক গ্রানাডায় আমাদের নির্ধারিত হোটেলে। ঝকঝক তকতকে বিশাল কামরা। উষ্ণ সাওয়ার নিতে নিতেই আলহামরা দেখার সময় হয়ে এল। দীর্ঘ প্লেন–যাত্রার জন্যই হোক বা অন্য উপসর্গ হোক ডান দিকের পায়ে পেইন অনুভব করছিলাম। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল। শুনেই আনিকা ছুটে এলেন। ট্যাক্সি নিয়ে ছুটে গেলাম ফার্মাসিস্টের কাছে। আনিকা স্প্যানিশ ভাষায় সব বুঝিয়ে বলার পর ফার্মাসিস্ট একটি ইলাস্টিক ব্যান্ড ও মাসল রিল্যাক্সের ট্যাবলেট দিলেন। এখানেও ইংরেজি কোনো কাজে এল না, স্প্যানিশ ছাড়া। মাসল রিল্যাক্সের যে প্যাকেট পেলাম, সেখানে সবই স্প্যানিশে নির্দেশনা দেওয়া,কী বিপদ! হোটেলের কাছেই আলহামরা, ১০–১৫ মিনিটের হাঁটা রাস্তা। ঠিক হলো, সবাই আনিকার সঙ্গে পায়ে হেঁটে চলে যাবে আর আমি একা ট্যাক্সি নিয়ে যাব। ট্যাক্সি ভাড়া খুবই কম, মাত্র পাঁচ ইউরো, সুইডেনের কোথাও পাঁচ ইউরোতে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না।
নির্ধারিত সময়ে হোটেল থেকে ট্যাক্সি নিয়ে আলহামরায় চলে এলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার নির্ধারিত স্থানে নামিয়ে সামনে একটি পথ দেখিয়ে দিলেন। বাঁধানো চত্বরটি পেরিয়ে গাছের নিচে বেদির কাছে এসে দাঁড়ালাম। বিভিন্ন দেশের প্রচুর ট্যুরিস্ট আলহামরা দর্শনে এসেছেন। বেশ গরম তবে হাওয়া ঝিরঝিরে। ভিড়ের মধ্যে সবুজ মার্জিত পোশাকে এক স্প্যানিশ মেয়ে দাঁড়িয়ে। ভিড়ের মধ্যেও সতন্ত্র সে। তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি দেখে মনে হলো, সে ট্যুরিস্ট নয় বা কারও জন্য অপেক্ষা করছে না, মেয়েটি পেছনে ফিরতেই দেখা গেল পেছনে ইংরেজি অক্ষরের ‘আই’ সিম্বলটি, অর্থ্যাৎ ইনফরমেশন। গাছের নিচে বেদিতে বসে আনিকা ও অনান্যদের অপেক্ষা করছিলাম।
আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে আলহামরার আর্কশনে আরেকজন এসেছিলেন তবে ট্যাক্সিতে নয়, খচ্চরের পিঠে সওয়ার হয়ে। সালটা ১৮২৯ এর বসন্ত। আমেরিকান লেখক ওয়াসিংটন আরভিং, স্পেনের মুসলিম অতীত ইতিহাসে আগ্রহ জাগাতে যাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। মুরদের তৈরি সাজানো উদ্যান ডালিম গেটের ঠিক ভেতরে ‘টেলাস অব আলহামরা‘ লেখকের একটি মূর্তি রয়েছে। লেখক সেভিলা থেকে পাহাড়ি পথ পারি দিয়ে খচ্চরের পিঠে সওয়ার হয়ে গ্রানাডায় পৌঁছান। লেখক লিখেছেন সে সময়কার কথা, ‘স্পেনের বৃহত্তর অংশ কঠোর, বিষণ্ন। রুক্ষ পাহাড় ও দীর্ঘ বিস্তৃত সমভূমি, গাছপালাশূন্য এবং অবর্ণনীয়ভাবে নীরব ও একাকী। শকুন ও ঈগলকে পাহাড়ের চালে ঘুরে বেড়াতে ও সমভূমির ওপর উড়তে দেখা যায়, প্রকৃতি যেন আফ্রিকার বর্বর ও নির্জন চরিত্রের অংশীদার।
‘স্প্যানিশ খচ্চরচালকের কাছে গান ও ব্যালাডের এক অফুরন্ত ভান্ডার রয়েছে, যা দিয়ে তারা ভ্রমণের ক্লান্তিকে বিভ্রান্ত করে। খচ্চরচালকেরা উচ্চস্বরে এবং দীর্ঘ টান টান তালে গানগুলো উচ্চারণ করে আর খচ্চরের ওপর বসে অসীম গুরুত্বের সঙ্গে সময়কে তার গতিতে সুরের সঙ্গে ধরে রাখে। এই গানগুলো প্রায়ই মুরদের সম্পর্কে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী রোমান্স অথবা কোনো সাধুর কিংবদন্তি অথবা কোনো প্রেমের কবিতা অথবা একজন সাহসী চোরাচালানকারী অথবা কঠোর ব্যান্ডোলেরো সম্পর্কে কিছু ব্যালাড। কারণ, চোরাচালানকারী ও ডাকাত স্পেনের সাধারণ মানুষের কাব্যিক নায়ক। প্রায়ই খচ্চরওয়ালাদের গান মুহূর্তের মধ্যে রচিত হয় এবং স্থানীয় দৃশ্য বা যাত্রার কোনো ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। গান