জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং বিবিসির তথ্যচিত্র by মহিউদ্দিন আহমদ

শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের মেয়ে। মুজিব দেশ শাসন করেছেন সাড়ে তিন বছর। এ দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের পত্তন হয় তাঁর হাতে। তাঁর জনপ্রিয়তা যখন তলানিতে, তখন তিনি খুন হন মিলিটারির হাতে। হাসিনার হাতে দেশ ছিল সাড়ে ২০ বছর। অনেক বিষয়ে তিনি তাঁর বাবাকে অনুসরণ করেছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাঁকে ছাড়িয়ে গেছেন। কর্তৃত্ববাদী শাসনকে তিনি চূড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন। একসময় তাঁরও পতন হয়। তিনি প্রাণ নিয়ে পালান। সেই সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো খুন করে যান তাঁর বাবাকে। এটি একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।

হাসিনার অনুগতরা নানান ইহজাগতিক প্রাপ্তির জন্য তাঁকে রীতিমতো পূজা করতেন। কেউ তাঁকে দেশরত্ন, আবার কেউ তাঁকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলতেন; কেউ তাঁকে ভাষাকন্যা আবার কেউ তাঁকে মানবতার মা উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর আশ্রিত বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে স্বাধীনতার বয়ান নতুন করে লিখছিলেন। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে ছোট–বড় কয়েকটি রাজনৈতিক দল। হাসিনার লোকেরা তাদের অনেককে হেনস্তা করেছে, পিটিয়েছে, জেলে পুরেছে, গুম করেছে, মেরে ফেলেছে। হাসিনা জীবৎকালে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না, কিংবা খালেদা জিয়া তাঁর জীবদ্দশায় মুক্ত জীবন যাপন করতে পারবেন, একসময় তা অবিশ্বাস্য মনে হতো। সেটাই ঘটে গেল চব্বিশের ৫ আগস্ট।

হাসিনার আমলে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করলেও নানা কারণে তাতে জনসম্পৃক্তি ঘটেনি। আন্দোলনগুলো ছিল মূলত দলীয় কর্মীনির্ভর। আসলে মানুষ সনাতন ধারার রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়েছিল, বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে আমরা কয়েকটি আন্দোলন দেখলাম, যেখানে সাধারণ নাগরিকদের একাত্ম হতে দেখা গেছে। এগুলো সরকার বদলের আন্দোলন ছিল না, কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারেও হয়নি। যদিও সেগুলো অনেক রাজনৈতিক দলের সহানুভূতি ও সমর্থন পেয়েছিল এবং তাদের অনেক কর্মী সেসব আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথা বলতে পারি। এই আন্দোলনে সাধারণ নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল। শেষের দিকে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়েছিল সরকারি দলের গুন্ডারা। হেলমেটধারী এসব লোকের ছবি ও খবর দেখেছি সংবাদমাধ্যমে।

এবার কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে আসা যাক। এটি হয়েছে তিন দফায়। প্রথম দুবার এটি সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সাড়া জাগালেও বেশি দূর যেতে পারেনি। দুবারই হোঁচট খেয়েছে। ক্যাম্পাসে তাদের ওপর চড়াও হয়েছিল সরকারি ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েরা। আন্দোলন দমনে হাসিনার মডেলটা ছিল এ রকম: ছাত্ররা আন্দোলন করবে। সরকারি ছাত্রসংগঠনের লোকেরা তাদের ওপর হামলা করবে। পিটিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেবে। তাতেও কাজ না হলে টাকাপয়সা দিয়ে, গোয়েন্দা লাগিয়ে, পোষা সাংবাদিকের ভুয়া রিপোর্ট প্রচার করিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করবে। একসময় আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু তৃতীয় দফায় এসে কোটা আন্দোলনটি এভাবে দমানো যায়নি। বলা চলে, সরকারের অতিচালাকির কারণেই আন্দোলনের সূত্রপাত। দ্বিতীয় দফা কোটা আন্দোলনের পর সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে চাকরির ক্ষেত্রে সব ধরনের কোটা বন্ধ করে দিয়েছিল। যদিও আন্দোলনকারী ছাত্ররা সেটি চায়নি। তারা চেয়েছিল, কোটা সংস্কার করে একটা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে। হাসিনা একটা স্টান্টবাজি করে পুরো কোটাব্যবস্থাই তুলে দেন।

এখানে থামলেই ভালো হতো। কিন্তু হাসিনার মাথায় সব সময় দুষ্টবুদ্ধি কিলবিল করে। তিনি বিরোধীদের দৌড়ের ওপর রেখেছেন। যেখানে কোনো সমস্যা ছিল না, সেখানে একটা ইস্যু তৈরি করে বিরোধীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। মুখের ভাষা ছিল অসংযত, অমার্জিত, দুর্বিনীত। তাঁর লাগামহীন কথার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এটা বোঝার মতো রুচি, শিক্ষা কিংবা আগ্রহ তাঁর ছিল না। ভয়ে তাঁকে কেউ পরামর্শ দিতে পারতেন না। বেছে বেছে মোসাহেবদের উপদেষ্টা বানাতেন তিনি। তারা ছিল হুকুমের চাকর।

