কঙ্কালসার শিশুতে ভরা গাজার হাসপাতাল অনাহারে মৃত্যু, মহামারি
গাজায় নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষ
দুই বছরের যুদ্ধে একাধিকবার দুর্ভিক্ষের হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে গাজায়। তবু এ সপ্তাহেই মাত্র তিনদিনে ৪৩ জন ক্ষুধায় মারা গেছেন। এর আগে মোট মৃত্যু ছিল ৬৮। ফায়েজা বলেন, গত বছর উত্তর গাজায় খাদ্য অবরোধের সময়ও পরিস্থিতি এত ভয়াবহ ছিল না। এবার যেন ভয়ঙ্করতম সময়। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা ও ইসরাইলি সরকারি তথ্য মিলিয়ে দেখা যাচ্ছেÑ খাদ্য মজুত প্রায় শেষ, ময়দার দাম বছরের শুরুর তুলনায় ৩০ গুণ বেশি। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, এনজিও কর্মীরাও না খেয়ে কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছেন। এ তথ্য জানিয়েছে শতাধিক ত্রাণ সংস্থার যৌথ বিবৃতি। যার মধ্যে আছে মেডিসিন উইদাউট বর্ডার্স, সেভ দ্য চিলড্রেন, অক্সফ্যামও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম ঘেব্রিয়েসাস বলেন, গাজার বেশির ভাগ মানুষ অনাহারে। এটাকে আর কী বলা যায়? এটা মানবসৃষ্ট গণ-অনাহার।
ইসরাইলি অবরোধ ও ‘মৃত্যু ফাঁদ’ ত্রাণকেন্দ্র
২রা মার্চ থেকে ইসরাইল গাজায় সম্পূর্ণ অবরোধ চালু করে। ১৯শে মে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অবরোধ তুলে নেন। তবে এরপরও ত্রাণ সীমিতভাবে ঢুকতে দেয়া হয়, যাতে দুর্ভিক্ষ ধীরে ধীরে দীর্ঘস্থায়ী হয়। সব ত্রাণকে এখন একটি মার্কিন-সমর্থিত গোপন সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে, যারা চারটি সামরিকায়িত কেন্দ্রের মাধ্যমে খাবার বিতরণ করে। ফিলিস্তিনিরা এই কেন্দ্রগুলোকে বলেন ‘মৃত্যু ফাঁদ’। খাবারের জন্য ভিড় করতে গিয়ে সেখানে শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন। ২২শে জুলাই পর্যন্ত জিএইচএফ ৫৮ দিন ধরে চালু থাকলেও তারা যে খাবার এনেছে, তা সমানভাবে বণ্টন হলেও গাজার জনসংখ্যাকে দুই সপ্তাহও টিকিয়ে রাখতে পারতো না।
ক্ষুধায় বিধ্বস্ত খালিদি পরিবার
উম্মে ইউসুফ আল-খালিদি প্রথমবারের মতো জিএইচএফ কেন্দ্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্ত, ছোট সন্তান মাত্র দুই বছর বয়সী। তিনি বলেন, আমরা শুধু পানি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছি। নিজের জন্য ভয় কম, পরিবারের জন্য ভয় বেশি। চারদিন কিছু খাইনি। পরে এক ব্যাগ চাল ও দুইটি আলু পেয়েছি। যা একজন অপরিচিত পথচারী দিয়ে গিয়েছেন। একসময়ের মেধাবী সন্তানরা, যারা বৃত্তি পেতো, এখন ভাঙা মসজিদের সামনে রাস্তার ধারে পুঁতির ব্রেসলেট বিক্রি করে। তবে বিক্রি হয় খুবই কম। খালিদি বলেন, আমার সন্তানরা কঙ্কালসার, হাড় আর চামড়া ছাড়া শরীরে কিছু নেই। সামান্য কাজেই মাথা ঘোরায়। তারা শুধু খাবার চায়, আর আমার কিছু দেয়ার নেই। খালিদি অবশেষে স্থির করলেন, খাবার পাওয়ার সামান্য সম্ভাবনা পরিবারের একমাত্র প্রাপ্তবয়স্কের মৃত্যুর ঝুঁকির চেয়ে বেশি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে ও দৌড়ে ত্রাণ আনার চেষ্টা করতে হবে। আর পরিবার শুধু অপেক্ষা করবে, ফিরে আসা না আসার অনিশ্চয়তায়।
গাজার সাংবাদিকদের রক্ষায় বিবিসিসহ তিন সংবাদমাধ্যমের বিবৃতি
গাজার সাংবাদিকদের নিয়ে এবার গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে বিবিসি নিউজসহ আরও তিনটি সংবাদমাধ্যম। উপত্যকাটিতে নিজের এবং পরিবারের জন্য খাদ্য সংগ্রহে অক্ষম হয়ে পড়েছেন সাংবাদিকরা। গাজা সংঘাত শুরুর পর থেকেই প্রতিবেদন করে যাচ্ছেন তারা। বর্তমানে তারা অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন বলে এক যৌথ বিবৃতি দিয়েচে বিবিসি নিউজ, এজেন্সি ফ্রান্স-প্রেস (এএফপি), অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) এবং রয়টার্স।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বহু মাস ধরে গাজা থেকে বিশ্ববাসীর কান ও চোখ হিসেবে কাজ করছে সেখানের সাংবাদিকরা। বিবিসিসহ কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে গাজায় প্রবেশ করতে দেয়নি ইসরাইলি। তাই স্থানীয় এসব সাংবাদিকদের ওপরই নির্ভর করেছে বিশ্ব মিডিয়া। সম্প্রতি গাজায় তীব্র দুর্ভীক্ষের বিষয়ে সতর্ক করেছে শতাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও এনজিও।
গণমাধ্যমগুলোর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজায় আমাদের সাংবাদিকদের জন্য আমরা খুব উদ্বিগ্ন। যারা নিজের এবং পরিবারের খাদ্য জোগাতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। বহু মাস ধরে বিশ্ববাসীর চোখ ও কান হিসেবে কাজ করছে উপত্যকার এই স্বাধীন সাংবাদিকেরা। এতদিন তারা যে পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছে এখন তারাই সে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকরা অনেক বঞ্চনা এবং কষ্ট সহ্য করেন। আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে, এখন অনাহারের মুখোমুখি হয়েছেন তারা। আমরা ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানাই তারা যেন সাংবাদিকদের সেখান থেকে নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ করে দেয়। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য পৌঁছানো অপরিহার্য।

No comments