গাওয়া ও ইম্প্রোভাইজ করার এই প্রতিভা স্পেনে প্রায়ই দেখা যায় এবং বলা হয় যে তারা মুরদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। তারা যে অভদ্র এবং একাকী দৃশ্যগুলো চিত্রিত করে তার মধ্যে এই গানগুলো শোনার এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি আছে; যেমনটি হয় মাঝেমধ্যে খচ্চরের ঘণ্টার ঝনঝন শব্দও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। খচ্চরগুলো সারিবদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে খাড়া খাড়া পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসে।
প্রাচীন গ্রানাডা রাজ্য, যেখানে আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছিলাম, স্পেনের সবচেয়ে পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। বিশাল সিয়েরা বা পাহাড়ের শৃঙ্খল, ঝোপঝাড় বা গাছবিহীন এবং বিভিন্ন মার্বেল এবং গ্রানাইট দিয়ে সজ্জিত, তাদের রোদে পোড়া চূড়াগুলোকে গভীর নীল আকাশের বিরুদ্ধে উঁচু করে তোলে; তবুও তাদের রুক্ষ বুকে সবুজ এবং উর্বর উপত্যকা, যেখানে মরুভূমি ও বাগান লড়াই করে ডুমুর, কমলা ও লেবু উৎপাদন করতে এবং গোলাপ ফুল ফোটাতে বাধ্য হয়।
এই পাহাড়ের জঙ্গলে পাহাড়ের মাঝখানে ঈগলের বাসার মতো নির্মিত প্রাচীর ঘেরা শহর ও গ্রাম, মুরিশ যুদ্ধক্ষেত্র অথবা উঁচু চূড়ায় স্থাপিত ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রহরী টাওয়ারের দৃশ্য, মনকে খ্রিষ্টীয় ও মুসলিম যুদ্ধের শৌর্যের দিনগুলোতে এবং গ্রানাডা বিজয়ের রোমান্টিক সংগ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই উঁচু সিয়েরা অতিক্রম করার সময় ভ্রমণকারীকে প্রায়ই নেমে যেতে হয় এবং তার খচ্চর বা ঘোড়াটিকে খাড়া খাড়া আরোহণ এবং অবতরণ বরাবর ওপরে ও নিচে নিয়ে যেতে হয়, যা সিঁড়ির ভাঙা ধাপের মতো। কখনো কখনো রাস্তাটি মাথা ঘোরানো খাড়া খাড়া, অন্ধকার ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নেমে যায়। কখনো কখনো পথটি জলের স্রোত দ্বারা পরিপূর্ণ, চোরাচালানকারীদের অস্পষ্ট পথের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম করে; রাস্তার কোনো এক নির্জন অংশে পাথরের ঢিবির ওপর নির্মিত ডাকাতি ও খুনের স্মৃতিস্তম্ভ, অশুভ ক্রুশ ভ্রমণকারীকে সতর্ক করে যে সে ডাকাতদের আড্ডার মধ্যে আছে, সম্ভবত সেই মুহূর্তেই কোনো ব্যান্ডোলেরোর চোখের সামনে চলে আসবে। কখনো কখনো সরু উপত্যকা দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় সে একটি কর্কশ চিৎকারে চমকে ওঠে এবং তার ওপরে পাহাড়ের কোনো সবুজ ভাঁজে হিংস্র আন্দালুসীয় ষাঁড়ের একটি পাল দেখতে পায়। এই সবে আমি ভয়াবহতা অনুভব করেছি।
স্প্যানিশ ও ইসলামি সংস্কৃতির প্রতি আরভিংয়ের আগ্রহ, অতীতের প্রতি রোমান্টিক আকর্ষণের পাশাপাশি তিনি গ্রানাডা ভ্রমণে আসেন। তিনি বিশেষ করে আলহামরা এবং এর গল্প, কিংবদন্তি ও ইতিহাসের প্রতি আকৃষ্ট হন। গ্রানাডা ও আলহামরায় তাঁর সময়কাল তাঁর লেখায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল, যার ফলে‘টেলস অব দ্য আলহামরার’ সৃষ্টি, যা প্রাসাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বর্ণনা, পৌরাণিক কাহিনি এবং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে উদ্ভাসিত করে।
![]() |
| ১৮১২ সালে আলহামরার কয়েকটি টাওয়ার ফরাসি বাহিনী উড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাকি ভবনগুলো অল্পের জন্য রক্ষা পায়। ছবি: লেখকের পাঠানো |

No comments