কোটা পুনরুদ্ধারের জন্য আদালতে রিট হলো। এটা সেই পুরোনো কৌশল। হাসিনা নিজে না করে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তাঁর নোংরা খেলাটা খেলতে চেয়েছেন। একই খেলা খেলে তিনি আদালত থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার–সম্পর্কিত সংবিধানের ধারাটি অবৈধ ঘোষণা করিয়ে নিজের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেছিলেন। তিনি জানতেন, এই ধারা বাতিল হলে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। বিচারালয়ে সেবাদাসের অভাব ছিল না। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ছাত্রসমাজ আর চাকরিপ্রত্যাশীরা ফুঁসে উঠল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এটি দমাতে আবারও সেই পুরোনো কৌশল। প্রথমে ভাড়াটে হেলমেট বাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের পেটানো, ছাত্রাবাস থেকে বের করে দেওয়া, রাস্তায় তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চলল। প্রথমবারের মতো দেখা গেল, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা এমনকি স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত এই আন্দোলনে একাত্ম হয়ে গেল। আন্দোলন চলে এল ক্যাম্পাসের বাইরে। এবার মাঠে নামল পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি। হেলমেট বাহিনী আন্দোলনকারীদের পেটায়, আইন প্রয়োগকারী বাহিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হামলাকারীদের সুরক্ষা দেয়। তারপর তারাও যুদ্ধ ঘোষণা করে আন্দোলনকারীদের ওপর। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। জনসম্পৃক্তি বেড়ে যাওয়ার একপর্যায়ে এটি প্রচণ্ড গণবিদ্রোহে রূপ নেয়। হাসিনা সরকারের পতন হয়।

দেশ ও দলের প্রতি হাসিনার কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। দলের মধ্যেই তিনি তৈরি করেছিলেন আত্মীয় লীগ। তাঁর ভাবনা ছিল শুধু পরিবার ও ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতিগুষ্টি নিয়ে। তাদেরকে নিরাপদে সরিয়ে সবশেষে তিনি চম্পট দেন। এমন স্বার্থপর ও অমর্যাদাকর প্রস্থান এ দেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি।

আন্দোলন দমনে সরকারি দলের গুন্ডা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর নির্মমতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নানা রকম বিধিনিষেধের কারণে অনেক খবরই মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশ পেত না। নির্ভর করতে হতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ওপর। হাসিনা সেখানেও থাবা বসান। টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে তিনি সারা দেশকে কয়েদখানা বানিয়ে ফেলেন।

কারফিউ দিয়েও রাস্তায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার স্রোত আটকানো যায়নি। এটা ছিল আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র–জনতার ওপর রাষ্ট্রের ভয়াবহতম যুদ্ধ, যা আমাদেরকে একাত্তরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সম্প্রতি বিবিসি প্রচারিত একটি তথ্যচিত্রে চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের যে ছবি তুলে ধরা হয়েছে, তাতে সরকারি বাহিনীগুলোর নৃশংসতার কিছুটা পরিচয় মেলে। ফাঁস হওয়া কলরেকর্ড থেকে জানা যায়, স্বয়ং হাসিনা আন্দোলন দমাতে পুলিশকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটা অবশ্য জানাই ছিল, সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া আন্দোলনকারীদের ওপর এ ধরনের বর্বরোচিত হামলা হতে পারে না। হাসিনার ফাঁস হওয়া নির্দেশ তার একটি প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে।

ইতিমধ্যে দেশে ও বিদেশে ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার কিছু আত্মীয় ও পোষ্য বলতে শুরু করেছে, এআই দিয়ে এসব বানানো হয়েছে, বিবিসি তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সংস্থা, পুরো আন্দোলনটা ছিল আমেরিকার ষড়যন্ত্র ইত্যাদি। তাঁর গুণধর পুত্র মায়ের কণ্ঠস্বর শনাক্ত করে বলেছেন, এটা নাকি ২০১৬ সালের ফোনকল। হাসিনার ক্রীতদাসেরা এটি প্রচার করে বেড়াচ্ছে। একটা কথা মনে পড়ে গেল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে রাতের ভোট নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কোনো কোনো পোষ্য সাংবাদিক এমনও বলেছেন, এটা মিথ্যা প্রচারণা, আপনাদের কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে, কোনো ছবি বা ভিডিও ফুটেজ আছে ইত্যাদি। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন, রাতেই ভোট হয়েছিল।

বিবিসি যথেষ্ট পেশাদারত্ব নিয়ে তথ্যচিত্রটি বানিয়েছে। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ীতে ঘটে যাওয়া পুলিশি নৃশংসতার যে ছবি আমরা দেখলাম, তা শিউরে ওঠার মতো। অনুসন্ধান করে বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, উত্তরা ও অন্যান্য জায়গার ঘটনাগুলোও এভাবে তুলে আনা যায়। এ তো গেল শুধু ঢাকা শহরের কথা। দেশের অন্যান্য জায়গায় এমন হামলা হয়েছে অনেক। জাহাঙ্গীরনগর কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি দলের গুন্ডারা হামলা চালিয়ে নরক বানিয়ে ফেলেছিল। অনেকেই অনেক জায়গায় ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার ভিডিও করে রেখেছেন। সবার হাতে এখন মুঠোফোন। কোনো কিছুই দীর্ঘদিনের জন্য লুকিয়ে রাখা যাবে না।

* মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
- মতামত লেখকের নিজস্ব

আন্দোলন দমনে দলীয় গুন্ডা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মমতা সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল
আন্দোলন দমনে দলীয় গুন্ডা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মমতা সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফাইল ছবি

No comments

Powered by Blogger.